দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবিস্মরণীয পটভূমিকায নেতাজি তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজকে নিয়ে লড়েছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ। সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও তখনকার বর্মা হয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রবেশ করেছিল মণিপুরে, ভারতের মাটিতে।
এখন সেই পথেই নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতি খুঁজে ফিরবেন সাইকেলে আফ্রিকা এবং সাহারা মরুভূমি অভিযানখ্যাত অভিযাত্রী অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় । (আজ দ্বিতীয় কিস্তি)
এটুকু অনেকদিনই বুঝেছিলাম যে কেবল কৌতূহল আর কাজ চালানোর মতো একটু আধটু পড়াশোনা দিযে দেশনায়কের পথে পা বাড়ানো উচিত নয়। তাই একজন নেতাজি স্কলার না হয়ে নিজেকে যথাসাধ্য নিয়োগ করলাম পড়াশোনায। আমার পড়াশোনার কেন্দ্রবিন্দু থাকল নেতাজির জীবনের এই শেষ অধ্যায-যে অধ্যায়টি স্বয়ং নেতাজির ভাষায-তাঁর কাজের অধ্যায়। ১৯৪৩-এর জুলাই মাসেই সিঙ্গাপুরে, প্রথমে ক্যাথে হল এবং পরে পাদাং-এর প্রকাশ্য সমাবেশে নেতাজির ডাকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সেদিন যেরকম সাড়া জেগেছিল সে সম্বন্ধে কৃষ্ণা বসু লিখেছেন, এক একটি পরিবারে বাবা, মা ছেলে, ভাইবোন সকলে কোনো না কোনো প্রকারে আজাদ হিন্দ আন্দোলনে যুক্ত হয়ো পড়লেন। ছেলেরা যোগ দিল আজাদ হিন্দ ফৌজে, মেয়ে রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টে, ছোটোরা হয়তো বালসেনাতে, আর যারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে কোনো কারণে যোগ দিতে পারবে না তারাও সিভিলিযান বা অসামরিক বিভাগে বিভিন্ন কাজে লেগে পড়ল। সব চাইতে আশ্চর্যের কথা, এদের মধ্যে এমনও অনেকে ছিলেন যাঁরা স্বদেশ কোনোদিন চোখে দেখেননি, ভারতবর্ষ সম্পর্কে কোনো ধারনাই তাঁদের ছিল না, অনেকে পরে আমাদের বলেছেন, হয়তো গান্ধীজির ছবি একটা ছিল বাড়িতে, হয়তো ভাসাভাসা ভাবে জওহরলাল নেহরুর বা সুভাষ বোসের নাম শুনেছিলেন তাঁরা। কিন্তু নেতাজি এসে ডাক দেওয়ার পর ওদের জীবনধারা আমূল পালটে গেল।
নেতাজির নিজের হাতে লেখা দুপাতার একটা ডেটলাইনের ছবি দেখতে পাওয়া যায় নেতাজির এলগিন রোডের বাসভবনে গেলে। নেতাজির সচিত্র জীবনীতেও এই দুপাতার ছবি রয়েছে। যখনই আমি এই দুটি পাতার দিকে তাকাই, নেতাজির নিজে হাতে লেখা এই দলিল আমাকে যেন অনেক কিছু বলতে চায়। তার প্রথম কারণ- এটি নেতাজির নিজের হাতে লেখা একটা দলিল। কোনো নেতাজি বিশেষজ্ঞ কিংবা ঐতিহাসিকের নয়। অনেকটাই ডায়রি লেখার মতই এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য। দ্বিতীয় কারণ- ১৯১৪ থেকে জুলাই ১৯৪৩ পর্যন্ত বিস্তৃত এই লেখায়, নেতাজি তাঁর নিজের মতে, তাঁর জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিকে এখানে উল্লেখ করে গিয়েছেন। তাই, প্রথমেই যে বিষয়টি আমার নজর কাড়ে সেটা এই দলিলের শেষ এন্ট্রি-জুলাই ১৯৪৩- বিগ্যান ওযার্ক-কাজ শুরু করলাম। লক্ষণীয়ভাবে, এই শেষ এন্ট্রিতে- আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিলাম, টোটাল মোবিলাইজেশনের ডাক দিলাম, কিংবা যুদ্ধ ঘোষণা করলাম; এই জাতীয় কোনো কথাই নেতাজি লেখেননি। লিখেছেন, কাজ শুরু করলাম-বিগ্যান ওয়ার্ক। এই কাজ যে কী, তা বোঝার জন্য নেতাজি স্কলার হতে হয় না।
