লোকসভা ভোটে তাড়া করছে পঞ্চায়েত ভোটের স্মৃতি

রহিত বসু, ১৬ এপ্রিলঃ এবারের লোকসভা নির্বাচনে গত বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আপনি ভাবছেন এ আবার কী কথা! লোকসভা ভোটে স্থানীয়ে নির্বাচনের কথা আসছে কেন? আসছে, তার কারণ মানুষের স্মৃতি কখনও কখনও প্রখর হয়ে ওঠে। এবার যেমন হচ্ছে। এ যে শুধু জলপাইগুড়িতে হচ্ছে, তা নয়। এর আগে কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারেও একই ছবি দেখেছিলাম। পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজের ভোট নিজে দিতে না পারার শোক মানুষের এখনও যায়নি। আপনি যদি ভাবেন এই শোক শুধু বিরোধী দলের সমর্থকদের, তাহলে ভুল হবে। তৃণমূলের অনেক সমর্থকও ভোট দিতে পারেননি। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া পাহাড়পুরের এক তৃণমূল সমর্থক যেমন বলছিলেন, সারা বছর দলের কাজ করেও ভোট দিতে পারিনি। এবার আসুক।

ভোটের দিন সৌরভ চক্রবর্তীর বাহিনীকে তিনি ঠেকাতে পারবেন কিনা, সে পরের কথা। ভোটে শেষ পর্যন্ত কে জিতবেন, সেটাও অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এই বাজারে তৃণমূলের একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যেও অনেকে যে অধিকার লঙ্ঘনের স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছেন, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই প্রবণতা তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষে উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে। ময়নাগুড়ি এবং ধূপগুড়িতে অনেকে আমাকে বলেছেন, তাঁদের হাতে কালি লাগিয়ে ভোট দিতে না দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দল তাঁদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেনি। তাঁরা এখন বলছেন, স্থানীয় তৃণমূল নেতারা তাঁদের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। অর্থাৎ, পঞ্চায়েতে দখল কায়েম করতে গিয়ে লোকসভা আসন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। ইতিহাসে দেখা যাবে, বিশ্বের বহু শাসক ভয়কে নাগরিকদের উপর আধিপত্য কায়েম করার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই রাজ্যেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মানুষকে ভয় দেখিয়ে বশ মানানোর প্রক্রিয়ায় শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদন ছিল কিনা, সেই বিতর্কে যদি আমরা নাও ঢুকি, তাহলেও এই কথাটা সত্য যে, শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের মানুষ ভয়ের দোকান হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সন্ত্রাসের কালিমায় লিপ্ত হয়েছে উন্নয়নের কর্মসূচি।

তা সত্ত্বেও এবারের ভোটে তৃণমূল যদি উত্তরবঙ্গের কোনো আসনকে নিরাপদ বলে মনে করে থাকে, তাহলে সেটি হল জলপাইগুড়ি। কিন্তু নিরাপদ- এর তো কোনো সংজ্ঞা হয় না। আপনি শাসকদলের একজনকে নিরাপদ মনে করলেও অন্য আর একজন নেতা যে সমান নিরাপদ তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন, বারোপাটিয়ার উদীয়মান নেতা কৃষ্ণ দাস। সিপিএমে তাঁকে লালন করেছিলেন জিতেন দাস। তৃণমূলে তিনি বেড়ে উঠছেন সৌরভ চক্রবর্তীর প্রশ্রয়ে। যেমন বানারহাটে রাজু গুরুং। নদী থেকে যাঁরা বালি-পাথর তোলার ব্যবসা করেন, তাঁদের প্রতি এই দুই নেতার ভালোবাসা ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখার মতো। জলপাইগুড়িতে তাই সৌরভ চক্রবর্তীর শোকেস নিয়ে বেশ রসালো আলোচনা রয়েছে। জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে এরকম মহাপুরুষের সংখ্যা কম নয়। যেমন, ধূপগুড়ির রাজেশকুমার সিং, যিনি এলাকায় গুড্ডু নামেই খ্যাত। ওখানে অনেকে তো দেখলাম বলছেন, রাজেশই বকলমে পুরসভা চালান।

ওখানে আরও এক মহাপুরুষ রয়েছেন, যাঁর নাম অরূপ দে। কিছুদিন আগেই যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন পার্টি অফিসে এবং খোলা রাস্তায় প্রতিদ্বন্দ্বী এক ব্যবসায়ীকে পেটানোর জন্য। অর্থাৎ, আবার দেখুন সেই ভয়কেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা। এই মহাপুরুষকেই মযনাগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সভার মঞ্চে দেখা গিয়েছিল। এইভাবে তিনি গায়ে আইএসআই ছাপ লাগিয়ে নিলেন। শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্কেও আমি একই ছবি দেখেছি। কয়েকদিন আগে গ্রেফতার হওয়ার জন্য কাগজে যাঁর ছবি বেরিয়েছিল, তাঁকেও দেখলাম মঞ্চের আশপাশে ঘুরঘুর করতে। ব্যাস, সাত খুন মাফ। আবার শহরজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর লাইসেন্স। এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সমস্যা হল, তাঁদের কানে সব খবর পৌঁছায় না। অনেক খবর পৌঁছায় ফিলটার হয়ে। অতএব দলের নীচুতলা কখনও সংগঠন বিস্তারের মাধ্যম, আবার কখনও তা জনগণের থেকে দলকে বিচ্ছিন্নও করে দেয়। জনগণ ভাবছে, কার কথা কার কাছে বলব? রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে কে না ভয় পায়!

আর এর ফলে নোটবন্দির যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা, শতাধিক লোকের মৃত্যুর কাহিনি পিছনে চলে যাচ্ছে। জিএসটি নিয়ে ছোটো ব্যবসায়ীর দুর্দশার অভিজ্ঞতা আড়ালে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যে দেশের বেকারদের কোনো পরিসংখ্যান নেই সেটা মানুষ ভুলে যাচ্ছেন। মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা করছেন। কিন্তু সৌরভ চক্রবর্তীর সঙ্গে সৈকত চট্টোপাধ্যায়ের মতো আধানেতার গোলমালে সব বেকার হয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি ভাবেন এ শুধু জলপাইগুড়ির সমস্যা, তাহলে ভুল হবে। দিকে দিকে একই অসুখ। জলপাইগুড়িতে বিজয়চন্দ্র বর্মন অথবা অন্য অনেক আসনে তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না।

The post লোকসভা ভোটে তাড়া করছে পঞ্চায়েত ভোটের স্মৃতি appeared first on Uttarbanga Sambad | Largest Selling Bengali News paper in North Bengal.



from Uttarbanga Sambad | Largest Selling Bengali News paper in North Bengal http://bit.ly/2DfGN7Y

April 16, 2019 at 03:20PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top