পেলের জন্মের পর তার বাবা-মা তার নাম রাখতে চান বিখ্যাত আমেরিকান বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসনের নামে; কিন্তু এডিসন নামের ই বাদ দিয়ে শুধু এডসন রাখেন তারা। এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো নামেই ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠতে থাকেন পেলে। যদিও, তখনও পর্যন্ত তার নাম কিন্তু পেলে ছিল না। পারিবারিকভাবে তার ডাকনাম ছিল ডিকো; কিন্তু যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করলেন এডসন তখন স্কুলের সবাই তাকে পেলে নামেই ডাকা শুরু করে। মূলতঃ তখনকার ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ভাস্কো দা গামার গোলকিপার বিলের নামানুসারেই তার স্কুলের সহপাঠিরা তাকে বিলে ডাকতে শুরু করে। উচ্চারণের তারতম্যের কারণে বিলে শব্দটা হয়ে যায় পেলে। কোনো অর্থবোদক শব্দ না হলেও সবাই তাকে পেলে নামেই ডাকতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো যেদিন তাকে সবাই পেলে নামে ডাকা শুরু করে ওইদিনের পর থেকে পরবর্তী চার মাস এই নামে ডাকার কারণে বেশ কেঁদেছিলেনও তিনি; কিন্তু তখন যদি জানতেন, মাত্র দুঅক্ষরের এই নামটাই ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের নাম হিসেবে উচ্চারিত হবে- তাহলে বোধহয় এভাবে আর কাঁদতেন না ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি। আমার বাবা আমার নাম রেখেছিলেন এডসন, থমাস আলভা এডিসনের নামানুসারে। আমি এটা নিয়ে গর্ববোধ করতাম। আমি কখনো পেলে টাইপের কিছু চাইছিলাম না- মজার ছলে একবার বলছিলেন পেলে। দুই অক্ষরের এই মহাতারকা পরবর্তীতে তিনটি বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করেছেন। পাশাপাশি গোলের পর গোল করে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের খেতাবটাও নিজের করে নিয়েছেন তিনি। আসলে পেলের মাহাত্য লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ফুটবল মাঠে যেসব ফুটবলার তার বিপক্ষে এবং পক্ষে খেলেছেন তারাই বুঝেছেন পেলে কতটা বিধ্বংসী ছিলেন সেই সময়ে। সম্প্রতি ফিফাডটকমকে এক নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সর্বকালের সেরা এই ফুটবলার। যেখানে নিজের কঠোর পরিশ্রম, ফুটবলে আসার শুরুর দিকের নানা চ্যালেঞ্জ, সেরা গোল, ব্রাজিলের বর্তমান সুপারস্টার নেইমার সম্পর্কে নানা কথা বলেছেন তিনি। সেই কথোপকথই জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো এখানে... ফিফা : ৭৭ বছর বয়স আপনার, এখনো আপনার নামের প্রতিশব্দ হিসেবে সবাই বিশ্বকাপ ফুটবলকে জানে। দশকের পর দশক ধরে এই টুর্নামেন্ট আপনার কাছে কী অর্থ বহন করছে, বলতে পারেন? পেলে : আপনি সত্যিই বলেছেন। বিশ্বকাপ নিয়ে আমার অনেক গল্প বলার আছে। আমরা ওই টুর্নামেন্টগুলোতে আমাদের মত করে ছিলাম না; কিন্তু আমরা সবসময়ে সবার উপরেই ছিলাম। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ এখনো আমার জন্য একটি স্বপ্ন। তখন আমি একদমই ছোট এবং কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি আমরা চ্যাম্পিয়ন হবো। তারা ভিসেন্তে ফিওলাকে প্রশ্ন করেছিল, আপনার দলে ১৭ বছরের এক যুবক থাকতে আপনি কেমন করে চিন্তা করেন সুইডেনে বিশ্বকাপ জিতবেন? কিন্তু আমরা পেরেছিলাম। তারপর ১৯৬২ সালে ব্রাজিল দলটা খুব ভালো ছিল। আমি ইনজুরিতে পড়লাম; কিন্তু তারপরেও আমরা বিশ্বকাপ জয় করেছিলাম। ইংল্যান্ডে আমার মেনিসকাস ভেঙ্গে যায় এবং আমরা বাদ পড়ে যাই। কিন্তু ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে আমি প্রত্যেকটি ম্যাচ খেলেছিলাম। এটা আমার জন্য জন্য অনেকটা চক্র পূরণ করার মত। আমি শুরু এবং শেষটা করেছিলাম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। ফিফা : ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে আপনি ডি-বক্সের ভেতর ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে ফ্লিকিংয়ের মাধ্যমে কিংবদন্তিতুল্য এক গোল করেছিলেন। ওই মুহূর্তে আপনার মাথায় প্রথমেই কী কাজ করেছিল? পেলে : আমি আগে থেকেই প্ল্যান করে এমনটা করেছি, এটা বললে মিথ্যা বলা হবে। এটা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই চলে এসেছিল। খেলোয়াড় হিসেবে এটি আমার অন্যতম শক্তি, এজন্য ধন্যবাদ জানাই ঈশ্বরকে। তাৎক্ষণিকভাবে কোনকিছু মাথায় আসলে সেটিকে দ্রুততার সাথে করে ফেলা আমার অন্যতম শক্তি। ওই মুহূর্তে খুব দ্রুত সবকিছু কাজ করছিল। আমি বলটিকে কাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করি এবং দেখি ডিফেন্ডাররা আমার দিকে তেড়ে আসছে। তখনই বলটি মাটিতে পড়ার আগেই ফ্লিক করি ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে। এটা আসলে ঈশ্বর প্রদত্ত। ওই সময়ে এগুলো নিয়ে এতো ভাববার কিছুই ছিল না। ফিফা : একইভাবে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে হেডে করা আপনার ক্ল্যাসিক গোলটির ফিনিশিংও ছিল অসাধারণ...! পেলে : আমরা ট্রেনিং সেশনে এটা অনুশীলন করেছিলাম। যদিও পুরোপুরিভাবে নয়; কিন্তু অবশ্যই আমাদের অবস্থান নির্ণয় নিয়ে কাজ করেছিলাম। আমরা একটি থ্রো-ইন পেয়েছিলাম এবং আমরা জানতাম কী হবে। অন্য খেলোয়াড়দের মত আমরা থ্রো জোরে ছুঁড়ে মারলাম না, সেটিকে আস্তে মেরে আরেক খেলোয়াড়ের কাছে পাঠিয়ে দিলে সে বাঁ পাশ থেকে উড়িয়ে ডান পাশে ডি বক্সের ভেতর ফেলেছিল। আমি ডিফেন্ডারের কিছুটা পেছনে অবস্থান করছিলাম। আমি ও রিভেলিনো গোলের জন্য ডি বক্সে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেটি গোল হয়ে যায় একভাবে; কিন্তু আমরা এটা নিয়ে কাজ করেছিলাম কিছুটা। ফিফা : আপনি হেডের কথা নিজে মনে করতে পারেন? পেলে : অবশ্যই। এটা অনেকটা পরিবারের কাছ থেকে আমি পেয়েছি। আমার বাবা ছিলেন একজন সাবেক ফুটবলার। অসংখ্য গোল তিনি হেড দিয়ে করেছেন। আমি সব সময় চাইতাম তাকে অনুকরণ করতে। আমি অতোটা লম্বা ছিলাম না; কিন্তু আমার পায়ের শক্তি ছিল অনেক। আমার বাবা সব সময় আমাকে বলতেন, বেশিরভাগ খেলোয়াড় বল যখন আসে তখন হেড দেওয়ার আগে চোখ বন্ধ করে রাখে। বল যখন তোমার কাছে আসবে, চোখটাকে বড় করো এবং ঠিক করো কোন জায়গাটাতে তুমি সেটিকে পাঠাবে। আমি প্রতিনিয়ত এটি নিয়ে কাজ করেছি। আমি অসংখ্য গোল করতে সক্ষম হয়েছি এই উপায়ে। চোখটাকে খুলো এবং হেডে বলটিকে জালে পাঠাও। ফিফা : কিন্তু এটা তো সবসময় হতো না, তাই না? মানুষ এখনো আপনার করা হেডে গর্ডন ব্যাংকসের (ইংল্যান্ডের সাবেক গোলকিপার) সেভের কথা বলে! পেলে : অবশ্যই। ওটা অনেকটা একই রকম সুযোগ ছিল। ফিফা : ব্রাজিলের একটা কিংবদন্তি প্রজন্ম ছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। আপনার কী মনে হয় আপনি তাদের থেকে সেরা ছিলেন? পেলে : ব্রাজিলের জন্য তখন আসলেই অসাধারণ একটা সময় ছিল। বিশেষ তরুণ ফুটবলার যেমন গারিঞ্চা, দিদি এবং জিতো ছিল। আমার মনে আছে ভিসেন্তে ফিওলা আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, আমি জানি আমি কী বলতে চাচ্ছি। আমি তোমাদের থেকে বড়, আমি কোচ। একটা জিনিস স্মরণে রাখবে তুমি হচ্ছো বিশ্বসেরা দলের একজন; কিন্তু তোমার সব প্রতিপক্ষকে সম্মান করতে হবে। এক মিনিটের জন্যও প্রকাশ করবে না, যে তুমি জিততে চাও। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে যাবে যেখানে প্রতিপক্ষের সম্মান অর্জন করতে পারো। আমি এখনো সেই কথাগুলো মনে রেখেছি। তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন। ফিফা : চলতি বছরে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের আয়োজন বসছে রাশিয়ায়। আপনার কি মনে হয়, ব্রাজিল এবার বিশ্বকাপ জিততে পারবে? পেলে : ব্রাজিলের প্রত্যেকবারই এমন দল থাকে যারা বিশ্বকাপ জয় করতে পারে; কিন্তু সম্প্রতি টুর্নামেন্টগুলোতে প্রস্তুতির অভাবে সবকিছু ভেস্তে যাচ্ছে। ব্রাজিলের বেশিরভাগ ফুটবলারই এখন ব্রাজিলের বাইরে ফুটবল খেলে থাকে। আমাদের সময়টা ফিরিয়ে আনা এখন কঠিন। আমাদের এখনো সময় আছে। ঠিকভাবে দল গঠন করাটা কোচিংস্টাফদের জন্য আরো দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক কিছুই পরিবর্তিন হচ্ছে। এটা খুব সহজ হবে না বলা যে, এটাই আমার দল। কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই যে ব্রাজিলের খেলোয়াড়রাই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। ফিফা : তারা কি বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম দাবিদার? পেলে : অবশ্যই। যদি ব্রাজিল নিজেদের প্রস্তুত করার পর্যাপ্ত সময় পায় তাহলে তারা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে। ফিফা : অন্য আর কোন দল এই মুহূর্তে আপনার মাথায় আসছে? পেলে : জার্মানিকে সর্বদাই আপনার সম্মান করতে হবে। এমনকি রাশিয়াও ঘরের মাঠে শক্তিশালী দল নিয়ে সবাইকে বিপদে ফেলতে পারে। লাতিন আমেরিকান দিক দিয়ে বলতে গেলে আর্জেন্টিনার সামর্থ্য রয়েছে বিশ্বকাপ জয় করার। ফিফা : নেইমার কি একাই ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে পারবে? পেলে : নেইমারের অবস্থান জাতীয় দলে আসলে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যায়। সে ক্লাব ফুটবলে অনেকটা লেফট অ্যাটাকার হিসেবে খেলে; কিন্তু ব্রাজিল দলে সে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রনে থাকে যা ঐতিহ্যগতভাবে নাম্বার টেনদের কাজ। এটা আসলেই কঠিন কিন্তু সে নিজের খেলার সাথে এটিকে মানিয়ে নিতে পারে। আপনি যদি বিশ্বের অন্য দিকে তাকান তাহলে কারা এখন বিশ্ব রাজত্ব করছে? লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং নেইমার। তারা ছাড়া আর কোন সুপারস্টার নেই। জাতীয় দলের হয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো একটা গ্রুপ হিসেবে গঠিত হওয়া, কারণ এখানে তিন কিংবা চারজন ফুটবলার এক পজিশনের জন্য নেই। এটা জার্মানির জন্যেও প্রযোজ্য যাদের সমষ্টিগত জোর অনেক। আগের দিনে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের উপর অনেক কিছু নির্ভর করতো; কিন্তু এখন সেটি পাল্টে গেছে। বর্তমান সময়ে এটিই স্বাভাবিক। ফিফা : আপনার কী মনে হয় নেইমার এখনই দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মত প্রস্তুত? পেলে : হ্যাঁ, সে প্রস্তুত। ক্লাব থেকে জাতীয় দলে এসে তার নিজের খেলার অবস্থান এবং ধরণের পরিবর্তনগুলো পরিষ্কার না। কিন্তু নেইমার ব্রাজিলের দলের মূল খেলোয়াড়। সে এটার জন্যেই নিজেকে প্রস্তুত করছে। এবং আমি একটু সামনে যেতে যাই, টেকনিক্যালি সে বর্তমান সময়ের সেরা খেলোয়াড়। আমি নির্দ্বিধায় এটি বলতে পারি। সূত্র: জাগোনিউজ২৪ আর/১০:১৪/১৬ মে



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2rOkwaY
May 17, 2018 at 05:25AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top