ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর- চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তৌকীর প্রথম নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে জয়যাত্রা। ১৪ বছর আগে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি অর্জন করেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিলপ্রথম আলো পুরস্কারসহ আরও অনেক সম্মাননা। দেশের বাইরের বিভিন্ন উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছে ছবিটি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে এ ছবি বানানোর পরিকল্পনাসহ এর পেছনের গল্পগুলো লিখেছেন পরিচালক তৌকীর আহমেদ। তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত নদীর নাম মধুমতিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সরাসরি আমার যোগাযোগের সূচনা। পাশাপাশি তখনই আমি সিনেমা নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। ফলে চলচ্চিত্র ক্লাবের সদস্য হয়ে দেখা শুরু করলাম বিভিন্ন দেশের সিনেমা। কাছাকাছি সময়ে আমি নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমিতে গেলাম ডিপ্লোমা করার জন্য, চার মাস ছিলাম। আমার শিক্ষকেরা বললেন, তুমি সিনেমা বানাও, তুমি তৈরি আছ। তাঁদের কথায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। এবার ছবি বানানোর পালা। কী নিয়ে ছবি বানাব? নানান জন নানান বুদ্ধি দিলেন। যতদূর মনে পড়ে, আবদুস সামাদ আমাকে বললেন, আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময়ে উপন্যাসটি পড়তে। পড়ার পর মনে হলো, এই উপন্যাসের সিনেমা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কাজটি যদিও বেশ কঠিন। কারণ উপন্যাসের সিংহভাগ পটভূমি নৌকার ওপর। ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, প্রথম সিনেমাটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করতে চাই। এর একটা কারণও আছেআমি যখন ছোট, তখন পাকিস্তানের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ছিলাম। একটা ঘরের মধ্যে একটা পরিবার, সীমিত খাবার। তাই যুদ্ধের বাস্তবতা সেই ছোটবেলায়ই অনুভব করতে পেরেছিলাম আমি। অতঃপর ভাবলাম, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে জয়যাত্রা বানাব। মনে হচ্ছিল জয়যাত্রাই কি তাহলে আমার মুক্তিযুদ্ধ? খুব আশা ছিল, ছবিটি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের ওপর, দেশের মানুষ খুব উৎসাহ নিয়ে দেখবে। সেটা অবশ্য ঘটেনি। ট্রেলার দেখে অনেকে বলেছে, ভালো হয়েছে, কেউ টেলিভিশনে অর্ধেক দেখেছে। কেউ সিডি কিনে দেখেছে। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বড় পর্দায় দেখেছে কম। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, জয়যাত্রা বাংলাদেশের ইতিহাসে ভিন্ন কারণেও স্মরণযোগ্য। স্বাধীনতার পর এটি প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি। তিন বাহিনীর সহযোগিতা জয়যাত্রা সিনেমায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সম্পৃক্ততা ছিল। যুদ্ধকালীন আবহ সিনেমায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি আমি। টয়োটা গাড়ি দিয়ে একাত্তরের জিপ দেখাতে চাইনি। আমাদের ছবিতে যেসব বিমান ও যুদ্ধজাহাজ দেখানো হয়েছে সবই সে সময়কার। আমাকে বারবার প্রশ্ন করা হচ্ছিল, আমি কী দেখাতে চাচ্ছি? আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। বলেছি, আমি মুক্তিযুদ্ধের একটি ছবি বানাতে চাই। আমার দেশের একটা গল্প দেখাতে চাই। আমার মনে হয়েছে, সবাই হয়তো বুঝতে চাইছিল, আমি কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছি কি না? সবকিছু বুঝতে পেরে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। দেশের কাজে তারা এগিয়ে এসেছে। যুদ্ধের আয়োজন ছিল ব্যয়সাপেক্ষ। তিন বাহিনী আমাকে সহযোগিতা করেছে কিন্তু একটি পয়সাও নেয়নি। বাজেট শেষ, ব্যাংক লোন ও ধারদেনা ৭৫ লাখ টাকা বাজেটে ছবির কাজ শুরু করেছিলাম। প্রিপ্রোডাকশন ও শুটিংয়ের একটা পর্যায়ে বাজেট ফুরিয়ে যায়। এ ছবির কাজ শুরুর আগে আমি রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করতাম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করতাম। ছবিটি আমি নিজেই প্রযোজনা করেছিলাম। সেই আমলে আমার ৭৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। যা এ সময়ে আড়াই কোটি টাকার ওপরে হবে। তো, কিছুদিনের মধ্যে আমার টাকাপয়সা শেষ হয়ে গেল। পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধার নেওয়া হলো। ১৫ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণও নিলাম। অনেক কষ্টে ছবি শেষ হলো। ছবি মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহে চলল না। বিষয়টি বুঝতে পেরে পাওনাদারেরা টাকার জন্য চাপ দিলেন। আমিও তাঁদের টাকা বুঝিয়ে দিতে বাধ্য। দেউলিয়া কাকে বলে, ব্যাংক দুর্নীতি কাকে বলে তখন বুঝলাম। কারও কাছ থেকে টাকা পরিশোধে সময় নিলাম। কাউকে কিস্তিতে দিলাম। ব্যাংক লোন শোধ করতে সময় লেগে গেল। জয়যাত্রা হতাশা, মা আর স্ত্রীই ছিল ভরসা ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে আমি হতাশায় নিমজ্জিত হই। এর মধ্যে টেলিভিশনে যাঁরা ছবিটি দেখলেন, তাঁরা জয়যাত্রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও ভালো ভালো কথা লেখা বের হতে লাগল। মাটির ময়না ছবির পর আমার ছবিটি ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল। এটা আমাকে খুব উৎসাহিত করল। টাকার কষ্ট কিছুটা হলেও তা লাঘব হতে লাগল। আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলামস্থাপত্যের ব্যবসা ছেড়ে দিলাম। ২০০৫ সালে অংশীদারদের বললাম, আমি আর ব্যবসা করব না। ভাবলাম, এত টাকা আমার দরকার নাই। এই কথা শুনে বেশির ভাগ লোক আমাকে বোকা আর নিম্নস্তরের ভাবতে শুরু করলেন। কিন্তু আমার মা আর স্ত্রী আমাকে সাহস দিলেন। সমর্থন করলেন। তাঁরা বললেন, তোমার যেটা করতে ইচ্ছে, সেটাই করো। তখন আমরা নাটক করলেও অনেক টাকা পাই। কারণ টেলিভিশনে তখনো আমি আর বিপাশা ভীষণ জনপ্রিয়। নাটক, তারপর আবারও সিনেমায় মনোযোগী হলাম। সম্মানী ছাড়াই অভিনয়শিল্পীরা মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রতিন মাধ্যমেই আমি কাজ করেছি। সব মাধ্যমে কাজ করেছি বিধায় সুবিধা হয়েছে। বেশির ভাগ অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমি আমার প্রথম সিনেমায় নিলাম সহকর্মীদেরই। তাঁরা মঞ্চের, পরীক্ষিত। আমার সিনেমায় কাজ করেছেন হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মোশাররফ করিম, আবুল হায়াত, মাহফুজ আহমেদ, আজিজুল হাকিম, বিপাশা হায়াত, আহসান হাবিব নাসিম, ইন্তেখাব দিনার, চাঁদনীসহ আরও অনেকে। পুরো দলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ছবির বাজেট এত কম ছিল যে শিল্পীদের কোনো টাকা দিতে পারিনি। শুটিংয়ের আগে এ ব্যাপারে তাঁদের বলেও নিয়েছিলাম অবশ্য। তাঁরা আমার কথা শুনে রাজি হন। বলতে পারেন নিজ উদ্যোগে তাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করেছেন। রাতে স্টোরিবোর্ড, দিনে তিন বাহিনীর অফিসে যতদূর মনে পড়ে, ছয় মাস লেগেছিল জয়যাত্রা ছবির প্রিপ্রোডাকশনের কাজ করতে। আমি যেহেতু স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র ছিলাম, নিজেই ছবি আঁকতাম। চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনাও করেছি। কীভাবে স্টোরিবোর্ড বানাতে হয়, স্ক্রিপ্ট লিখতে হয় তা তো আমি হাত পাকিয়েছি টেলিভিশন নাটক দিয়ে। আমার পরিচালনায় নাইওরী আর উত্তরপুরুষ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হাত পাকিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ ছবিটির নান্দনিক ভাবনার কাজ করছি, কিছুক্ষণ ব্যবস্থাপনার কাজ করছি। বাংলাদেশে সেই অর্থে নির্বাহী প্রযোজক থাকেন না বা প্রোডাকশন ডিজাইনার থাকেন না। তাই রাতে স্টোরিবোর্ড করছি, দিনে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর কার্যালয়ে দৌড়েছি। এভাবে ছয় মাসের মতো চলে গেল। প্রিপ্রোডাকশনে সময় দেওয়াতে কাজও অনেক দূর এগিয়ে গেল। একটি নৌকার জন্য সাতটি ট্রলার জয়যাত্রা সিনেমায় ৬০ ভাগ শুটিং হয়েছিল বগুড়ার বাঙালী নদীতে। ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা একটি নৌকা দেখেছেন। একটি নৌকার দৃশ্য ধারণ করার জন্য আশপাশে সাতটা ট্রলার থাকত। বলা হয়, নৌকায় শুটিং সবচেয়ে কঠিন। কারণ নৌকা প্রতিমুহূর্তে তার অবস্থান পরিবর্তন করে। ঢেউয়ের সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে নৌকার স্থান পরিবর্তন হয়। তার ওপর ভারী ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করা! একটি নৌকার দৃশ্য ধারণের জন্য সাতটি ট্রলারের একটিতে থাকত ক্যামেরা। একটিতে জেনারেটর ও লাইট, আর একটিতে অভিনয়শিল্পীযাঁর যখন দৃশ্যধারণ ছিল, তখন সে নৌকায় উঠত। একটিতে চাপানি, খাওয়াদাওয়ার। আরেকটিতে থাকত পুলিশ। শুটিংয়ের সময় পাড়ে জড়ো হওয়া মানুষকে সামাল দিত পুলিশ। এভাবে সাতটা ট্রলার স্ট্যান্ডবাই থাকত। কাজটি যদিও বেশ কঠিন ছিল। সাহস আর কমান্ডিং অ্যাবিলিটির কারণে তা উতরে যাই। এইচ/২১:২০/১৩ ডিসেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2BeLZau
December 14, 2018 at 03:21AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন