মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বগুণ ক্রিকেট বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত। তার নেতৃত্বের মুন্সীয়ানা ও ক্রিকেটারদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেশের ক্রিকেট ক্রমাগত নতুন উচ্চতায় আসীন হচ্ছে। সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে প্রথমবার ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি জিতে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। ১০ বছরে ছয়টি ফাইনাল, হৃদয়ভাঙা হারের গল্প পেরিয়ে সপ্তম অভিযানে ট্রফির সন্ধান পেয়েছে মাশরাফির দল। আয়ারল্যান্ড থেকে সংক্ষিপ্ত ছুটিতে দেশে ফেরা বাংলাদেশ অধিনায়ক আজ সকালেই আবার লন্ডনের উদ্দেশ্যে বিমানে চড়বেন। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত মিশনে যাওয়ার আগে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের সাফল্যের রসায়ন সম্পর্কে সবিস্তারে বলেছেন মাশরাফি। প্রশ্ন : ছয়টা ফাইনাল হারের পর ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রথমবার ট্রফি জিতলেন। এই ট্রফি জয়ের মূল্যায়ন আপনি কিভাবে করবেন? একটা বড় টুর্নামেন্টের আগে জিতছি। ভালো হয়েছে আত্মবিশ্বাসটা। আলাদা মূল্যায়ন আসলে এসব আর থাকে না। একটা জিনিস পাওয়ার পরে আর অতো বেশি কিছু খেয়াল থাকে না। প্রশ্ন : বহুজাতিক সিরিজে প্রথম ট্রফি জিতল বাংলাদেশ আপনার নেতৃত্বে। ঐতিহাসিক এই ট্রফি জয়ে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারাটা নিজের জন্য কতটা গর্বের? আমি নিশ্চিত সবাই ভালোবোধ করছে, প্লেয়াররা সবাই। বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থক যারা আছে, তারা সবাই। আমার জন্য আলাদা গুরুত্বপূর্ণ না। আমি তো আগেও বলেছি, আমি আসলে এত বেশি চাওয়া-পাওয়ার ভেতরে থাকি না। যেটা পাই, যেটা আছে নসিবে সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট। প্রশ্ন : অনেকদিন ধরেই নির্দিষ্ট সংখ্যক প্লেয়ার নিয়ে চলছেন। এদেরকে সমর্থন করছেন। এটা কি দলটাকে আরো আত্মবিশ্বাসী করছে? এর থেকে ভালো অপশনস আমাদের নাই, যেটা সত্যি কথা। যারা আছে, তারাই হচ্ছে বর্তমান সময়ের সেরা অপশনস। বাইরে যে ২-৫ জন যারা আছে এদের থেকেই আমার মনে হয় এরা সেরা অপশনস। প্রশ্ন : ফাইনালে বড় টার্গেটের পর ব্যাটিংয়ের পরিকল্পনাটা কি ছিল? সৌম্য, মোসাদ্দেকের দুটি ইনিংস সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন... পজেটিভ খেলা ছাড়া কোনো অপশনস ছিল না। কারণ প্রায় ৯ করে রান রেট ছিল। তখন শুরুতে ৫ ওভার ব্যবহার বিষয় ছিল। সৌম্য অসাধারণ শুরু করেছে, তামিমও ভালো সঙ্গ দিচ্ছিল। ৫০ রানের জুটি হয়ে গিয়েছিল। অতি দ্রুত রান হয়েছে। ওইটা আসলে টোনটা সেট করে দিয়েছে। মাঝখানে খেলা সমান-সমান চলছিল। কিছু উইকেট পড়াতে হয়তো একবার ওদের দিকে, আরেকবার আমাদের দিকে আসছিল। কিন্তু মোসাদ্দেক শেষটা করেছে অনন্য। হয়তোবা একটা ওভারে খেলা আমাদের দিকে নিয়ে আসছে, তবে শুরু থেকেই ও বেশ দাপুটে ব্যাটিং করেছে। প্রশ্ন : যদিও ফাইনাল শেষ করেই চলে এসেছেন। তারপরও এই ট্রফি জেতার পর দলের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই, কতটা উজ্জীবিত সবাই? দলের সবাই ভালো আছে। ছোট-খাট ব্যথা আছে। এই ছাড়া দলের সবাই ভালো আছে। আশা করি সবাই ফিট থাকলে ভালো বিশ্বকাপের জন্য। এমনি সবাই চাঙ্গা আছে। সবাই ভালো আছে। প্রশ্ন : আপনি আগেও বলেছিলেন, বিশ্বকাপের আগে একটা ট্রফি জেতা দরকার। ফাইনালের মানসিক বাধাটা পার হওয়ার জন্য... সেটা ফাইনালের ক্ষেত্রে। আমরা ছয়টা ফাইনাল খেলছি, হারছি। ওই যে জায়গাটা, ওখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারছিলাম না। এবারো একটু কঠিন সময়ে জিততে হয়েছে কি, একটু সুবিধা হয়েছে যে, এমন অবস্থা পরবর্তী সময়ে ফাইনালে আসলে ছেলেরা এতটা পাজলড থাকবে না। প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় এখন সেটেলড মিডল অর্ডার পেয়ে গেছেন... হ্যাঁ, আমি তো মনে করি পুরোপুরি ঠিক আছে। আর যদি নাও থাকতো তা আমার বলার সুযোগ ছিল না। বিশেষ করে টুর্নামেন্টের ১০-১২ আগে। কিন্তু আমি নিশ্চিত মিডল অর্ডারে এর চেয়ে ভালো অপশনস আর নাই। যারা বাইরে আছে, ১-২ জন হয়তো আছে। তবে এর চেয়ে ভালো অপশনস নাই। প্রশ্ন : সাকিব না থাকার পরও আমরা দেখলাম ফাইনালে মিডল অর্ডারে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। এটাই প্ল্যান যে এদেরকে সমর্থন করা এবং তাদের জায়গা ঠিক করে দেয়া... শতভাগ। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরাও এটা শতভাগ ফিল করবে। প্রত্যেকটা প্লেয়ার তার অবস্থান চিন্তা করে, যে আমার অবস্থানটা শক্ত আছে কিনা। যখন অবস্থানটা শক্ত থাকে তখন হয় কি, পারফর্ম করতে সুবিধা হয়। ডেলিভার করতে সুবিধা হয়। আমি নিশ্চিত সাকিব না খেলাতে, একটার জায়গায় অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় দলে। এক্ষেত্রে এবার হয়নি। যদিও বোলিংটা একটু দুর্বল ছিল। তারপরও আমরা মিডল অর্ডারে নড়াচড়া করিনি। এই জায়গাগুলোতে শক্ত থাকায় আমি নিশ্চিত যে, ওরা আরো ভালো বোধ করবে। প্রশ্ন : আপনি বলেছেন আপনি ট্রফির জন্য খেলেন না। ট্রফি দিয়ে আপনাকে মূল্যায়ন না করতে। তারপরও একটা ট্রফি জেতার পর কেমন লাগছিল? সত্যি কথা আমার কোনো ফিল হয়নি। শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলে লাভ নাই। আমার ভেতরে যে ফিলিংস, সেটাই বললাম। প্রশ্ন : ট্রফি নিয়ে আপনার হাসি... এখন ম্যাচ হারের পর তো আপনি খিলখিলিয়ে হাসতে পারবেন না। ম্যাচ জিতলেই আপনি হাসবেন। প্রশ্ন : রাহী-লিটন আগের ম্যাচের সেরা পারফরমার হয়েও পরের ম্যাচে ড্রপ। এটা কি একটা বার্তা যে, আমাদের বেঞ্চ পাওয়ারটাও এখন শক্তিশালী... শতভাগ। আমরা যে মাইন্ড সেটআপ নিয়ে ওখানে গেছি, ওখানে শেষ পর্যন্ত ওই অবস্থানে ছিলাম। এটা হয়তোবা একটা প্লেয়ারের জন্য ভালো লাগার ব্যাপার। আবার যে রান করেও খেলতে পারেনি, তার জন্যও কিন্তু ভালো ফিল। তার মনে থাকবে, পরবর্তী যে মানুষটা সুযোগ পাবে, সেটা আমি। সৌম্য রান করেছে প্রথম দুই ম্যাচে, আমরা আবার সৌম্যর কাছেই ফিরে গেছি। সৌম্য ইনজুরিতে না পড়লে হয়তো তিন নম্বর ম্যাচটাও খেলতো। কিন্তু আমাদের আবার দেখার ব্যাপারও ছিল। লিটনকে সুযোগ দেয়ার ব্যাপার ছিল। আল্লাহ না করুক বিশ্বকাপে গিয়ে অন্য কারো ২-৩ ম্যাচ সমস্যা হতে পারে, লিটনকে খেলানো দরকার ছিল। লিটন খেলে রান করে যেটা হয়েছে যে, লিটন জানে যে, নেক্সট ম্যান ইজ মি। রাহীও জানে যে, নেক্সট ম্যান ইজ মি। একইভাবে আমরা সবাই সুস্থ থাকার পরও আমরা আমাদের মূল প্রসেসে ফিরে গেছি। রুবেলকে শেষ ম্যাচে ১৩ জনে রাখছি। আমরা সাইফউদ্দিনে ফিরে গেছি। এটা হচ্ছে আমার কাছে মনে হয় রেগুলার প্রসেস। এটাই হওয়া উচিত। অন্যান্য দলগুলো এটাই করে। আমাদের এটার ঘাটতি ছিল। আমরা এই টুর্নামেন্টে এটা করতে পারছি। এটা করতে পারার পেছনে আসলে ওরা পারফর্ম করেছে আরো সুবিধা হয়েছে, এটাও সত্যি কথা। তবে এই মেসেজটাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন : লিটন-রাহীরা যদি পারফর্ম না করতো, তাহলেও তো এটাতে ঠিক থাকা উচিত... অবশ্যই এখানে ঠিক থাকা উচিত। কারণ আপনাকে বিশ্বকাপে একটা প্ল্যান সেট করতে হতো যে, কে আপনার ইলেভেন, এটা ঠিক করতে হবে। আপনি ফাইনালে গেছেন, ফাইনালে আপনার তাদেরকেই খেলানো উচিত, যারা আপনার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ইলেভেনে থাকতে পারে। প্রশ্ন : রুবেলকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। রুবেলকে বসিয়ে রাখা, তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর বিষয়টা........... আমরা তো চারটা পেস বোলার খেলাতে পারছি না। সাইফউদ্দিন অসাধারণ ডেথ বোলিং করছে। ওই জায়গায় কনসিডার করে সাইফউদ্দিনকে রাখা হচ্ছে, সাথে ও ব্যাটিং পারে। সবচেয়ে বড় কনসিডারেশন হচ্ছে, সাইফউদ্দিন অসাধারণ ডেথ বোলিং করছে। এখন মুস্তাফিজের চেয়েও অনেক ভালো ডেথ বোলিং করছে। বিশেষ করে সব কন্ডিশনেই এখন। এই একটা কারণ। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে রুবেলের সঙ্গে তুলনার সুযোগ নেই। রুবেল পারফরমার। রুবেল ইনজুরড আছে। রুবেল একটা ইনজুরি নিয়ে চলছে, যেটা ঢাকা লিগ থেকেই ক্যারি করছে। যারা হয়তো ঢাকা লিগ ফলো করে না, হুট করে জাতীয় দলের খেলা দেখতে বসে বলে উঠে, রুবেল নেই। তারা তো মূল ঘটনা জানে না। দেখা গেল শেষ ১৫-২০ দিন রুবেল কি বয়ে বেড়াচ্ছে, এটা তারা জানে না। অনেকে না জেনে একটা কথা বলে ফেলে। সেটা তো হবে না। আসলে, আপনারাও জানেন রুবেল সাইড স্ট্রেইন ক্যারি করছে লাস্ট দেড় মাস। আর ওখানে ঠান্ডা, ঠান্ডার জায়গায় সাইড স্ট্রেইনের রিস্ক আরো বেশি থাকে। ওকে তো মানিয়ে নেয়ার সময় দিতে হবে এবং রুবেলের সঙ্গে কথা বলে, ও কেমন ফিল করছে, ফিজিও সেভাবে কাজ করছে রুবেলের সাথে। প্রশ্ন : আমরা ৩০০ রান কম করি, চেজ করাও কঠিন। এখন ফাইনাল জয়ের পর কি বলা যাবে যে, আমরা ৩৩০-৩৪০ এর পরিকল্পনায় আসতে পারবো... যেমন দেশ, তেমন বেশ। হিসেবটা এখন ওই রকম করতে হবে। আমরা করি না বলে যে, করতে পারবো না চিন্তা করি, তাহলে আমরা টুর্নামেন্টে কোথাও যেতে পারবো না। করতে পারিনি, করিনি এটা এক জিনিস, আর এখন করতে হবে এটা আরেক জিনিস। ওই মাইন্ড সেটআপ নিয়েই থাকতে হবে যে, ৩০০ করি বা ৩৩০ করুক, ৩৫০ হয়তোবা একটু দূরে হয়ে যায়, সেটা হবে আউটস্ট্যান্ডিং পারফরম্যান্স। কিন্তু ৩০০, ৩২০-৩৩০ আমাদেরকে মাইন্ড সেটআপে রাখতেই হবে। করতে হবে আগে ব্যাটিং করতে গেলে, আবার চেজ করতে গেলেও ওই রান করতে হবে। প্রশ্ন : আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার আগে আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণেও। কিন্তু আয়ারল্যান্ডে ৬ উইকেট নিয়ে আপনি ও মুস্তাফিজ বাংলাদেশের সেরা বোলার। এসব নেতিবাচক আলোচনা কি আপনাকে উৎসাহিত করে যে, আমাকে তাদেরকে ভুল প্রমাণ করতে হবে... (হাসি) আমি আসলে কাউকে ভুল প্রমাণ করার সুযোগ খুঁজি না। আমরা তো নেতিবাচকই সবসময়। ধরেন এই টুর্নামেন্ট জিতছেন, বলবে জিতছে তো বি টিমের সাথে, সি টিমের সাথে। নিজেদের ছোট করে রাখতেই আমরা পছন্দ করি। এ নিয়ে সত্যি বলতে আমার ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথে কোনো যুদ্ধ নাই, কোনো কিছু নাই। আমি তো মনের আনন্দেই খেলতাম, খেলি। আমার কাজ যেটা, আমি সেটাই করি। এতদিন ১৮ বছর ধরে তো আমার কাজ কেউ করে দেয়নি। এখনো করে দিবে না। আর ২-৪টা, ৫-১০ হাজার কথার জন্য যে আমার সবকিছু মানসিকভাবে পরিবর্তন করে ফেলতে হবে সেটাও না। আমার ক্রিকেটের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এর চেয়ে অনেক কঠিন। ওই সব যুদ্ধ করে আসার পরে এগুলো আসলে কিছু না। আর এস/ ২২ মে



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/30C7w8D
May 22, 2019 at 08:47AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top