বিশ্বের অন্যতম আবাসযোগ্য টরন্টো শহরের কথা নয়, পাঠক বন্ধুদের শোনাবো ইট কাঠের এই সুরম্য নগরী থেকে হাজার মাইল দূরের ছোট্ট একটি গ্রামের ছোট্ট একটি মেয়ের গল্প। আর এতো কিছু থাকতে আজ সেই মেয়েটির গল্প কেন? তা নাহয় গল্পের শেষেই বলি? আলোয় ঝকঝকে এই টরন্টো থেকে প্রায় ২৪ ঘন্টা হাওয়ায় উড়ে ঢাকা পৌঁছুবার পর আরো যেতে হবে ৪/৫ ঘন্টার পথ, জেলা শহর মৌলভীবাজার, সেই শহর থেকে আরো ঘন্টা খানেকের পথ পার হলে তবেই দেখা পাবেন মনু নদীর। সেই নদীর কল ঘেঁষে এক গ্রাম। নদীর জলে দাঁপিয়ে বেড়ানো ছোট্ট ছেলেমেয়েদের দলে কিংবা গ্রামের কোনো বড়ই গাছের নিচে জটলা পাকিয়ে বড়ই পেড়ে খাওয়া শিশু কিশোরদের দলটার দিকে একটু তাকান, আমাদের গল্পের মেয়েটিকে ওখানটাতেই পেয়ে যাবেন। জন্মের পর থেকেই বাবাকে সে কাছে পায় বেশ কয় বছর পরপর, তাও মাত্র কয়েকদিনের জন্য। সংসারের একটু স্বাচ্ছন্দের স্বপ্নে তিনি কখনো মধ্যপ্রাচ্যের আগুন তাপে, কখনো স্বপ্নের দেশের হাড় হিম করা শীতে খেটে বেড়াচ্ছেন। তাই মা আর ছোট্ট ভাইটিকে নিয়ে গ্রামের মেঠো পথে ছুটেই গড়িয়ে যেতে থাকে মেয়েটির সময়। দাদির আদর, নানার সোহাগ, চাচাদের প্রশ্রয় আর মায়ের শাসন, এই সব ঘিরে সাধারনের মাঝে অসাধারন এক জীবন। এরপর একদিন......এই সব পেছনে ফেলে মা আর ছোট্ট ভাইটির হাত ধরে সে পাড়ি দেয় সাত সমুদ্র। এসে পৌঁছায় স্বপ্নের নগরী টরোন্টোতে। বাবা যে তার পথ চেয়ে বসে আছেন। এতকাল পর বাবা মা ভাই বোন, চারজন একসাথে হয়ে যেন আসলেই স্বপ্নের জীবনের নাগাল ১১ বছরের ছোট্ট সেই মেয়েটি। এতকালের না পাওয়া বাবার আদরের সবটুকু যেন একসঙ্গেই চাই তার। এর পর থেকে গল্পটা আমাদের আর দশটা অভিবাসী পরিবারের মতোই হবার কথা। পুরো অচেনা দেশ, তার চেয়েও অচেনা ভাষা, আর অচেনা রঙের মানুষ। পুরোদিন অচেনা সেই স্কুলের জগৎ কোনোমতে পার করে দিনের শেষে বাবার কোলের নিরাপত্তায় ফিরে আসার অনুভূতি। এভাবেই চলার কথা। কিন্তু আমাদের মেয়েটির গল্প যে আর দশটি গল্পের মতো হবার নয়! এই জীবনেও আসে ভয়ঙ্কর ঝড়। সেই ঝরে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় কিশোরী মনের সাজানো স্বপ্নগুলো। তুষার ঢাকা শীতের এক সন্ধ্যায় বাবা ফিরছিলেন কাজ থেকে, বাসার একেবারে সামনে এসে যেই রাস্তাটা পেরুতে যাবেন, অমনি কোথা থেকে যেন ধেয়ে আসে একসারি গাড়ি। বরফে ঢাকা রাস্তায় কে কার থেকে বেশি জোরে গাড়ি ছোটাবে এই প্রতিযোগিতায় চালকেরা হয়তো এতটাই মত্ত যে খেয়ালও করলোনা কখন মেয়েটির বাবাকে পিষে ফেলেছে প্রথম গাড়িটা। চাকার নিচে মানুষের শরীর দুমড়ে দেয়ার ঝাকুনি যখন তাদের ছুটে চলা থামালো, ততক্ষনে বাবার মাথা থেকে শুরু করে পুরো শরীরের বেশিরভাগ প্রায় থেঁতলে গেছে। চারিদিকে মানুষ জমে গেলো। ছুটে আশা অ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার ট্রাক এর লাল নীল আলোতে পুরো এলাকা জ্বলজ্বল। জটলার মানুষজন চিনতে চাচ্ছে গাড়ির চাকার নিচে আধা থেতলে যাওয়া মানুষটি কে। ঠিক তখনি রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে মায়ের হাত ধরে হেটে বাড়ি ফিরছিলো আমাদের সেই মেয়েটি। জটলার কিছুটা কাছাকাছি এসে অন্য অনেকের মতোই মা ও একটু উঁকি দিলেন কি হয়েছে দেখার জন্য। মুহূর্তেই তাঁর পৃথিবী দুলে উঠলো। পথের উপরই বসে পড়লেন তিনি। চোখের সামনের সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠলো তার। ...অষ্ফুট শব্দে তিনি শুদু বলতে পারলেন তোর আব্বা!! আর ওই দুটি কথাতেই মেয়েটির সাজানো স্বপ্নগুলো মুহূর্তেই যেন বিবর্ণ হয়ে গেলো। এর পরের কয়েকটি বছর যেন জীবনের সাথে মরণের যুদ্ধ। হাসপাতালে ডাক্তাররা বললেন এই থেঁতলে যাওয়া মানুষটিকে বাঁচানো কঠিন। দলে দলে লোক দেখতে এলেন, মনে মনে হয়তো শেষ বিদায়ও জানিয়ে গেলেন। এভাবেই কয়েকদিন, এরপর শুধু তারা ৩ জন। ১২/১৩ বছরের ছোট্ট সেই মেয়েটি, আরো ছোট্ট তার ভাইটি, আর অভাবিত এই দুর্ভাগ্যের ধাক্কায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় তাদের মা। পুরো দিন তিনি সেইন্ট মাইকেল হাসপাতালে স্বামীর পাশে বসে থাকেন, সন্ধ্যায় ফেরেন। দিনের বেলায় তাই ১২/১৩ বছরের সেই ছোট্ট মেয়েটিই হতে হলো ঘরের কত্রী। নিজের আর ভাইয়ের লিখা পড়া, খাওয়া দাওয়া, দু ভাই বোন হাত ধরে মাথা হেট্ করে চুপচাপ স্কুলের অপরিচিত জগতে টিকে থাকার লড়াই। লড়াই কেন বললাম? একটি ছোট উদাহরণই দেই। ধার্মিক বাবা-মায়ের ইচ্ছায় মাথায় স্কার্ফ পড়তো মেয়েটি। একদিন স্কুলের দুষ্ট ছেলের দল তার স্কার্ফটি টান দিয়ে খুলে নিলো। তা দিয়ে কাপড়ের একটি বল বানিয়ে নিজেরা একজন আরেকজনের দিকে ছুঁড়ে দেয়ার খেলায় মাতলো। ভয়ে আড়ষ্ঠ মেয়েটি এক কোণায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার ছোট্ট ভাইটি সেই ছুঁড়ে দেয়া স্কার্ফের বলটি উদ্ধার করে আনার জন্য ওর পিছু পিছু ছুটছে। দুজনের চোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা, নাকি এ সেই ফেলে আসা মনু নদীর কান্না? দুঃসহ সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সেদিনের সেই ছোট্ট (আর আজকের সফল যুবক) ভাইটির চোখ এখনো কেন নোন হয়ে আসে! গ্রামের সহজ-সরল গৃহবধূ মা ইংরেজি বলতে পারতেননা। হঠাৎ ব্যাংক থেকে টাকা তোলা অথবা হাসপাতালে নার্স এর কথা বোঝা, এ সবে আমাদের সেই ছোট্ট মেয়েটির ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিই ছিল তাদের ভরসা। যাইহোক, কখনো স্কুলের চাপ, কখনো বাবার অনুপস্থিতিতে দিশাহারা, কখনো অজানা এক ভাষায় লিখাপড়া রপ্ত করার প্রানান্ত চেষ্টা, এইসব মিলিয়ে যখনই ভাই-বোনের প্রাণ অস্থির, তখন তাদের আশ্রয় ছিল বাসার আশেপাশের ছোট্ট সব পার্ক গুলো। স্কুল থেকে ফিরে ভাইবোন দুজন সেখানে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাত ধরে বসে থাকতো, মা হাসপাতাল থেকে কখন বাসায় ফিরবেন এই অপেক্ষায়। ইন্সুরেন্স কোম্পানীও জবাব দিয়ে দিয়েছে, নিউ ইমিগ্র্যান্ট বাবার নাকি ফিউচার আর্নিং পোটেনশিয়াল বেশি ছিলোনা, তাই ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা খরচ বাদ দিলে বাড়তি তেমন টাকাও তারা পাবে না। মাস পেরিয়ে বছর গড়ালো। প্রায় আড়াই বছর হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যায় থেকে এরপর বাবাকে পাঠানো হলো পুনর্বাসন পর্যায়ে। জীবন যুদ্ধের এই মোড়ে এসে যেন আমাদের সেই ছোট্ট মেয়েটি হঠাৎ নিজেকে খুঁজে পায়। হয়তো সে বুঝতে পারে যে নিজের থেকে বড় সহায় মানুষের আর কেউ হয়না। তাই সে নিজেই নিজেকে গড়ার যাত্রা শুরু করে। তাকে যে সময়ের চেয়ে দ্রুত বেড়ে উঠতে হবে, তার ভাইটির জন্য, মায়ের জন্য, বাবার জন্য। হেরে যাবার জন্য যে তার জন্ম হয়নি! লিখাপড়ায় আর স্কুলের নানান কর্মকান্ডে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো। লিখাপড়া, খেলাধুলা, স্কুলের নানান ক্লাব এর নেতৃত্ব ইত্যাদি কারণে এক বছরে জিতে নেবার মতো যতগুলো পুরস্কার ছিলো, তার সবই জিতে নিলো। নানান সমাজকল্যান মূলক কর্মকান্ডে অবদানের জন্য সে জিতে নিয়েছিলো প্রাদেশিক সরকারের দেয়া অত্যন্ত সম্মানজনক অন্টারিও ভলান্টিয়ার্ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড। ভালো ফলাফলের কারণে সুযোগ পেলো বিশ্বসেরা ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো সেইন্ট জর্জ এ। নিজে যে কঠিন বাস্তবতা পার করে এসেছে, তার চেয়ে ভালো আর কে জানবে অল্প আয়ের পরিবারগুলোর কষ্ট? ঝাঁপিয়ে পড়লো সে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, টিউশন ফী কমানোর আন্দোলন, ছাত্রদের নিরাপত্তা সহ নানান অধিকার আন্দোলন, সব ক্ষেত্রেই তার সদর্প পদচারণা। সাফল্যের সাথে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পাশাপাশি মেয়ে শিশুদের লিখাপড়ায় ধরে রাখা বিষয়ে গবেষণা করতে ছুটে গেলো তার শেকড়ের কাছে, বাংলাদেশের সিলেটে। সেই গবেষণা প্রকাশিত হলো উনিভার্সিটির জার্নালে। এলো ইংল্যান্ড এর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউ.সি.এল থেকে উচ্চতর শিক্ষার ডাক। সেখান থেকেও সাফল্যের সাথে সে অর্জন করলো মাস্টার্স ডিগ্রী। এরই মধ্যে সে ছুটে গেলো আফ্রিকার ইথিওপিয়ায়, দুঃস্থ মানুষের সেবায়, চাকুরী শুরু করলো পুরো উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রফেশনাল ইউনিয়ন গুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনে রিসার্চ অফিসার হিসাবে। এই টরন্টো শহরের ওয়ার্ডেন উড্স এর মতো বিশাল সমাজ কল্যাণ সংস্থার ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলো, পাশাপাশি কো-চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব নিলো স্বাস্থ খাতে নিবেদিত স্কারবোরো হেলথ কোয়ালিশন এর, বিখ্যাত যুব সংগঠন পাওয়ার ইউনিট ইয়ুথ অর্গানাইজেশন এর প্রথম বাংলাদেশী প্রেসিডেন্ট হলো। জী সম্মানিত পাঠক, এই গল্পের মনু নদীর পারে ছোট্টো সেই মেয়েটিই আমাদের আজকের ডলি বেগম। ৭ ই জুন এর প্রাদেশিক নির্বাচনে একমাত্র বাংলাদেশী-কানাডিয়ান প্রার্থী। মনু নদীর তীরের আমাদের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ নিজের কঠোর পরিশ্রমের জোরে লড়াইয়ে নেমেছে জনপ্রতিনিধি হবার। কোনো ধোঁকাবাজি করে নয়, নোংরা রাজনীতি বা কোনো কূটচালের মাধ্যমে নয়, প্রকৃত জনকল্যাণে কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে প্রমান করেই সে নির্বাচনের মনোনয়ন পেয়েছে। আজ আমাদের সে দাঁড় করিয়েছে আয়নার মুখোমুখি। আমরা সবাই তো কোনো না কোনো ভাবে এই নদী পাড়েরই মানুষ, তাঁর পাশে কি দাঁড়াবো না আমরা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, ব্রম্মপুত্র পাড়ের হাজারো মানুষ ? আমাদের বিভেদে ডুবিয়ে রেখে যারা চিরকাল আপন স্বার্থ সিদ্ধির ফিকিরে থাকে, তাদেরকি আমরা দেখিয়ে দিতে পারবো না যে আমরা সাধারন মানুষেরাও পারি। আমরা কি আমাদের মাঝে বড় হতে থাকা আরো হাজারো ছোট্টো ডলিদের মনে এই বিশ্বাস জোগাতে পারবোনা যে তারা যখন এগিয়ে যাবে, আমরা ভেদাভেদ ভুলে আসলেই তাদের শক্তি জোগাবো? নাকি অভিনব কোনো অজুহাতে আবারো আমাদের মাঝে বিভক্তি ছড়াবে সুযোগ সন্ধানীর দল। ডলি বেগম, তথাকথিত জননেত্রী নয়, সে আমাদের মতোই জীবন যুদ্ধে লড়ে চলা সাধারণ একজন মানুষ, মনু নদীর পাড়ের ছোট্ট সেই মেয়ে, জনকল্যাণে নিজের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে টরন্টোর মূলধারায় কাঁপন ধরানো একনিষ্ঠ এক সমাজকর্মী। তার বিশেষত্ব হয়তো এখানেই যে সে পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব পালনের পরও সমাজকল্যাণে নিয়োজিত ২/৩ টি বিশাল সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে পেরেছে, অনুষ্ঠান সর্বস্য সমাজকর্মী হয়নি। তাই হয়তো সে নেতা হতে চায়নি, হতে চেয়েছে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি, আমাদের মানুষ, আমাদের প্রতিনিধি।



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2LKrZRc
May 30, 2018 at 08:11PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top