লন্ডন, ১৩ জুন- ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক হারে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা। তবে তারা বাংলাদেশি নয়, বরং ইউরোপীয় ওইসব দেশের নাগরিক হিসেবে থিতু হচ্ছেন যুক্তরাজ্যে। এমন অভিবাসনের পেছনে ওই দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা, কর্মসংস্থান হ্রাসের পাশাপাশি বাংলাদেশিদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণও রয়েছে। বাংলাদেশি কমিউনিটি ছোট ও বিচ্ছিন্ন, দেশীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্নতা, মসজিদ কম ও ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ না থাকা, ইংরেজি ভাষায় আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষালাভের সুযোগ কমমূলত এসব কারণেই যুক্তরাজ্যমুখী হচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয়রা। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে গড়ে উঠেছে বড় একটি বাংলাদেশি কমিউনিটি। রাজধানী লন্ডনের পূর্বপ্রান্তে গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া, যেটিকে বাংলা টাউন বলা হয়। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শক্তিশালী অব্স্থানে রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা। বড় কমিউনিটি থাকার কারণে বাঙালি সংস্কৃতি ও ধর্ম চর্চা, ধর্মীয় শিক্ষালাভ এবং স্বদেশি পরিমণ্ডলের আবহে সন্তানদের লালন পালন ও কাছাকাছি থাকার সুযোগ নিতেই যুক্তরাজ্যে দলে দলে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয়রা। আবার যুক্তরাজ্যে এসেই মিলছে সরকারি সুযোগ সুবিধাও। গত পাঁচ বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি থিতু হয়েছেন যুক্তরাজ্যে। এরমধ্যে কেবল ইতালি থেকেই যুক্তরাজ্যে এসেছেন অন্তত ত্রিশ হাজার। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের অভিবাসন আইনে অব্যাহত পরিবর্তন, শর্তারোপ আর কড়াকড়ির ধারাবাহিকতায় একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসনের গতি অনেকটাই শ্লথ। এছাড়াও ভিসা জটিলতায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্য ছেড়ে এই কয় বছরে বসবাসের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন ফ্রান্স,স্পেনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে সরাসরি অভিবাসনের হার অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে কমেছে। তারপরও তৃতীয় বাংলা খ্যাত যুক্তরাজ্যে গত ৫ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনসংখ্যা। ক্রমশই বড় হচ্ছে বাঙালি কমিউনিটি। এর কারণ হিসেবে ইউরোপ থেকে আসা বাংলাদেশিদের ঢলকেই চিহ্নিত করছেন এখানে থাকা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা। বিষয়টি নিয়ে ইউরোপ থেকে আসা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, ইউরোপের দেশগুলোতে ইংরেজি ভাষার চর্চা কম। আবার একেক প্রদেশে একেক ভাষা, শিক্ষার মাধ্যমও সেই ভাষা। এ কারণে সেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সন্তানদের লেখাপড়া ও উচ্চশিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার উপযোগিতাও যুক্তরাজ্যের তুলনায় কম। এছাড়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার মতো ইউরোপের বহু দেশে মাইলের পর মাইলজুড়ে নেই কোনও মসজিদ। অনেক দেশে বাঙালি ও বাংলাদেশি কমিউনিটিও নেই বললেই চলে। শত মাইলের মধ্যেও নেই কোনও বাংলাদেশি পরিবার। এরসঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক মন্দার মতো বিষয়গুলো। এসব কারণে সন্তানদের লেখাপড়া, ইসলামি শিক্ষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিতে সেসব দেশে স্থায়ী হওয়া বাংলাদেশিরা পাড়ি দিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে। তারা বলছেন, যুক্তরাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের। লন্ডনের প্রায় প্রতি সড়কে মসজিদ থাকায় সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের সুবিধা রয়েছে। বিশাল বাংলাদেশি কমিউনিটি থাকায় সন্তানদের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। নিজেরাও পাচ্ছেন স্বদেশি সামাজিকতার স্বাদ। অনেক আগে থেকে এ ধারা শুরু হলেও গত পাঁচ বছরে অনেকটা হিড়িক পড়েছে ইউরোপীয় পাসপোর্টধারী বাংলাদেশিদের পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর। এতে সামগ্রিকভাবে বিলেতে সংহত হচ্ছে বাংলাদেশি কমিউনিটি। যুক্তরাজ্যের অভিবাসন সংক্রান্ত একাধিক পরিসংখ্যান, গবেষণা প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। ইতালি, পর্তুগাল, স্পেনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে বেকারত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশিরা কাজ হারাচ্ছেন বা পছন্দের কাজ পাচ্ছেন না। সংকটে পড়া দেশগুলোর সরকার কৃচ্ছ্রতা সাধনে বিভিন্ন বেনিফিটও কাটছাঁট করছে। এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় সার্বিকভাবে অনেক ভালো অর্থনৈতিক অবস্থায় রয়েছে যুক্তরাজ্য। এতে গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপ থেকে অভিবাসনের প্রবণতা বাড়ছে ব্যাপক হারে। যা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরাও। কেবল ২০১০ সালেই ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছেন পাঁচ লাখ ৯১ হাজার মানুষ। আর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসেছেন দুই লাখ ২৯ হাজার। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয়। জানা গেছে, দীর্ঘ সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে নাগরিকত্ব পেয়েছেন এমন ইউরোপীয়দের একটি বড় অংশ এখন যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। অস্ট্রিয়া থেকে আসা সুমন আহমেদ এ প্রতিবেদককে জানান, প্রতিবছর প্রায় কয়েক হাজার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাগরিক পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যে আসছেন। তবে তারা কিন্তু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে আসছেন না, আসছেন ইউরোপের নাগরিক হিসেবে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ইতালির নাগরিকত্ব পাওয়া বাঙালিরা সেখান থেকে ব্রিটেনে বেশি সংখ্যায় আসছেন। ইতালি থেকে এসে যুক্তরাজ্যে দুবছর ধরে পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে বসবাস করছেন জসীম আহমদ । নওগাঁর জসীম এখন বসবাস করেন লন্ডনের ফরেস্ট গেট এলাকায়। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, পাঁচ বছর ধরেই মূলত ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব পেয়েছেন এমন লোকজনই যুক্তরাজ্যে আসছেন বেশি। আগেও অনেক ইউরোপীয় সিটিজেন যুক্তরাজ্যে এসে বসবাস করতেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে কেবল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কয়েক হাজার ইউরোপীয় নাগরিক যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এসেছেন। অনেকে সেসব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, নিজেদের ফ্রি হোল্ড ঘরও ছিল। কিন্তু এখানে স্থায়ীভাবে আসার সময় নিজেদের ঘর, ব্যবসা বিক্রি করে একেবারেই চলে আসছেন। সেসব দেশে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে নিজেদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা সুলভমূল্যে বিক্রি করে চলে আসছেন এখানে। নিজেদের সঞ্চিত অর্থ তারা যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগ করছেন ছোট ছোট ব্যবসায়। অনেকে মিনি ক্যাবিং করছেন। যুক্তরাজ্যে ইতালিয়ান বাংলাদেশি, স্পেনের বাংলাদেশিদের আলাদা আলাদা সামাজিক সংগঠনও রয়েছে। তারা এখন এখানকার বাঙালি কমিউনিটির একটি সক্রিয় অংশ। বিলেতের বৈশাখী মেলাসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক আয়োজনেও তাদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশি ইতালিয়ান ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ইউকের সভাপতি সাংবাদিক রেজাউল করিম মৃধা বলেন, গত ৫ বছরে প্রায় ত্রিশ হাজার ইতালীয় বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে এসেছেন। লন্ডনে ইতালীয় কনস্যুলেটের রেজিস্ট্রার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এখানে বসবাস করছেন এমন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইতালীয়ের সংখ্যা প্রায় বিশ হাজার। অনেকে বর্তমান ঠিকানা নথিভুক্ত করেননি এমনও আছেন। স্পেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া থেকেও আসছেন। জানা গেছে, ইতালিতে প্রথম বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব পাওয়া শুরু হয় ১৯৮৭ সালের দিকে। এখন ৩ লাখের বেশি বাংলাদেশি বাস করেন ইতালিতে। অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের অনেকেই অভিবাসীদের স্বপ্নের দেশ যুক্তরাজ্যে আসতে আগ্রহী। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত গৃহিণী বাবলি বেগম বলেন, পর্তুগাল থেকে এসেছেন তিনি। তার মতে, গত কয়েক বছরে যুক্তরাজ্যে এসেছেন ১৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পর্তুগালের নাগরিক। ইতালি ও পর্তুগালের পর যুক্তরাজ্যে আসার ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে আছেন ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভকারী বাংলাদেশিরা। আসছেন অস্ট্রিয়া, ভিয়েনা থেকেও। ইউরোপের এই দেশ থেকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসছেন এমন বাংলাদেশিরা স্কিলড অর্থাৎ দক্ষ এবং পরিশ্রমীকর্মী। তারা মিনি ক্যাবিংসহ এখানে এসে নানা কাজে জড়িয়েছেন। এছাড়া, বড় একটি অংশ কাজ করছেন বিলেতের রেস্টুরেন্টেও। যুক্তরাজ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব দেশের নাগরিকরা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের বেনিফিটসহ সব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যে আসা বাংলাদেশিরা জানান, ইউরোপের অনেক দেশের প্রদেশগুলোর স্কুলে শিক্ষার্থীদের প্রথম শিখতে হয় প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষা। আবার ওই আঞ্চলিক ভাষা সংশ্লিষ্ট প্রদেশের বাইরে অনুপযোগী। ফলে সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আর ইউরোপের অন্যান্য দেশের নাগরিকদের বসবাস এবং কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যমুখী এ অব্যাহত জনস্রোতের কারণে বিলেতের সংকুচিত শ্রমবাজারে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন বাংলাদেশসহ ইউরোপের বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নতুন অভিবাসীরা। কাজের খোঁজে থাকা ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও একটি কাঙ্ক্ষিত চাকরির জন্য অপেক্ষার প্রহর আরও দীর্ঘায়িতি হচ্ছে চাকরির বাজারে। কারণ ইউরোপীয় নাগরিকরা দক্ষকর্মী হিসেবে যুক্তরাজ্যের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, রিটেইল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে নিজেদের জীবিকার পথ খুঁজে নিচ্ছেন। অবশ্য বেশিরভাগ ইউরোপীয় নাগরিক যুক্তরাজ্যে পার্টটাইম কাজের পাশাপাশি নিচ্ছেন জবসিকার অ্যালাউন্সও। যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি ও লেখক আবু মকসুদ, কমিউনিটি নেতা নুরুর রহিম নোমান প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ইউরোপ থেকে আসা বাংলাদেশিদের নিয়ে বিলেতে বাঙালি কমিউনিটি বড় হচ্ছে, সংহত হচ্ছে। আমাদের সন্তানরা বাঙালি সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশি অভিভাবকরা মধ্য বয়সে এসে দেশ ও পেশাও পরিবর্তন করার চ্যালেঞ্জ নিতেও পিছপা হচ্ছেন না। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন আর/১৭:১৪/১৩ জুন



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2JAS8Vq
June 14, 2018 at 01:11AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top