তবে এই দুপাতার এন্ট্রির অন্য একটা বিষয়ও আমাকে অল্প হলেও ভাবিয়ে চলেছে। সেটা হচ্ছে, এই দলিলে নেতাজির বছর এবং মাস লেখার পদ্ধতি। ১৯১৪ থেকে ১৯৪০-এর নভেম্বর পর্যন্ত সবকটি এন্ট্রিতেই মাসের আগে লেখা বছর। যেমন-১৯৩৯ জানুযারি-রি-ইলেক্টেড প্রেসিডেন্ট। গোটা দলিলের ব্যতিক্রম ঘটছে ১৯৪১, অর্থাৎ, সেই মহানিষ্ক্রমণের সময় থেকে। এবার আগে আসছে মাস, পরে বছর। এরকম ছন্দপতন নেতাজির মত মেটিকুলাস মানুষের হাতে ঘটা, একটা খটকা আমার কাছে। আমার এই ধারণার স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে আমি ফিরে যেতে চাই, ১৯ এবং ২০ অক্টোবর, ১৯৪৩-এর মধ্যরাতে-সিংগাপুরের মেযার রোডে-নেতাজির বাড়িতে। নেতাজি তাঁর ডেস্কে ঝুঁকে পড়ে পেনসিলে লিখে চলেছেন পাতার পর পাতা। একটা করে পাতা লেখা শেষ হচ্ছে আর সেটা তৎক্ষনাৎ পাশের ঘরে সিব্বিয়ার আপ্পাদুরাই আইয়ার সাহেবের টেবিলে টাইপ করার জন্য পৌঁছে দিচ্ছেন আবিদ হাসান সাফরানি এবং এন জি স্বামী। লিখতে লিখতে একবারও মুখ তুলছেন না নেতাজি, এমনকি আগের পাতায় কী লিখেছেন তা একবারও জানতে চাইছেন না। মাঝেমধ্যে কালো কফিতে চুমুক দিচ্ছেন কেবল। কাজ যখন শেষ হল, তখন সকাল হতে চলেছে।
আইয়ার সাহেব পরে বলেছিলেন, আমাকে যে বিষয়টি হতবাক করেছিল তা হল, নেতাজি একবারের জন্যও আগের পৃষ্ঠায় কী লিখেছিলেন দেখতে চাননি। গোটা দলিল যখন লেখা শেষ হল তখন তাতে একটাও বানান কিংবা ব্যাকরণের সংশোধন করার দরকার হয়নি। এইরকম একটা ঐতিহাসিক দলিল যিনি একবারও রিভাইস না করে, নিখুঁতভাবে একটানা লিখে দিতে পারেন, তাঁর নিজের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ডেটলাইন লেখার সময় সন-মাসের এইরকম অর্ডার অ্যান্ড মেথড হঠাৎ বেতাল হয়েছিল কেন? দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অগণিত বিনিদ্র রাতের ফসল কি এই ছন্দপতন? আমার মনে হয়েছে, এই দলিলে বছরের আগে মাসের আবির্ভাবের মূল কারণ সেই সময়ে ঘটনাবহুলতা এবং প্রত্যেকটি ঘটনার গুরুত্ব। কারণ, কেবল শরীর এবং মনের ধকল নয়, আমার মনে হয় নেতাজি তখনই জানতেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নির্ণায়ক অধ্যায়ে অতিমানবিক দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকেই জাপানিদের সঙ্গে একটা টানটান উত্তেজনার সম্পর্ক ছিল। মাঝেমধ্যেই সেই টানটান সম্পর্ক প্রত্যক্ষ বিবাদেও পরিণত হত। ফলে জাপানি জেনারাল, সেনা অফিসার, কিংবা অন্যান্য নেতৃস্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় নেতাজিকে সবসময়ই একটা ভয়ংকর একগুঁয়ে একরোখা মেজাজে চলতে হত। আজাদ হিন্দ বাহিনী এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে জাপানকে নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করতে হবে, এই কথা নেতাজি স্পষ্টভাবেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোকে বলে দিয়েছিলেন ১৯৪৩ সালের ১০ ডিসেম্বর টোকিওয় প্রথম সাক্ষাতেই। তাঁদের প্রথম সাক্ষাতে, জাপানি সাদার্ন আর্মির কমান্ডার ফিল্ড মার্শাল তেরাউচিকেও এই একই কথা বলেছিলেন নেতাজি। বলেছিলেন, the first drop of blood shed on Indian soil must be that of a soldier of the INA-ভারতের মাটিতে প্রথম রক্ত যদি পড়েই তা যেন একজন আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকের হয়। কারণ, জাপানি সৈনিকের আত্মত্যাগে ভারতের স্বাধীনতা লাভ হবে ক্রীতদাসত্বের থেকেও খারাপ।
আজও, নেতাজির প্রাথমিকভাবে জার্মানির এবং পরে জাপানের সাহায্য নেওযার বিষয়ে শুনতে পাওযা যায়, হিটলারের জার্মানি এইরকম অত্যাচার করেছিল কিংবা তোজোর জাপান এত পাশবিক ছিল-এই জাতীয় কথা। সে তো ঠিকই। কিন্তু, প্রশ্ন হল, চার্চিলের ব্রিটেন আর রুজভেল্টের, ট্রুম্যানের আমেরিকা কি ধোয়া তুলসীপাতা ছিল? সত্যিই তো, আমেরিকা তো বিশেষ কিছু করেনি, একটা অ্যাটম বোমা ফেলেছিল, এই যা! নেতাজি একবার বলেছিলেন যে তিনি ব্রিটিশের হাউইত্জার কামানের থেকে তাদের প্রোপাগান্ডাকে বেশি ভয় করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে প্রোপাগান্ডা শুনতে পাওযা যেত তা এখনও, এই স্বাধীন ভারতে বসে আমাদের শুনে যেতে হবে কেন? নিরপেক্ষ বিচারে যুদ্ধ অপরাধী সবাই। ওয়ার অ্যান্ড অ্যাট্রোসিটি-একই মুদ্রার দুটি পিঠ। অ্যাট্রোসিটির কথাই যখন উঠল, তখন চলুন ফিরে আসি সেই ১৯৪৩ এ, ঠিক যখন নেতাজী দক্ষিণ এশিযায় পা রাখছেন। ভারতের লাট সাহেবের জনস্বাস্থ্য বিভাগ জানালেন সে বছর দুর্ভিক্ষে আমাদের বাংলায় ৬৮৮৮৪৬ জন মারা গেছেন। টিম ডাইসন এবং অরূপ মহারত্ন গবেষণা করে দেখলেন সরকারের হিসাবে বেজায় গরমিল-দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা অন্তত ২১ লাখ। তার কিছুদিন পর, প্রশান্ত মহলানবীশ মহাশযে হিসাবে জানা গেল সংখ্যাটি ২১ নয়, ৩১ লাখ। কিছুদিন পর সেই সংখ্যা যোগ করে দাঁড়াল ৫৪ লাখ। আজ জানা গেছে, এই গণহত্যার দায়-দায়িত্ব ছিল উইনস্টন চার্চিলের। সেই সময় নেতাজি চেষ্টা করেছিলেন, রেঙ্গুন এবং মালয় পেনিনসুলা থেকে জাহাজে করে বাংলায় খাবার পাঠাতে। ইংরেজ তা আসতে দেয়নি। তবে ভারতের শেষ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে জাপানিদের সাহায্য নেতাজি কোন পরিপ্রেক্ষিতে নিয়েছিলেন সে কথা বুঝতে গেলে সমসাময়িক ভারত এবং পূর্ব এশিযার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নেতাজির বিপ্লবী চিন্তাধারা সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকার।
from Uttarbanga Sambad | Largest Selling Bengali News paper in North Bengal http://bit.ly/2HepEzY
January 14, 2019 at 06:41PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন