ঢাকা, ০৭ এপ্রিল- মাকে হারিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকত শামসুন্নাহার। কতই-বা বয়স তখন? মাত্র ১০ বছর। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মায়ের নিথর দেহ যেদিন অ্যাম্বুলেন্সে করে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার মুক্তাগাছার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো, ফ্যালফ্যাল করে সেদিন চেয়ে ছিল মায়ের মায়াভরা মুখের দিকে। বাবা নেকবর আলী ফুটবল খেলতে দিতে চাইতেন না, মা এগিয়ে এসে বকা দিতেন বাবাকে। কত দিন যে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বাবার লাঠির বাড়ি থেকে নিস্তার পেয়েছে, সে কথা মনে পড়লে এখনো চোখের কোণে জল জমে ওঠে। সেই জল মুছে আবারও ফুটবল খেলতে শুরু করে শামসুন্নাহার। ফুটবলেই ভুলে থাকতে চায়, মা হারানোর শোক, দুঃখ। এই ফুটবলেই আনন্দ খুঁজে নেয় বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৫ দলের ফরোয়ার্ড শামসুন্নাহার। ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের পাশের গ্রাম মুক্তাগাছায় তার বাড়ি। কলসিন্দুর যেন বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল প্রতিভার খনি। আর সেই খনি থেকে বেরিয়ে আসা একেকটি মুক্তা ঝিলিক দিয়ে ভাসিয়ে দেয় পুরো বিশ্বকে। সেই মুক্তার একটি টুকরা শামসুন্নাহার জুনিয়র। হংকংয়ে ১ এপ্রিল শেষ হওয়া জকি ক্লাব চার জাতি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছে শামসুন্নাহার। আসলে বাংলাদেশ দলে রয়েছে দুজন শামসুন্নাহার। জাতীয় দলের জার্সি প্রথমে গায়ে চাপিয়েছে সিনিয়র শামসুন্নাহার। ২০১৪ সাল থেকেই সে দাপটের সঙ্গে খেলে চলছে। শুরুতে ডিফেন্ডার হিসেবে খেললেও গত ডিসেম্বরের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে সিনিয়র শামসুন্নাহার খেলেছে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। আর শামসুন্নাহার জুনিয়র জাতীয় দলে সুযোগ পায় প্রথম গত ডিসেম্বরে। খেলছে ফরোয়ার্ড পজিশনে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফুটবল দিয়েই উত্থান শামসুন্নাহারের। অন্যদের তুলনায় বয়স একটু কম হওয়ায় বঙ্গমাতা ফুটবলের একাদশে খেলার সুযোগ কমই মিলত। কিন্তু যেটুকু সময় মাঠে নামত দর্শকদের মন জয় করে ফেলত অনায়াসেই। বয়স এতই কম ছিল যে জার্সি ঠিকমতো গায়ে লাগত না। শর্টসের ভেতর জার্সি গুঁজে তবেই কোচ তাকে মাঠে নামাতেন। বদলি হিসেবে মাঠে নেমেই গোল করাটা অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিল শামসুন্নাহার। অনেকে তখন তাকে ডাকত সুপার সাব বলে। তবে বেশি দিন বদলি হিসেবে খেলতে হয়নি। যোগ্যতা দিয়েই নিয়মিত একাদশে সুযোগ পেয়েছে। জাতীয় দলের আরেক সতীর্থ ময়মনসিংহের মেয়ে তহুরাকে এলাকাতে মেসি বলে ডাকে। আর শামসুন্নাহারকে ডাকে ছোট মেসি বলে। একেবারে লিকলিকে গড়নের জন্য কেউ কেউ নেইমারও বলে। শামসুন্নাহারের অসাধারণ ড্রিবলিং দেখতে ময়মনসিংহের মাঠে এখনো ছুটে আসে দর্শক। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা শুরু করে শামসুন্নাহার। অন্যদের সঙ্গে অনুশীলন করত। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবার হওয়ায় বাবা কখনোই চাননি যে মেয়ে খেলাধুলা করুক। নেকবর আলীর প্রথম স্ত্রী মারা যান সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়। এর প্রায় তিন বছর বাদে পরিবারের চাপে বিয়ে করেন। শামসুন্নাহাররা তিন বোন। বড় বোন কামরুন্নাহারকে কৈশোর না পেরোতেই বিয়ে দিয়েছেন বাবা। মেজ শামসুন্নাহার ফুটবল খেলছে। বর্তমানে পড়াশোনা করছে ধোবাউড়ার কলসিন্দুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে। ছোট বোন নাজমুন্নাহারও দুর্দান্ত ফুটবল খেলত। কিন্তু তার খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেছে। শুরুর দিকে ফুটবল খেলতে গেলে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হতো শামসুন্নাহারকে। রাজধানীর ফুটবল ভবনে বসে সেই দুঃখের কথা শোনাচ্ছিল শামসুন্নাহার, বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে স্কুলে খেলতে যেতাম। অনেক সময় স্কুলের পোশাক পরে বের হতাম বাড়ি থেকে। কিন্তু আসলে তো আমরা প্র্যাকটিস করতে যেতাম তখন। জার্সি আর বুটজোড়া লুকিয়ে রাখতাম ব্যাগে। এলাকার কিছু ছেলে বলত, তোমার ভাই খেলবে ফুটবল। তুমি কেন খেলতে এসেছ? অথচ এই ফুটবল খেলেই বাবার হাতে এখন নিয়মিত টাকা তুলে দেয় শামসুন্নাহার। বঙ্গমাতা ফুটবলে ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুট জিতেছিল। পরের বছর জেতে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। দুবারই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে নিয়েছিল পুরস্কার ও ৭০ হাজার টাকার চেক। এরপর গত ডিসেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আবারও প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ডেকে নিয়ে সংবর্ধনা দেন। পুরস্কার হিসেবে দেন ১ লাখ টাকা। এই বয়সেই এত এত টাকা উপার্জন করে বাবার হাতে তুলে দিচ্ছে শামসুন্নাহার। অথচ এখনো সংসার চালাতে এলাকায় লরিচালকের কাজ করেন শামসুন্নাহারের বড় ভাই হাদিউল ইসলাম। আরেক ভাই আজহারুল ইসলাম ঢাকায় নির্মাণশ্রমিক। মেয়ে হিসেবে বাবার হাতে টাকা তুলে দিতে পেরে ভীষণ তৃপ্তি শামসুন্নাহারের, খেলে যে টাকা পাই, সেটা বাবার হাতে তুলে দিতে খুব ভালো লাগে। বাবা টাকা দিয়ে একটা গরু কিনেছেন। আর সর্বশেষ পাওয়া টাকাগুলো দিয়ে ব্যাংকে একটা হিসাব খুলে দিয়েছেন। এখন খেলাধুলার জন্য আর বকেন না বাবা। কলসিন্দুর স্কুলের কোচ মফিজুল ইসলামের চোখে দেশের সেরা ফরোয়ার্ড শামসুন্নাহার, ওর ড্রিবলিং, বল নিয়ে মুভমেন্ট এখনো অন্যদের চেয়ে সেরা। ওর মধ্যে যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেটা ওকে আরও অনেক দূরে নিয়ে যাবে। আর বর্তমান জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তো হংকংয়েই প্রমাণ পেয়েছেন শামসুন্নাহারের প্রতিভার। বললেন, ও গত সাফেই দেখিয়েছে কেমন প্রতিভাবান। হংকংয়ে ওর আরও উন্নতি হয়েছে। একজন সেরা ফরোয়ার্ডের যেসব গুণ দরকার, সবই রয়েছে শামসুন্নাহারের মধ্যে। মনের আনন্দেই ফুটবল খেলে শামসুন্নাহার। ৯০ মিনিট প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ায় সারা মাঠ। বর্তমানে জাতীয় দলের আবাসিক ক্যাম্প চলছে বাফুফে ভবনের চারতলায়। সেখানেই রয়েছে শামসুন্নাহার। গভীর রাতে কখনো মাকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দায় এসে তখন উদাস দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের জ্বলজ্বলে তারা দেখে সেটিকেই ভেবে নেয় মায়ের মুখ। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে মহিলা ফুটবলের উজ্জ্বল তারা হতে চায় শামসুন্নাহার। সূত্র: প্রথম আলো এমএ/ ০৮:১১/ ০৭ এপ্রিল
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2Eub8gL
April 08, 2018 at 02:15AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন