আজ ৮৯ বছরে পা রেখেছেন লতা মঙ্গেশকর। কিন্তু আজও তাঁর গায়কিতে অষ্টাদশীর তারুণ্য। আজও তাঁর সুরের জাদুতে মোহিত বিশ্ব। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো গানটি শুনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর দুই চোখ জলে ভরে উঠেছিল। পাতিয়ালা ঘরানার কিংবদন্তি শিল্পী শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ বলেছিলেন, লতা যখন কথা বলেন, তাতেও সুর ঝরে পড়ে। ভারতের সংগীত দুনিয়া দেবী সরস্বতী রূপে তাঁর বন্দনা করেন। লতা মঙ্গেশকরের দীর্ঘ এই সংগীত সফরের সঙ্গী হয়ে আছেন অনেক সংগীত ব্যক্তিত্ব। আজ দেবী বন্দনায় সংগীত জগতের কিছু ব্যক্তিত্বের কথা তুলে ধরা হলো এখানে। প্যায়ারেলাল (সংগীত পরিচালক) লতাজি, মুকেশজিতাঁদের প্রসঙ্গে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আর সত্যি বলতে, তাঁদের মতো ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে কিছু বলার জন্য নিজেকে অত্যন্ত ছোট বলে মনে হয়। লতাজিকে আমি দিদি বলে সম্বোধন করি। তিনি আমার বড় দিদির মতো। তাঁর কাছ থেকে প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন। লতাদি অনেক বিষয় আমাকে পরামর্শ দেন। সংগীতের বাইরেও আমাদের সম্পর্ক আছে। আমাদের কাছে তিনি সরস্বতী মা। লতাদি হলেন ভারতীয় সংগীতের দুনিয়ার সূর্য। আর আমরা তাঁর ছায়ায় বাস করি। সত্যি বলতে লতাদির সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। তাঁকে ঘিরে প্রচুর স্মৃতি আছে। কিন্তু কথাগুলো আমি সবাইকে বলতে চাই না। কারণ এই স্মৃতিগুলো একান্তই আমার। লতাদির জন্মদিনে তাঁর জন্য শুভকামনা জানাই। প্রতিবছর জন্মদিনে তাঁর বাড়ি যাই। এবারও যাব। খৈয়াম (সংগীত পরিচালক) কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক মাস্টার গুলাম হায়দারের মাধ্যমে লতাজির গায়কির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। নতুন প্রতিভাদের খুঁজে বের করার জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর সুনাম ছিল। মাস্টারজি বোম্বে টকিজের ছবি মজবুর-এর সংগীত পরিচালক ছিলেন। তিনি লতাজিকে এই ছবিতে নায়িকার কণ্ঠে গান গাওয়ার সুযোগ দেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেকের খুব কৌতূহল ছিল মাস্টারজির নতুন প্রতিভাকে ঘিরে। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তাই আমি এবং আমার সঙ্গী রেহমান ভর্মা বোম্বে টকিজে হাজির হয়েছিলাম মাস্টারজির নতুন প্রতিভার গান শুনতে। মাস্টারজিকে জিজ্ঞেস করি, লতাজির গান শোনা যাবে কি না। তিনি তখন থিয়েটারের কর্মকর্তাদের লতাজির গাওয়া পিয়া মিলনে কো আয়া, দিল মেরা থোড়া গান দুটি চালাতে বলেন। আমি লতাজির মিষ্টি এবং অভিব্যক্তিতে ভরা গায়কি শুনে মুগ্ধ হয়ে যাই। আমাকে মাস্টারজি বলেছিলেন, এই মেয়েটির গানে এমন জাদু আছে, একদিন আকাশ ছোঁবে। মাস্টারজির কথা পরে সত্যি হয়েছে। আজ তাঁকে দেবী সরস্বতী রূপে পূজা করা হয়। আমি লতাজির সঙ্গে প্রথম প্যায়ার কি বাতেঁ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাই। তিনি এই ছবিতে আমার পরিচালিত দুটি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এরপর আমার কম্পোজে লতাজির প্রচুর হিট গান আছে। আজ লতাজির জন্মদিনে তাঁকে অনেক শুভেচ্ছা জানাই। যতীন পণ্ডিত (সংগীত পরিচালক) লতাজি আমার কাছে মায়ের মতো। যদিও আমি তাঁকে লতাদি বলে ডাকি। দেব আনন্দ সাহেবের সঙ্গে লতাদির চমৎকার সম্পর্ক ছিল। দেব আনন্দ সাহেবের গ্যাংস্টার ছবিতে আমি সংগীত পরিচালনা করেছিলাম। এই ছবিতে আমি প্রথম লতাদির সঙ্গে কাজ করি। এরপর দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে, কুছ কুছ হোতা হ্যায় ছবিতে তিনি আমার পরিচালনায় গান করেন। লতাজি সব সময় রিহার্সাল করে রেকর্ডিংয়ে আসতেন। কখনো তাঁকে রিহার্সাল ছাড়া রেকর্ডিংয়ে আসতে দেখিনি। লতাদির গম্ভীর ব্যক্তিত্বের আড়ালে এক মজার মানুষ লুকিয়ে আছে। তিনি একবার সহজ হয়ে গেলে খুব হাসি মজা করতেন। কাজের ফাঁকে আমাদের নানা জোকস শোনাতেন। রেকর্ডিংয়ের সময় লতাদির মুখে সুপারি রাখতেন। গান গাওয়া হয়ে গেলে সুপারিটা ফেলে দিতেন। তিনি আমাদের মতো তরুণ সংগীত পরিচালক এবং গায়কদের অনেক উৎসাহ দিতেন। তাঁর কাছে সংগীতের অনেক কিছু শিখেছি। অনেক সময় লতাদি সুরের একটু পরিবর্তন করতেন। আর তখন সেটা অন্য মাত্রা পেয়ে যেত। লতাদি আমাদের (যতীন-ললিত) সুর খুব পছন্দ করতেন। তাঁর জীবনের ওপর লেখা একটি বই আমাকে কিছুদিন আগে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। বইটিতে তাঁর হাতের লেখা আছে। এই বইয়ের মূল্য আমার কাছে অনেক। দেশে থাকলে আমি লতাদির জন্মদিনে প্রভুকুঞ্জে যাই। এবারও গিয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসব। লতাদি শুধু সংগীতের দেবী নন, মানুষ হিসেবেও মহান। উদিত নারায়ণ (গায়ক) লতাদির প্রসঙ্গ আসতেই আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সাধারণ চাষি পরিবারের ছেলে আমি। মুম্বাই থেকে অনেক অনেক দূরে বিহারের একটি গ্রামে বসে রেডিওতে লতাজি, কিশোর কুমার, রফিতাঁদের গান শুনতাম। তাই লতাদির সঙ্গে গান গাওয়া আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। তাঁর সঙ্গে এতগুলো গান গাওয়ার পর মনে হয়, আজও স্বপ্ন দেখছি। প্রথম তাঁকে একটা অনুষ্ঠানে দেখি। আমি লতাদিকে প্রণাম করে তাঁর একটা ছবিতে অটোগ্রাফ নিই। সেই অটোগ্রাফ আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। পঞ্চমদার (রাহুল দেববর্মন) সুরে বড়ে দিলওয়ালা ছবিতে লতাদির সঙ্গে প্রথম দু-তিন লাইন গাওয়ার সুযোগ পাই। বাকি গানটা গেয়েছিলেন সোনু নিগম। এরপর দিদির সঙ্গে ডর, দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে, বীর-জারাসহ আরও ছবিতে প্রচুর গান গেয়েছি। সেসব হিট হয়েছে। লতাদি আমার কণ্ঠ খুব পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, আমার কণ্ঠ খুব অরিজিনাল এবং সুরেলা। ধীরে ধীরে আমার সঙ্গে লতাদির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি আমার সঙ্গে খুব মজা করতেন। আর লতাদি জোকস বলতে খুব ভালোবাসেন। আসলে তিনি খুব আমুদে মানুষ। লতাদির আর একটা দিক হলো, তিনি অসম্ভব ভোজনরসিক। ডিডিএলজি এবং বীর-জারা ছবির রেকর্ডিংয়ের সময় দিদি যশজিকে (চোপড়া) বলতেন ভালো খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত করতে। যশজি পাঁচ তারকা হোটেল থেকে লতাদিসহ আমাদের সবার জন্য খাবার আনাতেন। একবার তিনি আমার বাড়িতে হঠাৎ চলে আসেন। লতাদি আমাদের বাড়িতে এসে বলেন, ভালো করে দার্জিলিং চা বানাতে এবং ভালো জলখাবারের আয়োজন করতে। টানা চার ঘণ্টা আমার বাড়িতে বসে আড্ডা দেন। এটা আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। আমাদের মতো তরুণ গায়কদের দিদি সব সময় সাহস জোগাতেন। একবার কলকাতায় একটা শো ছিল। আর সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। লতাদি মঞ্চে এক লাখেরও বেশি দর্শকের সামনে আমাকে একটা সোনার চেইন উপহার দেন। আট বছর আগেও জন্মদিনে তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। আমিও প্রতিবছর লতাদির জন্মদিনে তাঁকে ফোন করি। আজ লতাদির মতো দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ আছে বলেই আমি এতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছি। সংগীতের প্রতি দিদির এতটাই ভালোবাসা যে বিয়ের বন্ধনে তিনি বাঁধা পড়েননি। তথ্যসূত্র: প্রথম আলো এনওবি/১৫:৩৫/২৮ সেপ্টেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2OWQgoH
September 28, 2018 at 09:38PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন