কলকাতা, ২৩ মে- চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য নীলাভ সমুদ্র-সফেন পোশাকে গাড়ি থেকে নামলেন এ কালের বনলতা সেন। উপচে পড়ল জনতার ভিড়। একটা নিজস্বী। একটু ছুঁয়ে দেখা। এক ঝলক কথা। এ-টুকু উষ্ণতা নিয়েই প্রোলেতারিয়েত চোখগুলো সমস্ত দিনের শেষে ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মেখে ফিরে যাবে বাড়ি। নায়িকা-দর্শন, বড় কম কথা নয়। সামনাসামনিও একেবারে টিভির মতোই, দেখো! তুলোর মতো রং! বাগান কোড়ানো ফুল নায়িকার হাতে দেওয়ার মুহূর্তে বিস্ময় ঝরে পড়ল দুই মধ্যবয়সি মহিলার চোখে। আর তিনি! এত গরমেও আবেগ ছড়ালেন নায়িকার মতোই। মেপে। বুঝে। দূরত্ব এবং না-দূরত্বের ভারসাম্য বজায় রেখে। মিমি এলেন, দাঁড়ালেন, জয় করলেন রুপোলি রঙে। নির্বাচনী রোড-শো, নাকি উৎসব? যাদবপুরের তৃণমূল প্রার্থী মিমি চক্রবর্তীর সমর্থনে যে শোভাযাত্রার আয়োজন হয়েছিল ১০০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে, দৃশ্যত তার সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় সুরুচি সঙ্ঘের পুজোর আয়োজনের। একের পর এক ম্যাটাডরে হাজার হাজার তেরঙা বেলুন। সকাল আটটাতেও রাস্তার অর্ধেক জুড়ে ডজনখানেক ঢাক। বাদ্যির তালে তালে পেশাদারি নাচ। তারই মধ্যে উৎসব প্রাঙ্গণে এলেন যাদবপুরে তৃণমূলের ভোট-সেনাপতি মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। যদিও সেনাপতি শব্দে মন্ত্রীমশাইয়ের ঘোর আপত্তি। আমি কর্মী। বেশিও নই। কমও নই। হুডখোলা জিপে নায়িকাকে সঙ্গে নিয়ে নমস্কার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শুরু হল বাইকের ভিড়ে আগা-মুড়ো হারিয়ে যাওয়া বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। যাদবপুরে মিমিকে রেকর্ড ভোটে জেতাব। দুদিকের সার বাঁধা বারান্দায় নমস্কার ছুড়ে দিতে দিতে জানালেন অরূপ। কথা বলতে বলতেই আঙুল তুলে মিমিকে দেখাতে থাকলেন হাতের তালুর মতো চেনা যাদবপুরের এ অঞ্চলে কোন বারান্দায় কটা ভোট। রেকর্ড ভোটে জেতানোর স্ট্র্যাটেজিও প্রতিদিন তৈরি করছেন অরূপ। সকালে রোড শোয়ের পর দুপুরে কর্মীদের নিয়ে বৈঠক। সেখানে পাত পেড়ে খেতে খেতেই শুনে নেওয়া বিপক্ষের প্রার্থীরা কে কী বলছেন। বিজেপি-সিপিএম নিয়ে কোন এলাকায় কী চর্চা। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে পাল্টা স্ট্র্যাটেজি। মিমি কী বলবেন। কর্মীরা কী করবেন... সকালের রোড-শো গড়াল দুপুরে। বিকেলে আসরে নামলেন বিজেপির মাচো বয়। বিজেপিতে নবাগত যাদবপুরের দলীয় প্রার্থী অনুপম হাজরাকে নিয়ে দলের ভিতরেই নানা গুঞ্জন। কেউ ভালবেসে ডাকছেন মাচো বয়। কেউ আবার বলছেন, কেষ্টকাকুর সঙ্গে দেখা করে তৃণমূলকে ওয়াক ওভার দিয়েছেন গদ্দার। হাওয়ায় ভাসছে কর্মীদের ক্ষোভ। বাজারে, দোকানে, অফিস-ফেরতা অটোয় কান পাতলেও অনুপম-অনুব্রত মোলাকাত নিয়ে হাসিঠাট্টা শোনা যাচ্ছে। বাতাসে প্রশ্ন, কোন সমীকরণে বোলপুর থেকে যাদবপুরে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন অনুপম? আর্দ্র বিকেলে মুখে সান-স্ক্রিনের প্রলেপ দিয়ে হুড খোলা জিপের সামনে এলেন প্রার্থী। মহামায়াতলা মোড়ে রিকশাচালক থেকে স্কুল-ফেরতা ছাত্রী, দলের মহিলা ব্রিগেড থেকে বাইক আরোহী সেলফি নিলেন নিজের হাতে। সাংবাদিককে জানিয়ে দিলেন, সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে ২৩ তারিখ। তৃণমূলের মডেলেই তৃণমূল বধ হবে যাদবপুরে। দেখে নেবেন। অনুপমের রোড শো ঝুলনের মতো। হুডখোলা জিপ-চালকের অভিনন্দন গোঁফ, মাথায় পাগড়ি। সামনে ম্যাটাডরের মাথায় বিশাল পদ্ম। পাপড়ির গোড়ায় গোড়ায় টুনি। সামনে-পিছনে ঝান্ডাওয়ালা বাইক। দলীয় নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে জিপে উঠলেন প্রার্থী। শুরু হল নমস্কার আর হাত নাড়ানোর পরিচিত আলেখ্য। আর তিনি? সন্ধের মুখে গড়িয়া স্টেশনে উকিলের এসইউভি রেখে প্রচারাভিযানে চলে গিয়েছেন সোনারপুরে। নবগ্রামের কাছে পৌঁছে দেখা মিলল কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের। সামনে পিছনে পদব্রজে লাল ঝান্ডা। আর সিপিএম প্রার্থী বিকাশ ভট্টাচার্য ছাদহীন টোটোয়। হাঁচড়-পাঁচড় করে মিছিল ঘুরছে কখনও পাকা, কখনও কাঁচা রাস্তার অলি-তস্য গলির পাকস্থলীতে। স্ট্র্যাটেজি? মিছিলের ধারের দোকান থেকে বাড়ানো চা হাতে নিয়ে বিকাশবাবু বললেন, বামপন্থায় মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। এই মুহূর্তে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে বামপন্থার অবস্থা যে দৃশ্যত টোটোর হাঁচড়-পাঁচড়ের মতোই, সে কথা অতি বড় বামপন্থীও মানেন। ২০১৪ সালে ১ লক্ষ ২৫ হাজার ভোটে সুগত বসুর কাছে এই কেন্দ্রে হেরেছিলেন সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী। আর ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুরের ৭টি বিধানসভা অঞ্চলের ভোট যোগ করলে তৃণমূলের থেকে অন্তত ১ লক্ষ ভোটে পিছিয়ে সিপিএম। একমাত্র আশাভরসা যাদবপুর বিধানসভা। সুজনবাবু সেখান থেকেই বিধায়ক। অথচ যাদবপুর আর দমদমের কলোনি বামপন্থা এক সময় রাজ্য রাজনীতির মডেল ছিল। আদ্যপান্ত রাজনৈতিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই কেন্দ্র সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে জিতিয়ে এনেছে এক সময়। আবার সেই যাদবপুরই বামপন্থার চূড়ান্ত সময়ে লাল ঝান্ডাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আশীর্বাদ করেছে। এখানে কৃষ্ণা বসু, সুগত বসুর পাণ্ডিত্য ভোট পেয়েছে। আবার কবীর সুমনের নাগরিক প্রতিবাদও সম্মান পেয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি বামপন্থা, হোক কলরব আন্দোলন, এইট বি বাস স্ট্যান্ডের স্ট্রিট কর্নার, কফি হাউসের লিটল ম্যাগ সব মিলিয়ে যাদবপুর বরাবরই একটা প্যাকেজ। ভুল হচ্ছে। ধরিয়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। তিনি এই লোকসভার ভোটারও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিকতা এই কেন্দ্রের ভোট নয়। ফলে হোক কলরবের ছাপ এখানকার ভোটে দেখতে পাওয়ার কথা নয়। আর বামপন্থী যে মিথের কথা বলছেন, পরিবর্তন পর্বে তা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। তছনছ হয়ে যাওয়া সেই সংগঠনকে জোড়া লাগিয়ে বিকাশবাবু ১ লক্ষ ভোটের ব্যবধান মেটাতে পারবেন, এমনটা মনে হয় না। অধ্যাপককে কার্যত সমর্থন করেন প্রবীণ বামপন্থী নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মতে, শহরে কিছু ভোট বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও গ্রামাঞ্চলে বামপন্থী ভোট ফেরানোর মতো সংগঠন এখনও তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। যদিও বিকাশবাবুর দাবি, ভাঙড় আন্দোলন ওই অঞ্চলের ভোটারদের বামমুখী করেছে। আন্দোলনকারীদের সমর্থনও আছে সিপিএমের সঙ্গে। বারুইপুর-সোনারপুরেও তাই ভাঙড়-অস্ত্রই প্রচারে ব্যবহার করছেন সিপিএম প্রার্থী। কত ভোট? পাল্টা চ্যালেঞ্জ অরূপের। পুরসভার হিসেব দেখুন। এ বারের ভোটে যাদবপুর বিধানসভাও বামেদের হাত থেকে স্বাধীন করব আমরা। আর বিজেপি? প্রচারে তৃণমূল বলছে বাম ভোট রামে যাচ্ছে। বিজেপি বলছে, মোদী হাওয়ায় তৃণমূলের ভোটেও ভাঙন ধরেছে। সিপিএম কিছুই মানছে না। আর ভাঙড় থেকে বারুইপুর, যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাধারণ মানুষের যে ছবি খালি চোখে ধরা পড়ে, বাকি রাজ্যের বহু জায়গার মতো মেরুকরণের ঘূর্ণি হাওয়া তাতে ধরা পড়ে না। মানুষের মেজাজ কি তবে মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন? সূত্র: বিডি২৪লাইভ আর এস/ ২৩ মে
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2VGT2kd
May 23, 2019 at 10:28AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন