ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন : হয়রানীর শিকার যাত্রীরা
মো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ (সিলেট) প্রতিনিধি :: সিলেট-ছাতক রেলওয়ে সেকশনের খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ স্টেশন পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই তিনটি রেলওয়ে স্টেশন। নিয়ম রক্ষায় ট্রেন যাতায়াত করলেও দীর্ঘদিন যাবৎ খাজাঞ্চীগাঁও ও আফজালাবাদ স্টেশনটি রয়েছে তালাবদ্ধ। এই দুটি ষ্টেশনের জরাজীর্ণ ভবনটি দৃশ্যমান দেখা গেলেও প্রায় ১৫ বছর পূর্বে সৎপুর স্টেশনের পুরো অস্তিতই বিলীন হয়ে যায়। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন। ট্রেনে বখাটেদের উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছেন যাত্রীরা।
এদিকে, ট্রেনের পরিচালক অনিকুর রহমানের বিরুদ্ধে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ও রশিদ ছাড়া ভাড়ার টাকা আদায় সহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, সিলেট হতে ছাতক পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিঃমিঃ দীর্ঘ রেলপথটি আনুমানিক ১৯৫৬ সালে নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ করার পর হতে রেলগাড়ি আপন গতিতে তার যাত্রা শুরু করে। উক্ত লাইনে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ট্রেন যাত্রীদের সেবায় একনিষ্ট ছিল। ট্রেনে প্রায় ৪৫ মিনিটে ছাতক হতে সিলেট পৌছতে পারতেন যাত্রীগন। সিলেট হতে ছাতক পৌছতে ট্রেন পতিমধ্যে তিনটি স্টেশনে (আফজালাবাদ, সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাঁও) যাত্রাবিরতি করে। ছাতক, আফজালাবাদ, সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাঁও উক্ত তিনটি রেলস্টেশনের পাশ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার যাত্রী সিলেট শহরে পৌছতে একসময় এই ট্রেনই ছিল যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। ১৯৮৫ সাল থেকে ওই রেলপথে মন্দাভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন যাত্রা শুরু করে না, যার কারণে যাত্রীসাধারণ সময়মত গন্তব্যে পৌছতে পারেন না।
প্রায় ১৫ বছর পূর্বে সৎপুর রেলওয়ে স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর স্টেশনের মূল্যবান মালামাল অযত্নে ও অবহেলায় নষ্ট হতে থাকে। একপর্যায়ে এই স্টেশনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। দেখলে মনে হয়না একসময়ে এখানে সৎপুর রেলওয়ে স্টেশন ভবন ছিলো। অপর দুটি স্টেশনের (খাজাঞ্চীগাঁও ও আফজালাবাদ) প্লাটফর্ম ও অফিসের অবস্থা বর্তমানে খুবই জরাজীর্ন। এখানে নেই কোন স্টেশন মাষ্টার নেই, কোন টিকেট ব্যবস্থা। এমনকি স্টেশনে কোন কর্মকর্তা কর্মচারীও নেই। তবে প্রতিদিন দুইবার ট্রেন চলাচল করলেও দীর্ঘদিন যাবৎ তালাবদ্ধ রয়েছে এই স্টেশনটি। অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে ভবনটি। ধীরে ধীরে হারাচ্ছে স্টেশনের অস্তিত্ব।
শিল্প নগরী ছাতক থেকে চুনা পাতর, সিমেন্ট, স্লিপার, বালু, বোল্ডার ও ভাঙা পাতর দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয় রেলপথে। বর্তমানে এ লাইনের বেহাল দশা। ঝুঁকিপূর্নভাবে চলাচল করছে ট্রেন। অকেজো স্লিপার, মেয়াদ উর্ত্তীণ বগি, পর্যাপ্ত পাতরের অভাব এবং যথাসময়ে প্রয়োজনীয় মেরামত না করায় এ রোডে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন শুকনো মৌসুমে লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা কম ঘটলেও বর্ষা মৌসুমে অহরহ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। দেশের বেশীরভাগ পাতর স্লীপার ছাতক থেকে সরবরাহ হলেও এ অঞ্চলের রেললাইনে পাতর নেই। যাত্রীসাধারণের যাথায়াতের জন্য ২/৪টি জরাজীর্ণ বগি দেওয়া হয় যাতে বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, ভাঙা সিট, দরজা-জানালা নেই এবং ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। আবার যাত্রীবাহী ট্রেনের সাথে মালবাহী বগি জোড়া দেওয়া হয়। তখন গাড়ী লাইনচ্যুত হয়। দূর্ঘটনায় পতিত হয়। এই লাইনে ট্রেনচালক ঝুঁকি নিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেন চালান। ফলে ট্রেন ৪৫ মিনিটের জায়গায় ২ ঘন্টা সময় লাগে সিলেট থেকে ছাতক পৌছতে। শীত মৌসুমে খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ এলাকা থেকে প্রচুর সবজি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাজারজাত হয়। আর ব্যবসায়ীরা এসব সবজি পরিবহন খরচ কম হওয়ায় রেলপথে বাজারজাত করতেন। কিন্ত অনিয়মিত ট্রেন সার্ভিসের কারনে বাধ্য হয়ে এলাকার ব্যবসায়ীরা সড়ক পথে মালামাল পরিবহন করছেন।
এছাড়া সিলেট রেলস্টেশনের পুরনো প্লাটফর্মে মাদকসেবী ও চিনতাইকারীদের ভয়ে যাত্রীরা নিরাপত্তাহীণতায় ভোগেন। প্রতিদিন ট্রেনে ছাতক, আফজালাবাদ, খাজাঞ্চীগাঁও ও সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে কিছু বখাটে লোক নিয়মিত যাতায়াত করে। যাত্রীবাহী ট্রেনে মহিলাদেরকে সাথে প্রায়ই খারাপ আচরণ করে থাকে এসব বখাটেরা। ফলে রেলওয়েকে নিরাপদ ভ্রমণ মনে করা হলেও সিলেট-ছাতক রেলপথের যাত্রীরা এই রোডকে সব সময় বিপজ্জনক মনে করেন। সিলেট-ছাতক রেলপথকে উন্নত ও যথাসময়ে ট্রেন সার্ভিস চালুর দাবিতে অনেকবার ট্রেন অবরোধ করা হয়েছে। বহুবার রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করলেও কোন ফল আসেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, লোহার স্লিপার ব্যবহার না করায় কাটের স্লিপারগুলোর বেশীরভাগ ভেঙে গেছে। তাই ভাঙা স্লিপার জোড়াতালি দিয়ে কোনো মতে সচর রাখা হয়েছে ট্রেন চলাচল।
সিলেট-ছাতক রেললাইনের অবস্থার উন্নতি, পর্যাপ্ত ওয়াগণ সরবরাহ, বন্ধ স্টেশনগুলি চালু ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে যাত্রীগন সড়ক পথের চেয়ে রেলপথেই যাতায়াত করতে বেশী আগ্রহী হবেন। সরকার এই রেললাইন ও স্টেশনের সংস্কার এবং আধুনিকায়নে এগিয়ে আসলে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, টিক তেমনি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে, এই প্রতিবেদককের সঙ্গে আলপাকালে সিলেট শহরের ব্যবসায়ী বরকত আলী, সামছুল আলম, ছামির আলী ও শামীম আহমদ সহ ট্রেনের বেশ কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে খাজাঞ্চী ও আফজালাবাদ স্টেশনটি বন্ধ রয়েছে। আর সৎপুর স্টেশনের কোন অস্তিত্বই নেই। সিলেট ও ছাতক রেলওয়ে স্টেশন ব্যতিত প্রতিমধ্যে তিনটি স্টেশন (আফজালাবাদ, সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাঁও) তালাবদ্ধ থাকায় যাত্রীরা টিকেট কাটতে পারেন না। তাই যাতায়াতের সুবিধার্থে ও ট্রেন চালু রাখার স্বার্থে যাত্রীরা নিজ নিজ উদ্যোগে সকল যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়ার টাকা উত্তোলন করেন এবং তা ট্রেন পরিচালক (গার্ড) এর কাছে হস্তান্তর করেন। আর এই টাকা আত্মসাৎ করছেন ট্রেন পরিচালক (গার্ড) অনিকুর রহমান। তারা অভিযোগ করে বলেন, আফজালাবাদ, সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাঁও স্টেশন বন্ধ থাকায় টাকার উৎসবে মেতে উঠেন ট্রেন পরিচালক অনিকুর রহমান। তিনি সিলেট ও ছাতক বাজার স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে যাত্রী ও মালবাহী বগিতে উঠে যাত্রীদের টিকেট চেক করেন এবং টিকেট না থাকলে যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া তিনি আদায় করেন। এসময় যাত্রীরা তার কাছে ভাড়া প্রদানের রশিদ চাইলে তিনি রশিদ প্রদান না করে নানান বাহানা করে এড়িয়ে যান এবং যাত্রীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। ছাতক হতে সিলেট স্টেশনে ট্রেনটি প্রবেশের পূর্বে আউটার সিগন্যালের কাছে তিনি ট্রেন থামিয়ে সকল যাত্রীদেরকে নামিয়ে দেন যাতে টাকার হিসেব ও যাত্রীদের সংখ্যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে না আসে। ট্রেন পরিচালক অনিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহন ও তাকে অপসারণের জন্য তারা (যাত্রীগণ) রেলওয়ের সিলেট স্টেশন মাস্টার, জিআরপি থানা ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে বার বার দাবি জানালে এখনো কোন প্রদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি বলে তারা অভিযোগ করেন।
এব্যাপারে অভিযুক্ত অনিকুর রহমানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার কাজী শহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জনবল সংকট থাকায় ওই তিনটি ষ্টেশন (খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফাজালাবাদ) বন্ধ রয়েছে। সরকার চাইলে এসব স্টেশনগুলিতে লোকবল নিয়োগ দিয়ে আবারো কার্যক্রম শুরু করতে পারেন।
ট্রেন পরিচালক (গার্ড) অনিকুর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যাত্রীদের অভিযোগের পর থেকে তাকে (অনিক) সিলেট-ছাতক লাইন থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
from সিলেট – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ https://ift.tt/2lKxKTs
July 02, 2018 at 03:15PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন