ঢাকা, জুলাই- চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৭৭ সালে বসুন্ধরা ছবির মাধ্যমে তার রুপালী পর্দায় অভিষেক। এরপর আর নায়ক কাঞ্চনকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক হিট ছবি দিয়ে দর্শক হৃদয়ে পোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন। অভিনয় দিয়েই একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস, একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি শুধু অভিনেতাই নন, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। সম্প্রতি গুঞ্জন উঠেছে, দাপুটে এই অভিনেতা রাজনীতিতে আসছেন। ব্যক্তি জীবন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, অভিনয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন মুখোমুখি হয়েছেন প্রতিবেদকের। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সীমান্ত বাঁধন চৌধুরী। আপনার চলচ্চিত্রে আসার গল্পটা শুনতে চাই... ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে একটা নাটক করি, সেই নাটকটার প্রধান অতিথি হিসেবে সুভাস দত্ত আসেন। নাটকটি দেখে আমাকে তিনি তার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলেন। পরের দিন সকালে দেখা করার পর তিনি সুসংবাদটা দিলেন, যদি পরিবারের কোনো আপত্তি না থাকে, আমাকে নিয়ে তিনি ছবিতে কাজ করতে চান। ১৯৭৭ সালে ওটাই আমার প্রথম কাজ। আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটির নাম ছিল বসুন্ধরা। এখন ছবিতে আপনাকে কম দেখা যায় কেন? এখন মূলত একজন শিল্পীকে বেইজ করে ছবি হচ্ছে। আমি যখন সুপারস্টার ছিলাম তখন এদেশে বছরে প্রায় ১১০-১২০টা ছবি রিলিজ হতো। এখন হয় ৪০-৪৫টা ছবি। তখন সিনেমা হলের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০, এখন বড়জোর ৩শ সাড়ে ৩শ। কাজেই বুঝতে পারছেন। সিনেমা হলগুলো ভেঙে মার্কেট হয়েছে। সরকারও এসব এখন নজরদারি করে না। সত্যি কথা বলতে, চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতা এদেশে বঙ্গবন্ধু ছাড়া সেই অর্থে আর কেউ করেননি। এর বাইরে অভিনয়ে কেন কম দেখা যায়? এর উত্তরে বলব, এটা প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। অভিনয় জীবনের শুরু থেকেই আমি কখনো কাউকে বলিনি, আমাকে ছবিতে নেন। আপনিও তো ছবি নির্মাণ করেছেন। তাহলে সেই পরিকল্পনাতে কেন ভাটা পড়ল? আমি দুটি ছবি বানিয়েছি। এখন আর সাহস পাই না। কারণ, সিনেমা হল নাই। যা আছে, তার দেড়শ হল কন্ট্রোল করেন আজিজ সাহেবরা, মানে জাজ মাল্টি মিডিয়া। এখন ছবি বানালে আজিজ সাহেবদের অনুরোধ করে রিলিজ দিতে হবে, সেটি আমি পারব না। তবে খুব করে ফিল করি, সিনেমা বানাতে পারলে শিল্পটার জন্য ভালো হতো। সুপারস্টার কাঞ্চন, এখন কি মনে পড়ে কোন ছবিগুলো আপনাকে এই খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল? বসুন্ধরা প্রথম এবং সাহিত্য নির্ভর ছবি। পরিচিতি আনার ক্ষেত্রে এটার অবদান অনেক। এরপর সুপার-ডুপার ছিল আঁখি মিলন, ছবির আমার গরুর গাড়িতে, বউ সাজিয়ে গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এরপর ভেজাচোখ ছবির জীবনের গল্প, আছে বাকি অল্প গানটিও আমাকে দর্শকের মনে অন্যভাবে ঠাঁই করে দিয়েছিল। এরপর মাটির কসম, নীতিবান, সহযাত্রী, প্রেমপ্রতিজ্ঞা, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, গাড়িয়াল ভাই, বাঁচার লড়াই, খুনি আসামি এমন অসংখ্য ছবি করেছি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শাস্তি আর শরৎচন্দ্রের পরিণীতায় অভিনয় করে পুরস্কৃত হয়েছি। এদিক দিয়ে আমি সত্যিই ভাগ্যবান। আপনি ঠিক কতগুলো ছবিতে অভিনয় করেছেন? সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে সাড়ে তিনশ বেশিই হবে। নিরাপদ সড়ক চাই বা নিসচা কেমন চলছে? এটাই এখন আমার প্রধান কাজ। এই তো সকালেও রাজশাহী থেকে এলাম। প্রথমে ভৈরবে গিয়ে সেখানে ২০০ জন গাড়িচালককে মোটিভেশনাল ট্রেনিং করালাম। এরপর ওখান থেকে গেলাম শ্রীমঙ্গলে, সেখানে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম করলাম। তাদের উদ্দেশে বলার ছিল, খালি চালকদের দোষ, গাড়ির দোষ, রাস্তার দোষ তাহলে তোমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? তোমার নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য পথচারী হিসেবে তোমার দায়িত্ব নেই? পথচারী হিসেবে নিজে যে ভুলগুলো কর, তা কখনো দেখতে চাও না। শুধু অন্যের দোষ দেখ। এসব নিয়ে সচেতন করার চেষ্টা করছি আরকি! নিসচার বয়স কিন্তু বেশ। এই আন্দোলনের সফলতা কতটুকু? এটিকে গভীরভাবে দেখতে হবে। ২৫ বছর আগে আমি এই আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তখন দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১০ থেকে ১১ কোটি। এখন জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। যদি দুর্ঘটনা বাড়তো তাহলে মানুষের তুলনায় এটা ডাবল হতো। সেটা হয় নাই, বরং আমার স্ত্রী যখন মারা যায়, তখন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ৫ হাজারের উপরে ছিল বছরে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু। আর বেসরকারিভাবে রিপোর্ট পেয়েছিলাম মৃত্যু ১০-১৫ হাজারের মতো। এই আন্দোলন যখন শুরু করলাম, প্রথম দিকে কোনো সফলতা পাইইনি বরং অনেকে আমাদের গালাগালি করতেন। কেউ বলতেন, মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কাজ করছি, আল্লাহর মাল আল্লাহ নেয় এমন নানা কথা। এখন কিন্তু মানুষ এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন সবাই বোঝে, দুর্ঘটনা কারও না কারও গাফিলতির জন্য, অনিয়মের জন্য ঘটছে। এটা শুধু নিয়তির বিষয় না। আমরা এই সচেতনতাকে আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সফলতা মনে করি। সমাজসেবায় জড়িত আছেন। আপনাকে ঘিরে রাজনীতির গুঞ্জনও ছড়িয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করবেন... আমি এখন যেটা নিয়ে কাজ করছি, সেখানে আমার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা মনে করেন, আমি যদি রাজনীতিতে আসি, তাহলে তাদের জন্য অনেক কিছু করতে পারব। কিন্তু, বাংলাদেশের রাজনীতির যে ধারা সেখানে একজন এমপি হয়ে কিছুই করার নাই। এমনকি ছোটখাটো একজন মন্ত্রী হয়েও কিছু করার থাকে না। দলের অনুগত হয়েই থাকতে হয়। যেমন: সোহেল তাজের মতো একজন ভালো মানুষও কিন্তু টিকতে পারলেন না। রাজনীতির এমন ধারা থাকলে অপমানিত হতে হয়। তো এই ধারা যতদিন থাকবে, ততদিন আসলে আমার রাজনীতি করার ইচ্ছে নেই। শোনা তো যাচ্ছে আপনি নির্বাচন করতে যাচ্ছেন? না, না, এসব সত্য নয়। আমার কাছে মানুষের যেমন প্রত্যাশা, তেমনি আমিও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার মতো যদি পরিস্থিতি কখনো পাই, তখন ভেবে দেখব। আমার নিজের জন্য কিছুর দরকার নেই, আমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি বেঁচে থাকার জন্য দুটো খেতে পারলেই হলো। মানুষের জন্য কাজ করার সে রকম কোনো সুযোগ যদি আসে, পার্টির প্রধানরা যদি কখনো বলেন, আপনাকে এটার দায়িত্ব নিতে হবে, তখন ভেবে দেখা যেতে পারে। এদেশের মানুষ আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, সেটা একজন এমপি হয়ে আমি নষ্ট করতে চাই না। বর্ণাঢ্যময় অভিনয় জীবনে কোনো অতৃপ্তি কি মনে পড়ে? বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন যেখানে অবস্থান করছে, এমন সময়ে অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমি যখন পরিপূর্ণতা অর্জন করেছি, ঠিক সে সময়ে অভিনয় থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে, এটাকেই আমার অতৃপ্তি মনে হয়। এর বাইরে আমার আর অন্য কোনো চাওয়া-পাওয়া বলে কিছু নেই। সূত্র: পরিবর্তন আর/১০:১৪/২২ জুলাই



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2NASubZ
July 23, 2018 at 05:06AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top