ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি- যেকোনো গান সৃষ্টির পেছনে থাকে একটি গল্প। সে গান যদি হয় চলচ্চিত্রের, তাহলে ছবির গল্পে যেখানে গানের চাহিদা, সেখানেই সেই কাহিনিবিন্যাস মাথায় নিয়ে গান লেখেন গীতিকবি। পরে সেই গীতিকবিতায় সুরের চাদর জড়ান সুরকার। বেলাল আহমেদের নয়নের আলো ছবির একটি গান আছে, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি/ এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না,/ আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ মিটবে না গো মিটবে না।/ তারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না মন ভরবে না। আজ এই গানের গল্পটাই কেন যেন লিখতে ইচ্ছে করছে। কেননা, বরেণ্য আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা ও সুর করা অনন্য সৃষ্টি রয়েছে অসংখ্য, কিন্তু এই একটি গানেই অমর হয়ে থাকবেন তিনি। এই গানের গল্পটি শুনেছি শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের কাছ থেকে। নয়নের আলো চলচ্চিত্রটি ১৯৮৪ সালের ৩ আগস্টে মুক্তি পেলেও কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের কোনো একসময়। আহমেদ ইমতিয়াজ তখন কাজ করেছেন হাতে গোনা তিনটি বা চারটি ছবিতে। প্রতি ছবিতে একটি বা দুটি গান। তখনো তিনি একটি ছবির সব কটি গান করার সুযোগ পাননি। ওই সময় বেলাল আহমেদ একটি ছবি পরিচালনার সুযোগ পান। এ ছবির চিত্রনাট্যও তাঁর। বেলাল আহমেদকে ছবির প্রযোজক ফরিদ সাহেব নতুনদের নিয়ে কাজ করতে বললেন। তিনি বললেন, যারা পুরোনো, কাজ করতে করতে ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছেন, তাঁদের আমি চাই না। নতুনদের নিন, তাতে নতুন কিছু পাওয়া যাবে। বেলাল আহমেদ নিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। কাজ শুরু হলো। আজিমপুরের বাড়িতে প্রতিদিন গানের সিটিং বসে। বন্ধু এন্ড্রু কিশোর থাকেন ফকিরাপুলে। সেখান থেকে চলে যান আজিমপুর। বন্ধুত্ব হলেও এন্ড্রু কিশোর তাঁকে আপনি সম্বোধন করেন, বুলবুল তাঁকে বলেন তুই তুই করে। তাঁর বাড়িতে আমরা প্রতিদিনই গান নিয়ে বসি। বুলবুল ভাই কাগজ কলম আর গিটার নিয়ে বসতেন। দুই লাইন লিখে সঙ্গে সঙ্গে সুর করার চেষ্টা করতেন। গান সুর করার পর সেটি তার ছোট্ট টুইনওয়ান সেটে রেকর্ড করা হলো। এরপর তাঁর প্রথম কাজ হলো সবাইকে ডেকে ডেকে সুরটা শোনানো। সেই শ্রোতার তালিকায় থাকতেন তাঁর মা, বাড়ির গৃহকর্মী। তাঁরা যদি বলতেন ভালো হয়েছে, তবেই তিনি রেকর্ডিংয়ের পরিকল্পনা করতেন। নয়নের আলো ছবির প্রথম গানটি তৈরি হলো আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে, হৃদয় যেখানে। এখন কে গাইবে? পুরুষকণ্ঠ চূড়ান্ত হলো এন্ড্রু কিশোরের। আর নারীকণ্ঠ? প্রযোজক নতুন কাউকে চান। ওই সময় জন্ম থেকে জ্বলছি ছবিতে একবার যদি কেউ ভালোবাসত গানটি সামিনা চৌধুরী সবেই গেয়েছেন। এন্ড্রু কিশোর তাঁর কথা বললেন আহমেদ ইমতিয়াজকে। মাহমুদুন্নবীর মেয়েটি ভালো গাইছে। ওকে নিতে পারেন। আমার কথায় রাজি হলেন বুলবুল ভাই। আমরা বিপুল উৎসাহে সামিনাদের মোহাম্মদপুরের বাড়িতে গেলাম। ছবিতে সামিনাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর কথা শুনে তার মা বললেন, আগে আমি গান শুনব, বুঝব। পছন্দ হলে তবেই সুমা (সামিনা) গাইবে। শুনে বুলবুল ভাই খেপে গেলেন। আমাকে বললেন, চল চল, গান করব না। আমি বললাম, রাগ করে কী হবে। একবার তাঁদের গানটি শুনিয়েই দেখেন। তিনি বুঝলেন। গানটা বাজিয়ে শোনালেন। এবার সামিনার মায়ের গানটি পছন্দ হলো। এরপর গানটি রেকর্ডও হলো। এবার ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গান। ছবির যেখানে গানটি হবে, পরিচালক সেই সিকোয়েন্স বললেন বুলবুল ভাইকে। তিনি কাগজকলম, গিটার নিয়ে বসে পড়লেন। লিখেও ফেললেন আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না। সুর করার চেষ্টা করলেন, প্রথম দিন হলো না। পরের দিন আবার বসলেন। আজ সুর হলো। টুইনওয়ানে সেই সুর রেকর্ডও হলো। এখন শ্রোতাদের অভিমত লাগবে। তাঁদের মতের ওপর নির্ভর করছে এ গানের ভবিষ্যৎ। বুলবুল ভাইয়ের মা শুনে বললেন, মোটামুটি হয়েছে। বাড়ির গৃহকর্মী শুনে বলল, মামা, সুর ভালাই, কিন্তু বড় কঠিন। বুলবুল ভাই সাহস পেলেন না বেলাল ভাইকে শোনাতে। তাঁর এক বন্ধু ছিলেন সারোয়ার, আমাকে নিয়ে ছুটলেন তাঁর বাড়ি। বন্ধুর একটি আকাই ডেকসেট ছিল। সেই ডেকসেটে তিনি গানটি রেকর্ড করে এনে বেলাল ভাইকে শোনালেন। শুনে তিনি বললেন, ভালো হয়েছে। বুলবুল ভাই অবশেষে সাহস পেলেন। রেকর্ডিংয়ে গেলেন। কিন্তু ওই দিন আমার গলার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। এই অবস্থায় কণ্ঠ দিলাম। কিন্তু চূড়ান্ত হওয়ার পর গানটি শুনে আমার মনঃপূত হলো না। আমি ভয়ে ভয়ে বেলাল ভাইকে বললাম, আরেক দিন ভয়েসটি নিলে ভালো হতো। তিনি খেপে গেলেন। বললেন, রাখো মিয়া। এইটাই কারেক্ট হইছে। ছবির সিকোয়েন্সে সারা রাত কানতে কানতে নায়কের (জাফর ইকবাল) গলা ধইরা গেছে। সেই ধরা গলায় গান করলে যেমন হইব, এই গানে তোমার কণ্ঠও তাই ছিল। এইটাই ঠিক আছে। অনেক চেষ্টার ফসল গানটি। পর্দায় জাফর ইকবালের ঠোঁট মেলানো এই গান মানুষের মনে এতই দাগ কেটে গিয়েছিল যে সেটি অন্য উচ্চতায় চলে গেছে। আমি এই গানের জন্য ১৯৮৪ সালে পেয়েছি শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। আর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল পেয়েছেন তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ গান। এই গান তাঁকে করে রাখবে অমর।
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2HvScVV
January 25, 2019 at 08:00AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন