কলকাতা, ২২ অক্টোবর- উৎসবের সঙ্গে অন্তহীন অন্তরঙ্গতায় তিনদিন আগের শহর তখন জড়িয়ে ফেলেছিল নিজের শরীর। যান চলাচল, একটি হাত ধরে অনেকটা হাঁটা, একা নৌকার যাত্রীর মতো বিড়বিড় করতে করতে জলের দিকে তাকানো- সব দৃশ্যই উপস্থিত ছিল তাতে। এমন সময়ই খবরটা এলো। রক সঙ্গীতের অনন্ত আকাশে আলোর অপেরা মঞ্চস্থ করে চলেছিলেন যিনি দশকের পর দশক ধরে, সেই আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। উৎসবের শহরে বড় তাড়াতাড়ি নেমে এসেছিল সন্ধ্যা সেদিন। বড় তাড়াতাড়ি নেমে এসেছিল অগ্রহায়ণ বা পৌষের কোনো আঁধার হিমের রাত। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বিদেশের এক শহরের রাতে বসেই শোকস্তব্ধ অবস্থায় তাকে স্মরণ করলেন রক সঙ্গীতের নক্ষত্রপথটিতে তার সহ-পথিক রূপম ইসলাম। তার বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুদৃশ্যটিকে সঙ্গে নিয়ে একাকী কোনও মহাস্তব্ধ বন্দরে দাঁড়িয়ে কুয়াশা বাঁশিই বাজালেন যেন। যার সুরটি শুনতে শুনতে মনে হয়, হৃদযন্ত্রটি থেমে গেলেও কোথাও হৃদয় থেকে যায় তবু... মন বলে, ওই আমাদের গিটার...। এনডিটিভির হয়ে রূপম ইসলামের সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য। প্রশ্ন: গিটারটি অসামান্য বাজাতেন তিনি। আসলে গিটারের তার ছিল যেন তার আলোর সিঁড়ি ধরে হাত ধরে নেমে আসা সখ্য। তার গিটারটিকে যদি আজ কিছু বলতে হয়, তবে, রূপম ইসলাম কী বলবেন? রূপম ইসলাম: এই মুহূর্তে আমি অত্যন্ত শোকস্তব্ধ। আইয়ুব বাচ্চুর গিটারকে উদ্দেশ্য করে হয়তো আমি কিছুই বলব না। শুধু স্মরণ করব কিছু সোনালি মুহূর্ত। আমি ছিলাম এই মানুষটির বিশেষ স্নেহধন্য। তিনি বারবার আমাকে স্মরণ করেছেন, ডেকে পাঠিয়েছেন এক অনন্য অধিকারে। এই একই অধিকারে আমাদের কনসার্টের মধ্যেও মঞ্চে উঠে এসেছিলেন তিনি একটিবার। তারপর বাইসাইকেল চোর-এ তার সঙ্গত, বিষাক্ত মানুষ গানে তার সঙ্গত... মনে পড়ছে পুরোটাই। আমার অনুষ্ঠানে শৈশব থেকেই তার গান আমি গেয়ে আসছি মঞ্চে। একটা সময় এমনও ব্যাপার ছিল, এখানকার বহু শ্রোতা, যারা সেই তুমি তখনো শোনেননি, তারা আমার মাধ্যমে প্রথম শোনেন গানটি। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আমি বাংলাদেশের গানবাজনা নিয়ে লিখতাম। সেখানে বারবার উঠে আসত আইয়ুব বাচ্চুর কথা। উঠে আসত সমসাময়িক আরও অনেকের কথাও। কিন্তু সেখানে আয়ুব বাচ্চু এবং এলআরবি সবসময়ই একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে ছিল। তার অ্যালবামগুলোতে অদ্ভূত চমকপ্রদ কিছু এক্সপেরিমেন্ট ছিল, যা মন কেড়ে নিয়েছিল আমার। সেই যুগের বিচারে প্রোডাকশন কোয়ালিটিও ছিল অনবদ্য। বিশেষ একটি অ্যালবামের কথা আমি বলব এই প্রসঙ্গে, তার নাম- আমাদের বিস্ময়। আমাদের একটা অ্যালবাম, বিস্ময় একটা অ্যালবাম। ডাবল অ্যালবাম। এমনভাবে যে একটি অ্যালবামের নামকরণ করা যেতে পারে... মনকে অন্যভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। গানের বিষয় নির্বাচনেও ওই অ্যালবামটি ছিল অনন্য। উনি আমাকে একটি অ্যালবাম উপহার দিয়েছিলেন। সেটার নাম- মন চাইলে মন পাবে। সেই অ্যালবামটির মধ্যে একটি চিরকুটে তিনি আমাকে নম্বর লিখে দিয়েছিলেন। এটা সেই যুগের কথা, যখন মোবাইল অতি-ব্যবহৃত বস্তু হয়ে পড়েনি। তখন নম্বরগুলো মানুষ মানুষকে লিখে দিত। উনি লিখে দিয়েছিলেন নিজের হাতে। যখনই কলকাতায় আসতেন, উনি ডেকে পাঠাতেন। শেষবার উনি যখন কলকাতায় আসেন, আমার বাড়িতেও এসেছিলেন। ওই সময় আবার তার গিটারের সঙ্গে আমি সঙ্গত করার সুযোগ পাই। চাঁদনীতে উন্মাদ বাজিয়েছিলেন তিনি...এক শান্ত নদীর কথা ভাবো যে চাইছে তোমার চুম্বন, এক তপস্যার কথা ভাবো যে চাইছে গহন তপবন...আরও কয়েকটি গানও বাজিয়েছিলেন উনি। আমিও সেদিন বাজিয়েছিলাম তার কয়েকটি গান। একসঙ্গে গেয়েও ছিলাম সেদিন আমরা দুজনে। এই সুযোগ বোধহয় খুব বেশি মানুষের হয় না। এর ঠিক কিছুদিন আগে কলকাতায় আইয়ুব বাচ্চু একটি সম্মাননা পেয়েছিলেন। যা আমি তার হাতে তুলে দিই। নজরুল মঞ্চে দাঁড়িয়ে উনি বলেন, রূপমকে গাইতে হবে। আমি বাজাব। উনি গিটারটা প্লাগ-ইন করলেন...পুরোটাই কিন্তু অনুশীলন ছাড়া...উনি বাজাতে আরম্ভ করলেন, আমাকে গাইতে হল- সেই তুমি...সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে...এই বঙ্গে এই গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়। বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় তার রূপালি গিটার গানটি...এই রূপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে, সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে...সেদিন সত্যিই এলো...কেউ অশ্রুগোপন করে রাখছেন, কারও বা চোখ সজল। প্রশ্ন: আইয়ুব বাচ্চুর গানের মধ্য দিয়ে জীবনের অদেখা ঝলকানিটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে। গানের সুর, কথা, গায়কী এবং উপস্থাপনা - সবই যার অংশ। এই একই জিনিস দেখা যায় আপনার ক্ষেত্রেও। কখনও মনে হয়েছে, অমুক জায়গাটা আমি যদি ওর থেকে আরও ভালো করতে পারতাম? রূপম ইসলাম: এই প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে আমি আরেকটি অ্যালবামের কথা স্মরণ করতে চাইছি। সেটাও আরেকটি ইউনিক অ্যালবাম। এলআরবি আনপ্লাগড অ্যালবাম। লাইভ রেকর্ডিং হয়েছিল। ফেরারী মন। সেখানে ডিসটর্শন গিটারের শব্দবাহুল্য ছিল না। অ্যাকোস্টিক গিটার ছিল। আর ছিল একটি বেহালা। যতদূর মনে পড়ে, বেহালা বাজিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত যন্ত্রী সুনীল দাস। এছাড়া এলআরবি ছিল। সেদিন আমার বাড়িতে উনি যখন এসেছিলেন, আমরা ওই অ্যালবামের একটি গান গেয়েছিলাম একসঙ্গে। এখন অনেক রাত...এখন অনেক রাত, খোলা আকাশের নিচে, জীবনের অনেক আয়োজন, তাই আমি বসে আছি, দরজার ওপাশে...যেটা বলার, তা হল, শুধু গিটার বাদনই নয়, তার কণ্ঠস্বর এবং তার গায়কী, এই দুটিতেই ছিল একটি ভরাট ব্যাপার...তিনি আমার খুব প্রিয় গায়ক। আমিও ছিলাম ওর খুব প্রিয় গায়ক... আমার প্রথম অ্যালবাম যখন বের হয়... তোর ভরসাতে...সেই অ্যালবাম থেকে একটি গান নীল রঙ ছিল ভীষণ প্রিয় কিন্তু বাংলাদেশে আগে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট চ্যানেলের একটি নাটকে এই গানটি ব্যবহৃত হয়। ওই নাটকে আইয়ুব বাচ্চুর একটি গান ছিল। এবং আরেকজন শিল্পীর আরেকটি গান ছিল। পরিচালনা করেছিল রিঙ্গো। আইয়ুব বাচ্চু ওই সময় থেকেই আমার গান এবং আমার গায়কী পছন্দ করতে আরম্ভ করেন। তিনি আমার প্রেজেন্টেশন বারবার দেখেছেন। আমার তৈরি হওয়ার সময় দেখেছেন। আমি যখন প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছি, তখনও দেখেছেন। বারবার বলেছেন, এভাবেই আসবে বাংলায় রক। এই প্রেজেন্টেশনটাই চাই। এর মাধ্যমেই তুই আনতে পারবি বাংলায় রক। বলেছিলেন তিনি। ওর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি। সেই সাক্ষাৎকারের অনেক জায়গা ছাপানো যায়নি। কারণ, এত মুক্তকন্ঠে তিনি আমার প্রশংসা করছিলেন সেখানে, তা ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে আমার পক্ষে প্রকাশ করাটা বিড়ম্বনার। আমি যেমন খুব স্বাভাবিক কারণে ওর মুগ্ধ শ্রোতা, উনিও তেমন ছিলেন আমার গানের এবং আমার উপস্থাপনার এক মুগ্ধ শ্রোতা ও দর্শক। আমার কাজ নিয়ে খোঁজখবর রাখতেন এবং পছন্দ করতেন। প্রশ্ন: আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থাটা। তাই একটু বিব্রতও বোধ করছি। চাইছি না মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে। রূপম ইসলাম: বিব্রত হোয়ো না। প্রশ্ন করো। প্রশ্ন: উনি আপনাকে নিজের ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। শুধু স্নেহই করতেন না, আপনি যে এপার বাংলায় রকসঙ্গীতকে একটি বাগান তৈরি করার মতো বুঁদ হয়ে বানাবেন, তাও তিনি বলেছিলেন অনেক আগে... রূপম ইসলাম: এই প্রশ্নের উত্তরে বলি, যেভাবে তুমি কথাটা বললে, তা খুব ফরম্যাল শোনাচ্ছে। আমাদের সম্পর্কটা খুব স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়েছিল। অনুষ্ঠান করে এসে উনি নিজের গেস্ট হাউজের সামনের ফুটপাতের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ওর সঙ্গে গিয়ে কথা বলি। আলাপ করি। কী ধরনের গান আমি করি, তা ওকে জানাই। উনি আমাকে ওর গেস্ট হাউজের ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি দুটি কথা বলব এই প্রসঙ্গে। ওভার কনফিডেন্স নয়, তবে কনফিডেন্স আমার ছিল। একটা প্রত্যয় ছিল। কী করতে চলেছি, তা নিয়ে। বোধের দিক থেকে বোধহয় একটা পরিণত মানসিকতা ছিল, যা বোঝা যেত। আর দ্বিতীয়টি হল, সারল্য ছিল। বেড়েপাকা ছিলাম না আমি। নেয়ার ক্ষমতা ছিল। ছিল কনসেনট্রেট করার ক্ষমতা। আর ছিল, প্রশ্ন করা6র ক্ষমতা। কাউকে দিয়ে কিছু বলিয়ে নেয়ার ক্ষমতা। সেই জায়গায় তাকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতা, যাতে তিনি কিছু বলেন। হয়তো এটুকুই ছিল আমার, যার জেরে, আমি এলআরবির অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলাম। ঢুকে গেল একেবারে নবীন এক শিল্পী। সেখানে তারা অন্দরমহলের পোশাকে একদম ঘরোয়া সাজে রুটি-মাংস খাচ্ছেন, অমন একটি মুহূর্তে আমি তাদের অংশ হয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমশ। ওই সময় আমার কাছে আমার গিটারটি ছিল। আর ছিল আমার গান। সেই গান শুনে ওই দিনেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই গান কোন পথ ধরে এগোবে। আজকে বাংলা রক মিউজিককে চিনি যে বৈশিষ্ট্যগুলির মাধ্যমে, সেখানে কিন্তু প্রত্যয় শব্দটা রয়েছে। রয়েছে সারল্য শব্দটাও। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিজ্ঞতা। আসলে রক মিউজিকের যে প্যাশন, তা আসে নতুনের আবাহন ও উদ্দীপনা থেকে। নতুনের তৈরি হওয়ার যে তাড়না, আইয়ুব বাচ্চুর মতো গুণী শিল্পীরা বা জহুরিরা তা বুঝতে পারেন। মেনে নিতে পারেন। আর/০৮:১৪/২২ অক্টোবর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2PNsrjw
October 22, 2018 at 02:47PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন