নতুন সরকারের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ, শক্তিশালী ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রশাসনের প্রতিটি স্তর নতুন রূপে সাজানোর চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। পরিবর্তন আনা হচ্ছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ে। শিগগিরই সরকার সমর্থিত মেধাবী ১৯৮৬ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পাচ্ছেন। একই সঙ্গে বিগত সময়ে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, এমন কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডি ও ডাম্পিং পোস্টে পদায়ন করা হবে। মাঠ প্রশাসনের কয়েকটি পদেও আসছে পরিবর্তন। প্রশাসনের মধ্যম স্তরের পদোন্নতির চিন্তাভাবনাও রয়েছে সরকারের।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার পর মন্ত্রিসভায় ব্যাপক চমক দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের মন্ত্রিসভায় বেশিরভাগ ক্লিন ইমেজের নেতা স্থান পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে প্রশাসনেও ক্লিন ইমেজের মেধাবী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বড় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো পরিদর্শন শুরু করেছেন। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ অবস্থায় দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে নতুন সাজে সাজছে প্রশাসন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনে জেঁকে বসা সিন্ডিকেটমুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, গত ১০ বছর প্রশাসন একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে সিন্ডিকেটের সদস্য পরিবর্তন হলেও কাঠামো ও কর্তৃত্ব ঠিকই থাকছে। তাদের পছন্দসই লোকদের দেওয়া হয়েছে ভালো পদায়ন ও পদোন্নতি। এ ক্ষেত্রে মেধা ও জ্যেষ্ঠতার কোনো বালাই ছিল না। দেখা গেছে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এমন কর্মকর্তা কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব হলে তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন এমন আরেক কর্মকর্তাকে। এখন সিন্ডিকেটমুক্ত প্রশাসন গড়ার লক্ষ্যেই এগোচ্ছে সরকার।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, ঢালাওভাবে প্রশাসনে কোনো রদবদল করা হবে না। প্রয়োজনের স্বার্থে কিছু জায়গায় পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতাকে বিবেচনা করা হবে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও অদক্ষতার প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হবে। কাজের ক্ষেত্রে যে যার ওপর অভিজ্ঞ তাকে সেখানেই কাজের সুযোগ দেওয়া হবে। আর পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার পাশাপাশি মেধাকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনে কিছুটা পরিবর্তন হয়। আগামী মাসের মধ্যে কয়েকজন সচিব অবসরে যাবেন। তাদের স্থলে কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। আর এটিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পদে রদবদল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স বিচার করা হবে। তবে এগুলোকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই উল্লেখ করেন তিনি।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, সচিবদের গত দুই বছরের আমলনামা তৈরি করা হয়েছে। এতে যাদের অদক্ষতার পরিচয় মিলেছে, তাদেরকে ডাম্পিং পোস্টিং করা হচ্ছে। আর যারা যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন করে আরও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমন ৭-৮টি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব কর্মকর্তা গত দুই বছর সচিব হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে সিনিয়র সচিব করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া যারা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সফলতা দেখাতে পারেননি, তাদেরকে ডাম্পিং পোস্টিং বা ওএসডি করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের স্থলে কয়েকজন দক্ষ অতিরিক্ত সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে বসানো হতে পারে। একই সঙ্গে যারা তিন বছর ইউএনও ও ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের প্রত্যাহার করা হবে। তাদের স্থলে সরকার সমর্থিত মেধাবী কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে কয়েকজন দপ্তরপ্রধানকেও সরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চৌকস কিছু কর্মকর্তাকে এ পদে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে, যারা সঠিক সময়ে সরকারের নির্দেশনা পালন করতে পারবেন।
সূত্র জানায়, গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। এগুলো বাস্তবায়নে রয়েছে সরকারের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ। আর এগুলো মোকাবেলায় সঠিক সময়ে সরকার যেমন নানা উদ্যোগ নেবে, অন্যদিকে সেগুলো নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নও জরুরি। এ জন্যই প্রয়োজন দক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসন। আর এটি গঠনে সরকারও সচেষ্ট। এর অংশ হিসেবে সরকার এ দফায় ক্ষমতা গ্রহণের পর কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করছে।
জানা গেছে, যেসব মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, নির্বাচন কমিশন, ত্রাণ ও দুর্যোগ, শিক্ষা, ধর্ম, বেসামরিক বিমান পরিবহন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এদের মধ্যে যারা তিন বছর সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সফলতা দেখিয়েছেন তাদের সিনিয়র সচিব করে বর্তমানে যে মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন তার চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া যারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তারা বাদ পড়বেন। এ সংখ্যা ২-৩ জন হতে পারে। এ ছাড়া মাসখানেকের মধ্যে আরও কয়েকটি সচিব পদ খালি হচ্ছে। এসব পদেও দেখা যাবে নতুন মুখ। তাদের মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জনপ্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। কারণ তার এ মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা কোন ক্ষেত্রে দক্ষ ও যোগ্য, সে বিষয়ও নখদর্পণে রয়েছে ওই কর্মকর্তার। নির্বাচন কমিশনের সচিব দায়িত্ব পেতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের। কারণ তিনি কয়েক বছর ধরে তার দায়িত্ব সফলতার সঙ্গেই সামলেছেন। এ বিবেচনায় তাকে সচিবালয়ের মধ্যে বড় কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দেখা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সিনিয়র সচিব করে অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে। সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব আরও এক বছর চুক্তি পেতে পারেন। তার চাকরির অবসরের বয়স শেষের দিকে। পরিবর্তন আসতে পারে কয়েকটি বিভাগীয় কমিশনার পদেও। বিভাগীয় কমিশনারদের মধ্যে যারা সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের কাউকে কাউকে ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
এ ছাড়া সরকারি কাজকর্মে গতি আনতে মাঠ প্রশাসনেও বড় ধরনের রদবদল আসছে। আগামী উপজেলা নির্বাচনের আগে ও মাঠ প্রশাসনের ডিসি, এডিসি এবং ইউএনও পদে প্রায় দেড়শ’ কর্মকর্তার দপ্তর বদল করা হচ্ছে। তালিকায় রয়েছেন ডিসি পদে ১৫ জন, এডিসি পদে প্রায় ৪০ জন এবং ইউএনও পদে প্রায় ৯০ জন কর্মকর্তা। সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদেরই এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হবে। ইতিমধ্যে ডিসি পদে নিয়োগের জন্য ফিটলিস্ট তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এটি থেকে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে ডিসি পদে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। মূলত প্রশাসনের ২২ ও ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। বর্তমান কর্মরত ডিসিদের মধ্যে যারা অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন এমন কয়েকজন ডিসিকেই প্রত্যাহারে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। একইভাবে এডিসি পদেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। সারা দেশের প্রায় ৪০ জন কর্মকর্তাকে এডিসি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। মাঠ পর্যায়ে তিন বছর ইউএনও পদে যাদের মেয়াদ পার হয়েছে এবং যারা এ পদে কর্মরত থাকাবস্থায় অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন এমন ৯০ জন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রশাসনে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব এবং যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির চিন্তাভাবনা রয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ পদে কর্মরত ৮৪ ও ৮৫ ব্যাচের অধিক সংখ্যক কর্মকর্তা অবসরে যাবেন। আর তাদের শূন্যতা পূরণেই পদোন্নতি দেওয়া হবে।
from মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্য – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://bit.ly/2RDXBPh
January 20, 2019 at 07:28AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন