সিলেট, ২৬ মার্চ- ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে যে পতাকা এনেছেন মৃত্যুর পর তা দিয়ে যেন আমায় না জড়ানো হয়। আমি গার্ড অব অনারও চাই না। তুমি লিখে দিও, আমাকে যেন শহীদ মিনারে না নেওয়া হয়। আমি এসব চাই না। অভিমান নয় বিশ্বাস থেকে কথাগুলো বলেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম। যাদের হাত দিয়ে সেরা সেরা দেশের গান পেয়েছে বাংলাদেশ তাদের একজন সুজেয় শ্যাম। এখনও এই প্রজন্মের কেউ আগ্রহ দেখালে তিনি তাকে গান তুলে দেন। এই শিল্পী পিঁপড়া বা কৃষক হয়ে পুনর্জন্ম নিতে চান। তার ভাষায়, দলবদ্ধতার জন্য পিঁপড়া কীট-পতঙ্গের মধ্যে শক্তিশালী। তাদের মতো শক্তিশালী এদেশের কৃষকরা। কারণ চোখের সামনে তারা দেখছেন, ফসল ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আবারও ফসল করছেন। আমাদের এমন হলে কী করি,কেঁদে মরে যাই। এক একুশে পদক পচ্ছি না সেই নিয়ে আমাদের কত হাহাকার। তাই পুনর্জন্ম হলে আমি আর শিল্পী হতে চাই না, পিঁপড়া কিংবা কৃষক হতে চাই। স্বাধীন বাংলা বেতারের এই শিল্পীর মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি ও বর্তমান ভাবনা নিয়ে রবিবার (২৩ মার্চ) তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। যদিও মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এসব নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না এখন। এসব নিয়ে কেন কথা বলতে চান না-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বলে কী হবে? অনেক বলেছি, আর বলতে চাই না। কতজন কত কথা বলে এখন। স্বাধীন বাংলা বেতারের কথাই যদি বলি। হাতে গোনা কিছু শিল্পী স্বাধীন বাংলা বেতারে গান গেয়েছেন আর কয়েকজনও সঙ্গে ছিলেন। এখন তাদের দাপটে টেকা দায়। সত্যিকার অর্থে উমা, কল্যাণি, কাদেরি কিবরিয়া, রথিন, রফিকুল আলম ও বুলবুল মহলানবিশ, রুপা, মালা, চট্টগ্রামের ও রাজশাহীর শিল্পী মিলিয়ে মোট ২০/২৫জন। কিন্তু তালিকায় এখন ৪০ জনের বেশি ছিল। যুদ্ধের সময়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেসময় শুরুতে আমি চেয়েছিলাম নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে, অন্যকিছু না। এরপর যখন দেখলাম যুদ্ধের দামামা তখন যুক্ত হলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে আমাকে বাঙালি বানিয়েছেন আমি তাকে মানি। যুদ্ধের পুরোটা সময় আমি কোথাও যাইনি, কেবল স্বাধীন বাংলা বেতারে গান করেছি। আমার নিজের ৯টা গান ছিল। কিন্তু কী যেন হয়ে গেল। বিজয় দিবসে তৈরি হওয়া গান বিজয় নিশান উড়ছে ওই কয়জন জানে? জানে না কারণ পরবর্তীতে গান নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। শিল্পীরা নানা সময়ে ব্ল্যাকলিস্টেড হয়েছে। ফলে একেক সময় একেক গান হারিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ এবং ২৬ মার্চ কোথায় ছিলেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৭ মার্চ ঢাকাতেই ছিলাম। ভাষণ শোনার পরে মনে হল আমরা একটা জাতি। এর আগে তো আমাদের ভারতের দালাল গালি শুনতে হতো। এতো সুন্দর সে ভাষণ। কিছু লেখা নাই, অনর্গল বলে চলেছেন। শরীরে আলাদা উন্মাদনা তৈরি করে তা শুনলে। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। লাখ লাখ মানুষ একটা আঙুলের ইশারা দেখলেন। এরপর আমি ১৫ তারিখ সিলেট রওনা দেই। সিলেটের নিরালা রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছি তখন একজন এসে খবর দিলেন ঢাকার অবস্থা ভালো না। এর পরপরই ৭৬ ঘণ্টার কারফিউ দেওয়া হল। সে কী নৃশংসতা। শুরু হল শহর থেকে মানুষ যাওয়া। আমি সীমান্ত পার করে দেওয়ার কাজে সহায়তা করতাম। এর কিছুই ডকুমেন্টেড না। তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা কেবল ধর্ষণের দৃশ্য দিয়েই সমাপ্ত। কত মানুষ নেই,কতজন ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হল সেসব উঠে আসেনি। আমাদের এলাকা থেকে যেতে যেতে শেষ বাড়ির মালিক যেদিন যায় পুরো চাবির গোছা আমার হাতে দিয়ে যায়, দেখে রাখতে দিয়েছিলেন। আমিও এর পরপরই রওনা দেই, যখন আমি সীমান্ত পার হবো তখন দেখি বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে। আমাদের এখানে সেই অর্থে সাংস্কৃতিক আন্দোলন নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৪৬ বছর অপ্রয়োজনীয় ঝগড়া করে গেলাম। পাশের দেশ ভারতে যা কিছু হোক সংস্কৃতি ঠিক আছে। আমাদের সংস্কৃতিটা ধরে রাখতে পারিনি। আমরা যখন গান তৈরি করেছি আমরা হাফ কাপ চা আধা সিঙ্গারা খেয়ে গান বেঁধেছি। এখন তো কাবাব, পেটিস ছাড়া গান হবে না। তাই আমাদের গানও হয় না। আপনি নানা বিষয়ে স্বচ্ছ সুস্পষ্ট কথা বলেন, এত সাহস পান কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাহস পাবো না কেন? আমি তো মিথ্যা বলছি না। আমার বাসায় একটা গৃহকর্মী ছিল। রাতে হঠাৎ হঠাৎ তাকে পাওয়া যেত না। সে ছাদে চলে যেত। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতো, আজ সারাদিনে সে যা করেছে তা ভালো করেছে কিনা। তার কাছ থেকে আমি শিখেছি, বিবেকের কাছ থেকে সরে গেলে হবে না। আজকের দিনটাই শেষ না মনে রাখতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারতে হবে। আমার বিবেচনায়, শ্মশান সবচেয়ে ভালো জায়গা, নিজেকে বোঝার। আমি যুবক বয়সে প্রায় শ্মশানে যেতাম। নিজের মতো ভাবা যায় সেখানে। এখন যেতে পারি না। ভুলে গেলে চলবে না সবচেয়ে বড় নিজের বিবেক। আর/০৮:১৪/২৬ মার্চ
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2Yr6snd
March 27, 2019 at 05:57AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন