ঢাকা, ২৫ মার্চ- অনেকেই ভালো গান গাইতে পারেন- এমনও আছেন প্রচুর; কিন্তু গণমানুষের প্রাণের স্পন্দনের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন, এমন সঙ্গীতশিল্পী একটি দেশে খুব বেশি থাকেন না। আমাদের দেশে শাহনাজ রহমতুল্লাহ সেই সঙ্গীতশিল্পী, যিনি গণমানুষের প্রাণের স্পন্দনে মিশে গেছেন। সেই ষাটের দশক থেকে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে শুধু নন, তিনি সবার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়। তাকে ভালোবাসেন না, সম্ভবত এমন একজন মানুষও এ দেশে পাওয়া যাবে না। এটি এক বিরল ঘটনা। তার এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কাজের প্রতি তার অসামান্য নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ভালোবাসার কারণেই। তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও নিখুঁতভাবে গড়ে তুলতে চাইতেন, একজন প্রকৃত ও গুণী শিল্পী হিসেবে এই নিষ্ঠা তার ছিল। শাহনাজ রহমতুল্লাহ নেই- বড় আঘাত পাওয়ার মতো খবর। অবিশ্বাস্য। আমি কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারছি না। খুবই কষ্ট হচ্ছে আমার। এতদিন ধরে একই অঙ্গনে কাজ করেছি, যা স্মৃতিকোষে আজও জমা হয়ে আছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই দিনগুলোর দৃশ্যপট; আর অশ্রুসিক্ত করছে আমাকে। কতদিনের পরিচয় আমাদের- তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। দিন, তারিখ, মাস, বছর কোনোটাই মনে নেই। তখন আমার বয়স কতইবা হবে। ১২ কি ১৩ বছর। সেই সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বেতারে খেলাঘর নামে শিশুদের একটি অনুষ্ঠান প্রচার হতো। সেটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। আমরা দুজন সেখানে গান গাইতাম। সেই থেকে বন্ধুত্ব। ওই অনুষ্ঠানে গুণী সুরকার ও সঙ্গীতপরিচালক আলাউদ্দিন আলীও ছিলেন। সেই সময় আমরা দুজন সেরা শিশুশিল্পী হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছি। শাহনাজ আমার বন্ধু ছিল। ছিল বলছি কেন? শাহনাজ আমার বন্ধু আছে, থাকবে। শাহনাজ আমার প্রাণের সখা। আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়াও হতো। সেই ছোটবেলার একটা কথা খুব মনে পড়ছে, এক প্রতিযোগিতায় দুজনেই অংশ নেব বলে মনস্থির করলাম। কে কী রঙের জামা পরব তা নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। কারণ আমাদের দুজনেরই লাল খুব প্রিয়। ও বলল লাল রঙের জামা পরব। আমি বললাম আমিও। এ নিয়ে প্রচণ্ড মন কষাকষি। এক পর্যায়ে হলো সন্ধি। ওর পরিবারের সঙ্গেও আমার সুসম্পর্ক ছিল। প্রায়ই বাসায় যেতাম। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ ও জাফর ইকবালের সঙ্গেও শাহনাজের সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। বড় হওয়ার পর যে যার মতো গান করেছি। ব্যক্তি শাহনাজ অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। সব ছাপিয়ে ওর সরলতাই আমাকে মুগ্ধ করত সবসময়। অহঙ্কার ছিল না ওর মধ্যে। দেশের গান, আধুনিক গান, গজলে তার অসাধারণ গায়কীতে অন্য শ্রোতাদের মতো আমিও বারে বারে মুগ্ধ হয়েছি। একজন সত্যিকারের সঙ্গীতশিল্পীর যেমন আচরণ হওয়া উচিত, শাহনাজ ছিল তেমনি। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ও শতভাগ সফলতার পরিচয় দিয়েছে। তার গানগুলো শুনলেও মনের অজান্তেই বলতে হতো- কী অদ্ভুদ! অনেক আবেগ দিয়ে গান গাইতো। অসাধারণ গায়কী। কী ভালো গলার আওয়াজ! সিনেমায় তার গাওয়া অনেক গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। পরিণত বয়সেও আমরা দুই বন্ধু অনেক গান করেছি। আমার কাছে হারমোনিয়াম আর ও পাশে থাকলে তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে গাইতে অনুরোধ করতাম। ও কখনও আমায় না করেনি। খান আতাউর রহমানের লেখা এই গানটি শুনলে শাহনাজের কথা মনে পড়বে সবসময়ই। শেষ সময়ে আমাদের খুব একটা দেখা হতো না। তবে মাঝে মধ্যে কথা হতো। ওর সঙ্গে সর্বশেষ সাত বছর আগে চট্টগ্রামে একটি আয়োজনে অংশ নিয়েছিলাম। গানের ফাঁকে ফাঁকে খোশগল্পে, হাসি-আনন্দে দারুণ সময় কাটিয়েছি। আমিও ওর গানের ভক্ত। কিন্তু ওকে বুঝতে দিতাম না। যখন খবর এলো শাহনাজ রহমতুল্লাহ আর নেই, তখন বাঁধভাঙা অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। অবশ্য আমি মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে, মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। শাহনাজ রহমতুল্লাহ এ দেশের মানুষের গায়িকা। তার মৃত্যু নেই। বাংলা গান যতদিন আছে, সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তার অক্ষয় অবস্থান চির অমলিন হয়ে রইবে। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দুঃখ, আমরা আর এ মানুষটিকে চোখে দেখব না। এই তো নিয়তি। বিদায় বন্ধু। আর/০৮:১৪/২৫ মার্চ



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2TuCcnu
March 25, 2019 at 04:20PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top