নগরীতে জোড়া খুনের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরী করতে গিয়ে আঁতকে উঠলো পুলিশ…….!

নিজস্ব প্রতিবেদক::  নগরীতে মা-ছেলে খুনের ঘটনায় লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের সময় মা-ছেলের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে আঁতকে ওঠেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তাদের দু’জনের শরীরে ১১২টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এদিকে, তানিয়া ও লোকন মিয়া নামের দু’জনকে খুঁজছে পুলিশ। তাদের ধারণা এ দু’জনকে পাওয়া গেলেই আলোচিত এ জোড়া খুনের ক্লু-উদ্ধার করা সহজ হবে।

লাশ দুটির ময়নাতদন্তকারী ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, রোকেয়া বেগম ও তার ছেলে রোকনকে ছুরিকাঘাতেই হত্যা করা হয়। এ কারণে তাদের দু’জনের শরীরে ১১২টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

ওই চিকিৎসক আরও জানান, রোকেয়া বেগমের শরীরে ৭২টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এরমধ্যে পেটে ১৫, পিঠে ৩৫, উরুর পেছনের দিকে ১১, দুই হাতে ৩টি করে ৬টি, গলায় ৪টি এবং মাথার পেছনে একটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। রোকনের শরীরে পাওয়া যায় ৪০টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। এর মধ্যে গলার ডান দিকে ১টি, বুকের বাম পাশসহ বিভিন্ন দিকে ৪টি, পেটে ছোট-বড় ১৫, পিঠে ৩, বাম ও ডান হাতে ১৬টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

এদিকে, ২০১৭ সালের ১লা এপ্রিল নগরের মীরাবাজারের খারপাড়ার বাসাটি ভাড়া নেন রোকেয়া বেগম। এর এক বছর পর ২০১৮ সালের ১লা এপ্রিল এই বাসা থেকে ছেলেসহ তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

বাসা ভাড়া নেয়ার সময় তথ্য ফরমে রোকেয়া বেগম (৪০), রবিউল ইসলাম রুকন (১৭) ও জান্নাতুল ফেরদৌস রাইসা রাইসসহ (৫) লোকন মিয়া (৩৪) নামে একজনের নাম লেখা হয়। তবে লোকন মিয়ার পরিচয় বা তাদের সঙ্গে কি সর্ম্পক ছিল তার কোনো তথ্য নেই ফরমে। এমনকি গত রোববার ওই বাসায় লোকন মিয়ার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বাসার মালিক বা রোকেয়ার পরিবারের সদস্যরাও জানেন না কে এই লোকন মিয়া।

রোকেয়া বেগমের ছোট ভাই জাকির হোসেন বলেন, লোকন মিয়া নামে কাউকে আমি চিনি না। এমনকি আমাদের পরিবারে এ নামের কেউ নেই।

অন্যদিকে, রোকেয়ার মেয়ে রাইসা জানিয়েছে, তার মা ও ভাইকে হত্যা করেছে তানিয়া নামের একজন। কে এই তানিয়া তাও রোববার রাত পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে জানা গেছে রোকেয়া বেগমের বাসার কাজের মেয়ের নাম তানিয়া। ঘটনার পর থেকে সে নিখোঁজ রয়েছে।

সিলেট নগরের মিরাবাজারে খারপাড়ার মিতালী আবাসিক এলাকার ১৫/জে নম্বর বাসা থেকে গত ১লা এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে রোকেয়া বেগম (৪০) ও রবিউল ইসলাম রুকনের (১৭) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় ওই বাসা থেকে রোকেয়া বেগমের পাঁচ বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস রাইসা রাইসকে উদ্ধার করা হয় ।

যে বাসায় খুন হন রোকেয়া বেগম তার পাশের বাসায়ই ভাড়া থাকেন শেফালি বেগম। রোববার সকালে রোকেয়া বেগমের ভাই জাকির হোসেনের চিৎকার শুনে বাসা থেকে বের হন শেফালি। গিয়ে তিনি দেখেন, জানালার পাশে জাকির কান্না করছেন।

শেফালী বলেন, ভেতরে ছোট্ট মেয়েটি এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়াচ্ছে আর কান্না করছে। মামাকে দেখার পর মেয়েটা (রাইসা) সাহস পায়। বলতে থাকে- ‘তানিয়া ভাইয়ারে মারছে, আম্মারেও মারছে, আম্মার গলা কাটছে, তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়া যাও। আমার গলায়ও ধরছে। বলে কাঁদতে থাকে।’

শেফালি বেগম বলেন, ভেতরে বাচ্চাটা কান্না করতেছে। খালি জানালাটা ভাঙতাম পারছি না। ইগুরে আল্লায় বাঁচাইয়া রাকছুইন মনে হয় সাক্ষী দিত করি। বাচ্চাটার গলাত ইলা ধরছে, খাল উঠি গেছে, দাগ পরি গেছে।’

খারপাড়া এলাকার শারমিন স্টোরের মালিক নাজমুল ইসলাম বলেন, রোকেয়া বেগমের ছেলে রোকন মিরাবাজার এলাকার শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে খুব ভালো ছেলে। তবে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সে আমার দোকান থেকে বেনসন সিগারেট নিয়ে যেতো। আমি তাকে কখনও সিগারেট খেতে দেখিনি। দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে সে সরাসরি বাসায় চলে যেতো।

তিনি আরও বলেন, গত শনিবার (৩১শে মার্চ) রাত ১০টার দিকে সে দোকান থেকে বেনসন সিগারেট নিয়ে যায়। আর রবিবার (১লা এপ্রিল) খবর পেয়েছি, রোকন ও তার মাকে কারা বাসার ভেতরে খুন করে রেখে গেছে।

রোকেয়া বেগমের বাসার মালিক সালমান হোসেন বলেন, মাসে ১৩ হাজার টাকায় আমার বাসার নিচলতলার বাম পাশের অংশটি ভাড়া দিই। বাসা ভাড়া নেয়ার সময় রোকেয়া নামের ওই নারী জানান, তিনি পার্লার চালান। তার পার্লার নগরীর পাঠানটুলা এলাকায় রয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তিনতলা ভবনের নিচতলায় চার কক্ষের একটি বাসায় থাকতেন রোকেয়া। বাসার বাম দিকের কক্ষে থাকতো রোকন এবং ডান দিকের শেষের প্রান্তের কক্ষে থাকতেন রোকেয়া বেগম। রোকেয়া বেগমের কক্ষে পুরুষের যাতায়াত ছিল, এমন কিছু আলামত পেয়েছে পুলিশ। বিছানার পাশের একটি টেবিলে বেনসন সিগারেটের দু’টি প্যাকেটও পাওয়া গেছে।

রোকেয়া বেগমের ছোট বোনের স্বামী ফারুক আহমেদ বলেন, শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে আপার সঙ্গে আমার ফোনে কথা বলার সময় তিনি বলেছেন, গত কয়েকদিন আগে একটা গেঞ্জাম হয়েছে বাসায়। সমস্যার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে আপা ভয়ে কিছু বলে নাই। তিনি শুধু বলেন, সবাইরে জানানো হলে আমার ছেলের উপর অত্যাচার করবে তারা। আপা বলেন, তোমার বাড়িতে জায়গা আছে আমারে একটা রুম বানিয়ে দাও থাকার জন্য। আমি বলেছি, কীভাবে কি করা লাগবে আমি তোমাকে রাতে জানাবো। রাত আটটার দিকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কল করলে তার ফোন বন্ধ পাই। ওই দিন ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎ ছিল না তাই মনে করেছি মোবাইলে হয়তো চার্জ নাই। পরের দিন বিদ্যুৎ না থাকার কারণে আমার মোবাইলেও চার্জ ছিল না। শনিবার রাতে ৯টার দিকে আবারও কল করলে তার মোবাইল বন্ধ পাই। এরপর সকালে জাকির ভাই এসে এই ঘটনা দেখতে পান।

কোতোয়ালি থানা পুলিশের ওসি গৌছুল হোসেন বলেন, উদ্ধারকৃত রাইসার জবানবন্দিতে আসা তানিয়া সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য নেই বলে জানান তিনি। তবে তদন্তপূর্বক এ সর্ম্পকে বিস্তারিত বলা যাবে।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রোকেয়া বেগমের সঙ্গে স্বামী হেলাল আহমদের অনেকদিন ধরেই বনিবনা হচ্ছিলো না। হেলালের অপর স্ত্রী পান্না বেগম ও তাদের নয় বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে নগরের বারুতখানা এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। হেলালের দ্বিতীয় স্ত্রী পান্না বেগম বলেন, আমাদের সঙ্গে রোকেয়া বেগমের কোনো যোগাযোগ নেই।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জোড়া খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তারা মা ও ভাইয়ের সঙ্গে শিশু রাইসাকেও গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেছিল। ওই সময় রাইসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে মৃত ভেবে বাসার ভেতর ফেলে রেখে ঘাতকরা পালিয়ে যায়।

রাইসার গলায় আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। সেটা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতার করার পর তাদের আঙুলের ছাপের সঙ্গে সংরক্ষণ করা ছাপগুলো মিলিয়ে দেখা হবে।

পুলিশ সূত্র জানায়, মা-ছেলে খুনের নেপথ্যে পুলিশ একাধিক যুবকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে। যারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা পেশাদার খুনি। হত্যা করার সময় আশপাশের লোকজন যাতে কোনো কিছু বুঝতে না পারে, সেজন্য অনেক সময় নিয়েই তারা পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অনায়াসে পালিয়ে যায়।

পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা রোকেয়া বেগমের খুবই পরিচিত। কারণ, তার বাসায় ছেলে ছাড়া আর কোনো পুরুষ থাকতেন না। তবে রোকেয়া বেগমের ছেলে স্থানীয় মুদি দোকান ‘শারমিন স্টোর’ থেকে সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই বাসায় বেনসন সিগারেট নিয়ে যেত। এমনকি ঘটনার দিনও রোকেয়া বেগমের বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ওপর বেনসনের খালি দুটি প্যাকেট পায় পুলিশ। এগুলো কাদের জন্য নেয়া হতো তাও গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব (গণমাধ্যম) জানান, মা ও ছেলের শরীরের পুলিশ সুরতহাল প্রস্তুতের সময় শতাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পেয়েছে। তাদের ছুরিকাঘাত কিংবা অন্যভাবে হত্যা করা হয়েছে কিনা সে বিষয়টি জানা যাবে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) জানান, রাইসার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তবে তার মা ও ভাইকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। পুলিশের ধারণা, দুজনকেই ধারালো ছোরা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বিছানা ও মেঝেতে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে।

নিহত রোকেয়া বেগমের মেয়ে রাইসা এখনও পুলিশ হেফাজতে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছে বলেও তিনি জানান।



from Sylhet News | সুরমা টাইমস https://ift.tt/2q7bnKD

April 03, 2018 at 07:04PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top