ঢাকা, ০২ এপ্রিল- মঞ্চ ও ছোটপর্দার শক্তিশালী অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে তিনি এ জগতে পথ চলা শুরু করেন। তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা `লালজমিন`। মুক্তিযুদ্ধের আবহে রচিত মঞ্চ নাটকটির একমাত্র অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী। গত ২৬ মার্চ নাটকটির ২০৩ তম মঞ্চায়ন হয়। লালজমিন - এর প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ২০১১ সালের ১৯ মে। এতো অল্প সময়ে কোন একক মঞ্চ নাটক এতো বেশিবার প্রদর্শিত হওয়া বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের ইতিহাসে ব্যতিক্রম ঘটনা। লালজমিন- এর ২০৩ তম মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রেসক্লাবে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রেসক্লাব এ আয়োজন করে। লালজমিন নাটকটি রচনা করেছেন নাট্যকার মান্নান হীরা। নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। লালজমিন নাটকটি শুন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের একমাত্র পরিবেশনা। লালজমিন নাটকের শুরু ও পথচলার সফলতা প্রসঙ্গে মোমেনা চৌধুরী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কাছে। তিনি বলেন, আমি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে একটা কোর্স করেছিলাম। কোর্সটি করার পর থেকে আমার নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। আমার চিন্তার জগতে একটা ধাক্কা লাগে। আমি আমার নিজের ভেতর উপলব্ধি করতে থাকি কিছু একটা করা দরকার। এমন কিছু করা দরকার যার ফলে মানুষ লাভবান হবে, সমাজ লাভবান হবে। যার একটা সুদূর প্রসারী প্রভাব সমাজে পড়বে। অতীতে ফিরে গিয়ে মোমেনা চৌধুরী বলেন, তখন আমি নিয়মিত মেডিটেশন করি। আর নিজের ভেতর নিজে তাড়না অনুভব করি। সেই তাড়না হলো কিছু করা দরকার, জীবনটাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো দরকার। এমনটি আগে কখনো অনুভব করিনি। আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন অনুভূতি আগে কখনো হয় নি। তিনি বলেন, একদিন আমি আমার চিন্তাটা নাট্যকার মান্নান হীরা`র সাথে শেয়ার করি। মান্নান ভাইয়ের সাথে আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। একসাথে আরণ্যকে কাজ করেছি। মান্নান ভাই বললেন, আপনি কী করতে চান? আমি বললাম, আমি কী একক করতে পারি? মান্নান ভাই বললেন, একক করার জন্য এটাই আপনার উপযুক্ত সময়। একক করার জন্য সবচেয়ে বেশী দরকার অভিজ্ঞতা। সেটা আপনার আছে। বয়সটাও উপযুক্ত। আপনি করতে পারেন। লালজমিন কেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল এমন প্রসঙ্গে মোমেনা চৌধুরী বলেন, আমি মান্নান ভাইকে বললাম, তাহলে তো আপনাকে লিখতে হবে। তিনি প্রথমদিকে রাজী হননি। এরপর রাজী হলেন। কিন্তু লিখতে দেরী করছিলেন। হয়তো মান্নান ভাই নিজেও ভাবছিলেন, আমি পারব কিনা। যাই হোক, এক পর্যায়ে তিনি লিখতে শুরু করলেন। আমরা বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, যাই করিনা কেন, একেবারে মৌলিক কিছু করব। একেবারে শেকড়ের কথা বলব। শেকড় মানেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনও আমাদের শেকড়। আমরা মুক্তিযুদ্ধকেই বাছাই করলাম। লালজমিন নাটকটি শুন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের একমাত্র পরিবেশনা। শুন্যন প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোমেনা চৌধুরী বলেন, মান্নান হীরা যখন লালজমিন লিখছেন তখন প্রশ্ন আসল, আমরা কাজটা কোথা থেকে করবো? বা কোন প্লাটফর্মে করবো? এর আগে আমি আরণ্যক- এ কাজ করেছি দীর্ঘদিন। কিন্তু যে কোন বড় কাজ করতে গেলে সমস্যা হল সম্মতির ব্যাপার থাকে। নানা ধরনের সিস্টেম থাকে। এতে সময়ক্ষেপন হয়। তখন আমি ভাবলাম, নিজেরা একটা দল করলে কেমন হয়। রেপার্টরি থিয়েটার। মামুনুর রশীদ সাহেবের একটা দল ছিল, বাংলা থিয়েটার। উনিই রেপার্টরি থিয়েটারের পথ দেখিয়েছেন। মামুন ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। বললাম, মামুন ভাই আমি একটা একক পারফর্মেন্স করতে চাচ্ছি। হীরা ভাই লিখছেন। তিনি বললেন, গুড। তিনি জিজ্ঞেশ করলেন, কোথা থেকে করবা? বললাম, আমি একটা রেপার্টরি দল করতে চাচ্ছি। মূলত এভাবেই শুন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের যাত্রা শুরু। শুন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের নামকরণ প্রসঙ্গে মোমেনা চৌধুরী বলেন, শুন্যন রেপার্টরি থিয়েটার নামটি একজন বিশিষ্ঠ মানুষের দেওয়া। তিনি হলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ আল বোখারী মহাজাতক। আমি নিজেই কয়েকটা নামের তালিকা নিয়ে তার কাছে যাই। `শুন্যন` নামটাও সেই তালিকায় ছিল। তিনি জিজ্ঞেশ করলেন, কী কী নাম নিয়ে এসেছেন। তালিকা দেখে তিনি `শুন্যন` নামটাই পছন্দ করলেন। শুন্য থেকে আমাদের উৎপত্তি, শুন্যেই আমাদের বিনাশ। শুন্যেই সব সৃষ্টি হয় আবার সব শুন্যে মিলিয়ে যায়। তার পছন্দানুযায়ী আমি শুন্যন রেপার্টরি থিয়েটার নামকরণ করি। লালজমিন নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। মোমেনা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, লালজমিন লেখা হওয়ার পর আমরা সুদীপ কে সিলেক্ট করি। আমাকে এ পরামর্শটি দিয়েছেন সুবচন এর গিয়াস। ও বলল, তুমি সুদীপকে নিয়ে কাজ কর। খুব ভাল হবে। সত্যি কথা হচ্ছে, আমি তখনো সুদীপ- এর কোন কাজ দেখিনি। `মহাজনের নাও` করেছে। আমার মেয়ে নভেরাকে পাঠালাম দেখার জন্য। মেয়ে দেখে এসে বলল, তুমি ওনাকে নিয়ে কাজ কর। এভাবেই সিলেক্ট হয়ে গেল সুদীপ চক্রবর্তী। লালজমিন- এর প্রথম পার্ট এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোমেনা চৌধুরী বলেন, প্রথম যেদিন পার্ট হল তারপর থেকে তিনদিন ভয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছিলাম। যাক, এরপর ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করি। আমার মেয়ে নভেরা, সুদীপ, হীরা ভাই- এদের সকলের সাহসে আমি সাহসী হয়ে উঠি। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবী সাহসী মানুষের জন্য। আমি সবসময় সাহসী ছিলাম। যা শুরু করতাম তার পেছনে লেগে থাকতাম। কখনো হাল ছেড়ে দিতাম না। আমার একটা ভাল গুণ হলো, আমি লেগে থাকতে পারি। লালজমিন - এর প্রথম মঞ্চায়ন নিয়ে মোমেনা চৌধুরী বলেন, এক মাস সাতাশ দিনের মাথায় - অর্থাৎ ১৯ মে নাটমণ্ডলে লালজমিন- এর প্রিমিয়ার শো করি। ২০ মে আমরা পাবলিক শো করি এক্সিপিরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। প্রথম শো`তেই বুঝতে পারি নাটকটি পাবলিক গ্রহণ করছে। এই গ্রহণযোগ্যতার ফলেই সাত বছর আট মাসের মাথায় লালজমিন ২০৩ বার মঞ্চায়ন হয়েছে। গ্রুপ থিয়েটারের অন্যকোন নাটক এত অল্প সময়ে হয়নি। দু`একটি নাটক হয়েছে অনেক। কিন্তু এত অল্প সময়ে একক অভিনীত কোন নাটক মঞ্চস্থ হওয়া ব্যতিক্রম ঘটনা। মোমেনা চৌধুরী বলেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশ- এ একটা মেডিটেসন কোর্স হয় চারদিনের। এটা মানুষের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে দেয়। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, অনেককিছু জানি কিন্তু মানি না। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কোর্স কেন মানব সেটাই আমাদের শেখায়। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এই কোর্সটা আমাদের জীবনটাকে একটা ইতিবাচক দিকে নিয়ে গেছে। হতাশা নেই, দু:খ নেই, কষ্ট নেই। সবকিছুকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে মোকাবেলা করার যে শক্তি তা পাই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চারদিনের কোর্সে। মোমেনা চৌধুরী আরও বলেন, যে মানুষ নিয়মিত মেডিটেশন করে তার প্রাণশক্তি থাকে প্রচুর। আমার প্রাণশক্তি আল্লাহর রহমতে প্রচুর। তাছাড়া নানান অসুখ বিসুখ জয় করা যায় মেডিটেশনের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী বলেন, একসময় আমার মাসে বিশ দিন মাথা ব্যথা থাকত। মেডিটেশনে চার দিনের কোর্স করে আমি সেই মাথা ব্যথা থেকে মুক্ত হয়েছি। একসময় ঘুমের ট্যাবলেট ছাড়া আমার ঘুম হতো না। কিন্তু মেডিটেশনের কোর্স করার পর আমি ঘুমের ট্যাবলেট ছেড়েছি। আল্লাহর রহমতে এখন আমার ভাল ঘুম হয়। আমি এখন আমার সবকাজে কোয়ান্টামকে সাথে রাখি। কোয়ান্টামের সবকিছুতে আমি সাথে থাকি। প্রসঙ্গত মোমেনা চৌধুরী গত তিন দশক ধরে এ দেশের ছোটপর্দা, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে আসছেন। অসংখ্যা জনপ্রিয় নাটক ছাড়াও তিনি হালদা, নদীজন, একাত্তরের ক্ষুদিরাম, অনিশ্চিত যাত্রা, স্বপ্নডানা ও নাইওরসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার লালজমিনবাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়। আর/০৮:১৪/০২ এপ্রিল
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2WEPm3k
April 02, 2019 at 03:01PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন