ঢাকা, ০৪ এপ্রিল- বাঙালিকে তার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেননি যাঁরা, সন্জীদা খাতুন তাঁদের একজন। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সংস্কৃতজনদের নিয়ে আয়োজন করছিলেন কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের। নতুন দেশ পাওয়ার পর তার সাংস্কৃতিক পথরেখা নির্ধারণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সংস্কৃতিসাধনা ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন আজও। ৪ এপ্রিল ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুনের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিন সামনে রেখে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন জাহীদ রেজা নূর। প্রশ্ন: খুব শারীরিক ধকল গেল আপনার। তারপরও তো কাজ করেই যাচ্ছেন। এখন একটু বিশ্রাম নিলে হয় না? সন্জীদা খাতুন: সম্ভব না। কম কাজ করলে কাজ শেষ হবে কী করে? তাহলে তো কাজ শেষ হবে না। যেটা আমার কাজ, যেটা আমার কর্তব্য, তা থেকে আমি এক পা দূরে থাকতে পারি না। আমি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়েছিলাম, যাওয়ার আগে পয়লা বৈশাখে কী বলা হবে বটমূলে, তা ঠিক করে রেখে গেছি। মে মাসের প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে বক্তৃতা করতে হবে, সে লেখাটা ফিরে এসেই লিখতে শুরু করেছি। লিখে ফেলেছি। প্রশ্ন: কী বিষয়ে লিখছেন? সন্জীদা খাতুন: এটা লিখলাম রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে। কয়েকটি কবিতা অবলম্বন করে। রবীন্দ্রনাথ মাটি, মাকে কী চোখে দেখেছেন, তার ধারণা কী ছিল, মায়ের যে প্রতিরূপ সেটা তিনি আরোপ করেছেন বসুন্ধরার ওপর। দেখেছেন বসুন্ধরা আমাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় সারাক্ষণ ব্যাকুল, আমাদের সেবা করতে চান, আমাদের দুহাতে জড়িয়ে ধরে সব বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চান। এই যে বসুন্ধরার মাতৃরূপটা, এটা রবীন্দ্রনাথকে খুবই আকর্ষণ করত। বাস্তবে যাই হোক, বসুন্ধরা সব সময় মা নন, জানি। বহু দুর্যোগ আমরা পোহাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে এই যে একটা বিশেষ মাতৃমূর্তি বসুন্ধরা, এর ভেতরে রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসার ছবি আছে, মানুষের জন্য তাঁর দরদের ছবি আছে। সব মিলিয়ে কবিতা কটি রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে সহায়ক হবে। প্রশ্ন: জন্মদিনে কী করবেন? সন্জীদা খাতুন: এখন একটুখানি তো ক্লিষ্ট হয়ে আছি। তাই কীভাবে মানুষের সঙ্গে দেখা করব, তা ভেবে ঘাবড়ে যাচ্ছি। একটা কথা ভেবেছি, বিকেলের দিকে যদি ছায়ানটে একটা রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসে, তাহলে সেখানে সবাই এলে আমার সঙ্গে সবার দেখা হবে। এখনকার শরীরের অবস্থার জন্য ভালো লাগার চেয়ে সুস্থ হওয়ার কথাটা ভাবতে হয়, উপায় নেই। প্রশ্ন: এত দিন যা নিয়ে কাজ করলেন, তা তো আর বাস্তবে প্রস্ফুটিত হলো না সেভাবে। এ নিয়ে আক্ষেপ আছে? সন্জীদা খাতুন: প্রচণ্ড। প্রচণ্ড আক্ষেপ আছে। জীবনটা আজকাল এমন হয়েছে, সবাই মহাব্যস্ত, সবাই যে যার ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করতে ব্যাপৃত, কেউ পারছে না, নিজের কাজের অতিরিক্ত কিছু করে দেশের কথা ভাববে। যদি বলি, চলো আমরা যাই দূর কোনো প্রান্তে গিয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করাই, সাম্প্রদায়িকতা যে খারাপ জিনিস, সেটা যে আমাদের জন্য স্বাভাবিক নয়, এ কথাগুলো বলোলোক পাব না। এটা একটা মস্ত বড় দুঃখের কথা বলছি। সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে গেছে একটা কিছু প্রতিদান চাই। প্রতিদান না পেলে সে কোথাও যাবে না। গিভ অ্যান্ড টেক। সেবার মনোভাবটা একেবারে হারিয়ে গেছে। প্রশ্ন: মানুষ এ রকম হয়ে গেল কেন? সন্জীদা খাতুন: আসলে এ তোমার আমার ব্যাপার নয়, শুধু দেশের ব্যাপার নয়। এটা বিশ্বের ব্যাপার। সারা বিশ্বে যা ঘটছে, সেটা যে কোথা থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সেগুলো বুঝবারও ক্ষমতা ধরে না। আমরা কেবল অবস্থার শিকার হতে পারি। জীবনযাত্রাটা এখন এত দুরূহ হয়েছে যে মানুষ অন্যদিকে মন দিতে পারছে না। মানুষকে অন্যদিকে মন দিতে দেওয়া হচ্ছে না, বলতে হবে। অন্যভাবে তাদের ব্যস্ত রাখা হচ্ছে এবং পৃথিবী ধ্বংস হোক, তুমি শুধু নিজেরটুকু দেখো। তুমিও ধ্বংস হবে হয়তো, কিন্তু তাতে কী এসে যায়? নিজেরটুকু দেখে তৃপ্তিতে থাকো, শান্তিতে থাকোএই রকমের একটা কথা যেন বলা হচ্ছে। এখন কে করছে, কারা করছে, কীভাবে হচ্ছে অত বিশ্লেষণ করার সাধ্য আমার নেই। প্রশ্ন: ছিয়াশি হয়ে গেল, এখনো এত কাজ করে যাচ্ছেন, এই বয়সে এত কাজ করার আগ্রহ কীভাবে পান? সন্জীদা খাতুন: আমি তো সারা জীবন গান আর সাহিত্যচর্চা ছাড়া আর কিছু করিনি। আমি বড্ড একদিকে চলেছি। সংসারও সেভাবে মন দিয়ে করিনি। সংসার তার চাকায় একভাবে চলতে থাকে, আমার কাজ আমি করি। জসীমউদ্দীনের দিকে একটা ঝোঁক ছিল, তাঁর জীবনকথা পড়ে আমি মুগ্ধ ছিলাম। তাঁর অনেক গুণ আমাকে আকর্ষণ করেছে। কাজেই জসীমউদ্দীনকে নিয়ে না লিখে আমি পারিনি। নজরুল সম্পর্কে ছিল কৌতূহল। নজরুলকে গবেষণার মন নিয়ে পড়েছি। তাঁর গল্প রাক্ষুসী, তাঁর কবিতা, তাঁর যে বৈশিষ্ট্যগুলোএই নিয়ে কাজ করে আমার ভালো লেগেছে। নজরুলের গান আমি ভালোবাসি। এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমার আনন্দ হয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথ তো আমার চির আনন্দ। চিরকালই রবীন্দ্রনাথ পড়িয়েছি। রবীন্দ্রনাথের দেশভাবনা, স্বাধীনতার সংজ্ঞা এই জিনিসগুলো আমাকে এত বেশি আকৃষ্ট করেছে যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে না বলে, না ভেবে, রবীন্দ্রনাথের ভেতরে বাস না করে আমি পারি না। আর/০৮:১৪/০৪ এপ্রিল
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2CZgIK4
April 04, 2019 at 04:47PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন