সৈয়দ বাপ্পী/আব্দুল্লাহ আল নোমান ::
বার বার উত্যক্ত ও একাধিকবার ধর্ষণ প্রচেষ্টার কারণে অপমানে আত্মহত্যা করেছেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে এক বিধবা। এ ঘটনায় ধর্ষণ চেষ্টাকারীকে একমাত্র আসামী করে মামলা করেছেন নিহতের ছেলে উপজেলার রংপুরিবস্তির আছির উদ্দিনের ছেলে মো. আলী হোসেন। ঘটনার পর গ্রামবাসী ধর্ষণ প্রচেষ্টাকারীকে আটকে রাখলেও প্রভাবশালীরা তাকে ছাড়িয়ে নেন। আর এ ঘটনায় ক্ষোভে অপমানে রাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন বিধবা শরিফুন্নেছা।
এজাহারে মামলার বাদী আলী হোসেন উল্লেখ করেন, তিনি জীবিকার তাগিদে পাশ্বর্বর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে পাথর কোয়ারিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছেন। তার বাড়িটি ২ কক্ষ বিশিষ্ট। বাড়ির পশ্চিত দিকের কক্ষে তার বিধবা শরিফুন্নেছা (৫০) ও ২ মেয়ে এবং পূর্ব কক্ষে স্ত্রী বসবাস করেন। উত্তরপাশের বাড়ির বাসিন্দা মো. আলী মুন্সি বিভিন্ন সময় বাদীর মা শরিফুন্নেছাকে উত্যক্ত করতো ও কু প্রস্তাব দিতো। এ নিয়ে এলাকায় বিচার প্রার্থীও হন তারা। গত ১ মার্চ দুপুর সাড়ে ১২টায় মো. আলী মুন্সি বাড়িতে প্রবেশ করে। এ সময় শরিফুন্নেছাকে একা পেয়ে তাকে ধর্ষণের উদ্দ্যেশ্যে ঝাপটে ধরে। শরিফুন্নেছার আর্ত চিৎকারে লোকজন এগিয়ে আসেন। পরবর্তীতে এ ঘটনার কারণে রাতে বসতঘরের শয়নকক্ষে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। ভোরে স্ত্রী হোসনা বেগমের কাছ থেকে মায়ের মৃত্যু সংবাদ পাই।
এদিকে খবর পেয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সোমবার সকালে শরিফুন্নেছার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাদ এশা জানাযা শেষে শরিফুন্নেছাকে খায়েরগাঁও গ্রামের পঞ্চায়েতি গোরস্থানে দাফন করা হয়।
শরিফুন্নেছার দেবর নজরুল ইসলাম বলেন, গত রোববার বেলা ১২টার দিকে মুন্সি ধর্ষণ প্রচেষ্টা করার সময় স্থানীয়রা তাকে আটক করে শরিফুন্নেছার বাড়ির পূর্বকক্ষে ২ ঘন্টা আটকে রাখে। এ সময় ইয়াকুব মাস্টার মোবাইল ফোনে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেন। এছাড়া সাবেক ইউপি নুর হোসেন মোল্লাও বিষয়টি দেখে দেওয়ার আশ্বাস দেন।
পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন বলেন, পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার কারণে মুন্সি ওই মহিলাকে ১০০০ টাকা ধার দেয়। গত রোববার রাতে মুন্সি মহিলার বাড়িতে যান পাওনা টাকা আদায়ের জন্য। মহিলা পাওনা টাকা ফেরত দেয়। পরে আত্মহত্যা করে বলে জানতে পেরেছি। মুন্সি কোনো অবস্থায় ধর্ষণের সাথে জড়িত নয়, এটা সে করতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ একটা নাটক।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার আলমগীর আলম বলেন, স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জেনেছি ধর্ষণের প্রচেষ্টা করায় ওই মহিলা আত্মহত্যা করেছেন। ধর্ষণ চেষ্টাকারী গ্রামের প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কেউ মুখ খুলছে না। তবে গ্রামবাসীর দাবি, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দায়ি ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। যাতে আর কেউ এ ধরণের কাজ করার সাহস না পায়।
সাবেক ইউপি সদস্য নুর হোসেন মোল্লা বলেন, আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না, তবে শুনেছি ধর্ষণ প্রচেষ্টার পর এলাকার লোকজন মুন্সিকে একটি কক্ষে ২ ঘন্টা আটকে রাখে। পরে ইয়াকুব আলী মাস্টারসহ আরো কিছু লোক বিষয়টি মীমাংসা করে দেওয়ার আশ^াস দিয়ে ধর্ষণ প্রচেষ্টাকারীকে ছাড়িয়ে আনেন।
এ ব্যাপারে ইয়াকুব আলী মাস্টার বলেন, আমি কোনো তদবির করিনি। তাকে ছাড়িয়েও আনিনি। এছাড়া আমি কিছুই জানি না। শুনেছি মো. আলী মুন্সিকে রাস্তা থেকে ধরে আনা হয় ওইদিন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। তিনি বলেন, শরিফুন্নেছার দেবর মিথ্যা কথা বলছে, আমি কাউকে ছাড়ার জন্য বলিনি কিংবা কাউকে ফোন করিনি।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) দিলীপ কান্ত নাথ সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মামলার আসামীকে গ্রেফতারে তার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ সম্ভাব্য সকল কৌশল অবলম্বন করছে। এছাড়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জিএম আসলামুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি টিম মাঠে কাজ করে যাচ্ছে।
জানা গেছে, নিত্য নতুন ভয়াবহতা নিয়ে চলছে ধর্ষণ। প্রতিনিদি পত্রিকার পাতা খুললেই বিকৃত যৌন নির্যাতনের খবরে আঁতকে উঠছেন পাঠক। অহরহ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু, স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী থেকে শুরু করে কর্মজীবী নারী গৃহিণীসহ বিভিন্ন স্তরের মহিলা। নানাভাবে ফাঁদে ফেলে তরুণীদের আটকে রেখে ঘটছে গণধর্ষণের ঘটনা। এমনকি ছোট ছোট শিশুকে নানা লোভ দেখিয়ে যৌন নির্যাতন করছে তারই কোনো না কোনো স্বজন। রেহাই পাচ্ছে না কোমলমতি শিশুও। কোনো কোনো দিন একাধিক ধর্ষণের খবর আসছে পত্রিকায়।
হবিগঞ্জের শায়েস্তগঞ্জে তরুণীকে অপহরণ করে একমাস পর্যায় ক্রমে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ধর্ষিতাকে হত্যা, কমলগঞ্জে ধর্ষণের পর রেল লাইনে ফেলে কলেজ ছাত্রীকে হত্যা, একই উপজেলায় গত শুক্রবার চলন্ত সিএনজি-অটোরিকশায় কলেজছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টাসহ ঘটে যাওয়া কয়েক ঘটনায় আঁতকে উঠছেন সিলেটবাসী। ধর্ষণের ভয়াল রূপে শঙ্কিত কন্যা-শিশুর বাবা মা।
দীর্ঘ দিন ধরে ধর্ষণের ক্ষেত্রে যেটি ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে, তা হলো ব্ল্যাকমেইলিং। ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আদায় করা হচ্ছে অর্থ। ভুক্তভোগীকে বারবার বাধ্য করা হচ্ছে তাদের ডাকে সাড়া দিতে। এ ছাড়া সম্পর্কের সূত্র ধরে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অথবা অন্য কোনোভাবে বশ করে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তা-ও কৌশলে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে তরুণীদের। এভাবে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে সিলেটজুড়ে। কয়েক দিন ধরে সিলেটজুড়ে আলোচিত হচ্ছে ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা। একের পর এক চাঞ্চল্যকর যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা সামনে আসছে আর পেছনে চলে যাচ্ছে একের পর এক বিভৎস ঘটনা।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে অগণিত মানুষ মিছিল সমাবেশ করেছে। কখনো কখনো তা সহিংস রূপ নিয়েছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদের মধ্যেই ধর্ষণের পর হত্যা করে ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে ধর্ষকেরা।
প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের খবর প্রমাণ করছে ধর্ষণ ধীরে ধীরে যেন স্বাভাবিক ঘটনা হতে চলেছে। আর এ নিয়েই বিরাজ করছে ভীষণ রকমের ভীতি আর আতঙ্ক কন্যা সন্তানের পিতা-মাতার মনে। কখন কিভাবে কোন ঘটনার জালে জড়িয়ে তাদের নিষ্পাপ মেয়েটির চরিত্রে কালিমা লেপন করে দেয়া হয় সে আতঙ্কে দিন কাটছে অনেক মা-বাবার। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে চলতি বছরের মার্চ মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রতি মাস, প্রতি বছরের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে আছে আগের রেকর্ড।
গত ২১ জানুয়ারি শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। এক মাস তাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এক মাস নির্যাতনের পর বিউটিকে কৌশলে তার বাড়িতে রেখে পালিয়ে যায় বাবুল। এ ঘটনায় গত ১ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা স্থানীয় ইউপি মেম্বার কলমচানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। পরে মেয়েকে সায়েদ আলী তার নানার বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। এরপর বাবুল ক্ষিপ্ত হয়ে ১৬ মার্চ রাতে বিউটি আক্তারকে লাখাই উপজেলার গুনিপুর গ্রামের তার নানার বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে ফের ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শায়েস্তাগঞ্জের হাওরে ফেলে রাখা হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে এ ঘটনায় বিউটিকে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে গত ১৭ মার্চ তার বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল মিয়াসহ দু’জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর ২১ মার্চ পুলিশ বাবুলের মা কলমচান ও সন্দেহভাজন হিসেবে একই গ্রামের ইসমাইলকে গ্রেফতার করে।
গত ২৮ মার্চ মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় নগর রেল ক্রসিং এলাকা থেকে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অনার্স ফাইনাল বর্ষের পরীক্ষার্থী তন্নির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তন্নিকে ধর্ষণের পর রেললাইনে ফেলে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। কারণ তন্নির পরনের বোরকা ও হাতে পরীক্ষার ফাইল রেললাইনের পাশেই পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থী তন্নি কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের পাবই গ্রামের আনোয়ারুল হকের মেয়ে ও কমলগঞ্জের পতনউষার গ্রামের রাসেল আহমদের স্ত্রী।
এদিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চলন্ত সিএনজি-অটোরিকশায় কলেজছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় সিএনজি থেকে লাফ দিয়ে নিজের সম্ভ্রম বাঁচালেও ওই ছাত্রী গুরুতর আহত হয়েছে। ঘটনার পর শুক্রবার ওই ছাত্রীর চাচা বাদী হয়ে কমলগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস https://ift.tt/2ItUMqT
April 05, 2018 at 02:50AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন