ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। নতুন জামা কাপড় পরে এ দিনে সবাই থাকে হাসি খুশি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবাই। ছোট বড় সবাই সাত সকালে গোসল করে নতুন কাপড় পরিধান করে। মনের মত করে সেজে গুজে আতর গোলাব মেখে ঈদের মাঠে যায়। আনন্দ, হাসি, গান, তকবীর ধ্বনী ওদের সবার মনে ধরা দেয়। এই যেমন এক মাস রোজা রাখার পর আসে মুসলিম জাতির সবচেয়ে আনন্দের দিন “ঈদ উল ফিতর“।
২০১৮ সালের এই দিনটি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একই রকম আনন্দ বয়ে আনলেও মুসলিম দুনিয়ার সব দেশে, সব ঘরে দিনটি একই ভাবে উদযাপিত হবে না। যেমন- ফিলিস্তিন, বার্মা, কাশ্মীর, সিরিয়া, মিশর, চীন, ইয়েমেন, চেচনিয়া, রাশিয়া এবং আমাদের প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশ।
আল্লাহর নির্দেশে দীর্ঘ এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যে তাকওয়া ভিত্তিক চরিত্র গঠনের অনুশীলন করে থাকি, তার সমাপনী উৎসব ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত। অতএব এর আনন্দ প্রকাশ করা কতটুকু সম্ভব হবে আল্লাহ ভালো জানেন? দেশের অস্থির এ পরিবেশ বলতে পারছে না দেশের কতভাগ মানুষ সঠিকভাবে এ ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে? দেশের মানুষ আজ স্বাধীনভাবে চলতে পারছে না, রাতে ঠিকমত সেহরী খাওয়াটা সম্ভব হচ্ছে না? এমবস্থায় আমরা আশা করবো এ অবস্থার উন্নতি ঘঠুক, দেশের মানুষ যেন শান্তিতে ঈদের সঠিক আনন্দ উপভোগ করতে পারে এই পরিবেশটা বিরাজ করুক।
নবী-রাসুলদের সুন্নাহ হচ্ছে কারাবরণ। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী হওয়ার কারণে আমাকেও বার বার কারাবারণ করতে হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি যত বাঁধা আসবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা আরো বেশী উজ্জীবিত হবে।
১ম দফা কারাবরণ :-
১২.১২.১২ ঈসায়ী তারিখটি। লাকি বারো, বারো, বারো। সহস্র বছরে মেলে এমন একটি দিন। ধর্মীয় দিক থেকে আমার কাছে এ দিবসের মুল্যে না থাকলেও জীবন ডায়রীতে তা ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে দিবসটি। ১৯৮২ সাল থেকে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ছাত্র আন্দোলন থেকে বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে ৯০ দশকে ৪ ঘন্টার জন্য বন্ধি ছিলাম বিশ্বনাথ থানা হাজতে। অবশ্য পরে সমঝোতার মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জেলে যাবার সুযোগ না হলেও কোন এক রাজনৈতিক ব্যক্তির ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার রোষানলে পড়ে এবং তারই নিদের্শনার আলোকে এ তারিখে প্রথমদফা গ্রেফতার হয়ে জেলে যেত হল। তাই এ দিবসটি অন্যদের মতো আমার জীবন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। বিশ্বের আনাচে-কানাচে সব শ্রেনীর মানুষের কাছেই এই নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর উদযাপনের কমতি ছিল না। এক কথায় নানা আয়োজনে ও উদযাপনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল যেন এই দিনটি নিয়ে। পড়বেই না কেন? আবার যে শত বছর পরে বিশ্ববাসী দেখবে এই দিনটি পাবে এই বিশেষ দিবসটি উদাযপনের উপলক্ষ। তখন আমরা থাকব না। থাকবে না আমাদের প্রজন্ম। এদিক থেকে আমি ও আমার প্রজন্মটি অত্যন্ত ভাগ্যবান বলা চলে। এরপর কত কত প্রজন্ম আসবে যাবে। তারা পাবে না এই বিশেষ দিবসটির দেখা। মোটামুটি কয়েকটি প্রজন্মের পরের কোন এক ভাগ্যবান প্রজন্ম আবার দেখা পাবে এই বিরল দিবসটির। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান জীবিত প্রজন্মটি নিঃসন্দেহে লাকি। আর লাকি বলেই তো বিশ্বব্যাপী মানুষের এত উদ্দিপনা, এত আয়োজন। এই দিনটিতে একটি মানুষের জীবনে যা ঘটেছে, যা যা করছে মানুষটি তাই থাকবে তার স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত।
জেল জীবন :-
বিশ্বনাথ থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর এক করুণ অভিঞ্জতা শুরু হলো আমার জীবনে। মনোকষ্ট ও দৈহিক কষ্ট সাথে সাথে রাজনৈকিত অস্থিরতা ও স্নেহবান্ধব পরিবার-পরিজনকে ফেলে আসার মানসিক কষ্ট সব মিলিয়ে আমার জীবন হয়ে ওঠে দূর্বিসহ। বাড়ীতে, ব্যবস্যা প্রতিষ্টানে, রাস্তায় ও চলা ফেরায় পুলিশের হামলা। নিরাপদ আশ্রয় কোথাও নেই। অতএব জেলখানাকেই আপাতত: নিরাপদ ও জীবন সাথী করে নিয়ে এবং নিজেকে আল্লাহ’র আশ্রয়ে সমর্পণ করে হাজতি ও কয়েদি সাথীদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াতে মনোনিবেশ করলাম। একে একে ছয়টি মাস চলে গেল অনুভব করতে পারি নি। আমি যে ওর্য়াডে (নিউ জেল-৩) থাকতাম তা ছিল সারা জেলের মধ্যে মর্যাদাশালী একটি ওর্য়াড। মেয়ের অভিমান বাবা ছাড়া ঈদ করবে না,,,!
জামিন হয়ে যাবে, হয়ে যাচ্ছে এই অবস্থায় চলে আসলো রমযান মাস। ঈদের প্রায় সপ্তাহ খানেক পূর্বে দেখা করার জন্য জেল গেটে (স্ত্রী, তিন মেয়ে একমাত্র ছেলে ও ভাতিজাসহ পুরো পরিবার। কি এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ ও মান অভিমানের দৃশ্য। আমি কৌশলাদি জেনে সবাইকে স্বাভাবিক রাখার জন্য ঈদের মার্কেটিং করে যাবার জন্য সবাইকে উদ্যেশ্যে করে বলার পর এক পর্যায়ে ২য় মেয়ের (তাসনিমা ইসলাম খান আনিসা) অভিমানী প্রশ্ন ওহ আব্বা! ঈদের আগে আপনি বের হয়ে আসবেন না? আমি সংযত হয়ে খুশির ভান করে বললাম ঢাকায় জামিনের জন্য আমার উকিল চেষ্টা করছেন কিন্তু বিচারকতো জামিন দিচ্ছে না। আমার মেয়ের পাল্টা জবাব আমরার এমপিদাদাও (জাতীয় জনতা পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য এডভোকেট নুরুল ইসলাম খান তিনি আমার চাচা এজন্য এমপিদাদা) তো উকিল, তিনিকে কি বলবো আপনাকে ছাড়ানোর জন্য? আমি অসহায়ের মতো জবাব দিলাম তিনি চেষ্টা করেও পারছেন না। তখন হৃদয়নিংড়ানো আবেগ উজাড় করে আমার মেয়েটি বললো আপনি ঈদের আগে আসবেন না? তাহলে আমরা মার্কেটেও যাবো না? ঈদের কাপড়ও কিনবো না? এবার ঈদও করবো না। এ দৃশ্য দেখে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার প্রথম ও সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান আহমদসহ অনেক পুলিশও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি! আমিতো এর আগে দুইবারে ২৯+১১ দিন এবং এবার সাড়ে পাঁচ মাস জেলে কাটালাম এতো কষ্ট পাইনি। এ ঘটনার পর থেকে প্রতিদিন আমার মেয়ের আবেগ ও অনুভুতির কথাটা মনে হলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারতাম না, আর শুধু একটি চিন্তা বার বার ঘুরপাক খেত আমার কলিজার টুকরাগণ নেতৃবৃন্দসহ জাতীয় ও স্থানীয় হাজারো হাজার নেতা-কর্মী এবং হাজারো হাজারো মানুষের পরিবারের এ কান্না আল্লাহর আরশে আযীম পর্যন্ত কাঁপতেছে নিশ্চয়ই? কিভাবে সারা দেশের নিরিহ-নিরপরাধ মানুষগুলোর পরিবার সহ্য করবে এ যুলুম-নির্যাতন? এর কি কোন শেষ নেই? আল্লাহ তায়া’লা কি মজলুমদের জন্য সাহায্যকারী পাঠাবেন না?
রোযা শুরু হলেই ঈদের আনন্দ আমাদেরকে পেয়ে বসে। সব সময় মনে হয় আর কয়টি দিন পরেই তো ঈদ। পুরো রোযার মাস নিয়ে চলে ঈদের ভাবনা। একটি হলো আনন্দের সাথে রোযা পূর্ণ করা। আর রোযা যে সাফল্যের সাথে আমরা পালন করছি তার স্বীকৃতিস্বরুপ এই ঈদুল ফিতর পালন করা। নতুন জামা-কাপড়, জুতা-মোজা কেনার পরিকল্পনা। ঈদের চাঁদ ওঠার সাথে সাথে সে কি আনন্দ। জেল কর্তৃপক্ষ ঈদকে সামনে রেখে হাজতী ও কয়েদিদেরকে সাময়িক সময়ের জন্য আনন্দ দেয়ার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা করেছে। গোটা জেলকে ঢেলে সাজাচ্ছে এবং আলোক সজ্জা করছে। জেল কর্তৃপক্ষ একটু পরিবর্তন করে ঈদের জামায়াতের জন্য ইমাম নিয়োগ দিলেন সভা করে। আমাদের ভাগ্যে (নিউ জেল-৩ এ) ইমাম হিসেবে নিয়োগ পেলেন ব্যক্তিগত একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিগত কানাইঘাট উপজেলায় পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী জমিয়তনেতা মাওলানা আলীম উদ্দিন। এর আগে তার সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা ছিল না। জানতাম জমিয়তের একজন কর্মী তিনি এতোটুক। সকাল ৯টায় এক সাথে সবকটি ওর্য়াডে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু আমরা যারা জেলের চার দেয়ালে বন্ধি আমাদের আবার কিসের ঈদ? তারপরও মযলুম হিসেবে বাধ্য হৃদয়ের গভীরে শত কষ্ট ভুলার চেষ্ঠার প্রস্তুতি নিয়ে দাড়ালাম ঈদের জামায়াত পড়তে। জামায়াতের পর এমন দৃশ্য প্রত্যাশা কেউই করেনি! ইমাম সাহেব যখন দোয়ার জন্য হাত তুললেন সর্বপ্রথম তিনিই বর্তমান সরকারের যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে উচ্ছ কন্ঠে কান্না করে ফরিয়াদ করলেন। তখন প্রায় দেড় শতাধিক মুসল্লি ছিলেন সবাই উচ্ছ স্বরে কান্না করে বলছে- ওহ আল্লাহ! আমরা নিরাপধ, রাজনৈতিক কারণে আজ আমাদের স্ত্রী, সন্তানাদি, পরিবার-পরিজন, আত্নীয়-স্বজন ছেড়ে চার দেয়ালের ভিতর ঈদ করছি, এ ঈদ আনন্দের নয়, এ ঈদে আমাদের কলিজায় আগুন জ্বলছে, আমরা এ কষ্ট সহ্য করতে পারছি না! আমাদেরকে মুক্ত করো, আমরা জালিমের এ যুলুমের অবসান চাই। বুঝ হওয়ার পর থেকে জীবনে যতটি ঈদ করেছি জামায়াত পরেই ঈদগাহে আনন্দের কোলাকোলি করেছি। কিন্তু এবার সেই জামায়াতের পর ঈদে কোলাকোলি করেছি এমন বুক ফাটা কান্নার মধ্য দিয়ে চোখের পানিয়ে ভিজে গেল সবার ঈদের আনন্দ। এমন এক হৃদয়বিদায়ক পরিবেশে উদ্যাপন করলাম জেলের ভিতর ২০১৫ সালের ঈদুল ফিতর।
লেখক:ফখরুল ইসলাম খান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মাসিক বিশ্বনাথ ডাইজেস্ট, সভাপতি, বিশ্বনাথ কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংসদ।
from সিলেট – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ https://ift.tt/2l1nKok
June 11, 2018 at 02:39AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন