লন্ডন, ১৮ জুন- শীতল বরফ খণ্ডও কখনও কখনও ছুরি হয়ে যায়, যদি সেটা চালানোর কৌশল জানা থাকে; মাথা ঠাণ্ডা রেখেও আগুন জ্বালানো যায়, যদি তারও কৌশল জানা থাকে। গতকাল টনটনে সেই কৌশলগুলোই একে একে জাদুকরের মতো মঞ্চস্থ করলেন সাকিব আল হাসান। ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিপক্ষের বুকে যেন সেই ছুরিটিই চালালেন। ৭ উইকেটের হার, তাও আবার ৫১ বল হাতে রেখে- ম্যাচের পর শুকনো মুখে হোল্ডারের স্বীকারোক্তি- সাকিবের কাছেই হেরে গেলাম আমরা। টানা দুটি সেঞ্চুরি করলেন, দলকে জেতালেন, বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ স্কোরার হলেন (৩৮৪ রান), ম্যাচসেরার পুরস্কার নিলেন; কিন্তু চারপাশের জয়োধ্বনির উচ্ছ্বাস কিংবা স্তুতিতে গা ভাসালেন না। এখনও আমাদের চারটি ম্যাচ কিন্তু বাকি... সেমির স্বপ্ন বাঁচিয়ে লাজুক হাসিতে মনে করিয়ে দিলেন পরের ম্যাচই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। ম্যাচের পর ড্রেসিংরুম থেকেই মোবাইলের স্ট্ক্রিনে চোখ ছিল মাশরাফির। খুঁজছিলেন পয়েন্ট তালিকায় কখন পাঁচ নম্বরে উঠবে বাংলাদেশের নাম। প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে এতটা দাপুটে জয়, প্রেসবক্সে থাকা ব্রিটিশ সাংবাদিকরা বিস্মিত ছিলেন- এমন বাংলাদেশকে আগে দেখেনি তারা। মাঠ যতই ছোট হোক ৩২১ রান তাড়া করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তার ওপর আবার ঘণ্টায় একশ চল্লিশ কিলোমিটার গতির বোলার একাগাদা। বিরতির সময় কি ভেবেছিলেন, ম্যাচটি জেতা সম্ভব- এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল সাকিবের কাছে। উত্তরে সাকিব, আমরা কখনোই প্যানিক হইনি। সবাই ধরেই নিয়েছিলাম, এই রান তাড়া করা সম্ভব। আমাদের এই দলটি এখন আর কোনো কিছু নিয়ে প্যানিক হয় না। ঠিক এখানেই গতকাল ম্যাচ জিতে গেছে বাংলাদেশ। সৌম্যর ওই প্যারিস্কুপ খেলতে গিয়ে ২৯ রান করে আউট হয়ে যাওয়া, কিংবা কটরেলের হিংস্র থ্রোতে ৪৮ রানে তামিমের পড়ে গিয়ে রানআউট হওয়া, মুশফিকের ১ রানের খারাপ দিন যাওয়া- কোনো কিছুতেই কোনো ধরনের আতঙ্ক ছড়ায়নি বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে; বরং লিটন তার বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচে যা খেললেন, তাতে দারুণভাবে খুশি সাকিব নিজে। শুরুতে দেখেশুনে খেলে তারপর হ্যাটট্রিক ছক্কা হাঁকিয়েছেন তিনি। ৬৯ বলে ৯৪ রানে অপরাজিত লিটন! সেঞ্চুরিটা তার পরের ম্যাচের জন্যই ধরা থাক। সাকিব খেলেছেন তার অভিজ্ঞতা আর মেধা দিয়ে। দারুণ সব কাট শটে শুরুতে বাউন্ডারির লাইন বের করেছেন। মাঝে স্ট্রেইট ড্রাইভ খেলে পরে শর্ট বলে পুল খেলেছেন। রীতিমতো ছন্দসাজানো ছিল তার ইনিংস। ৪০ বলে ৫০ আর ৮৩ বলে ১০০ আসে তার। কার্ডিফে ১২১ রানের পর টনটনে নটআউট ১২৪। সেঞ্চুরির পর একবারের জন্যও হেলমেট খোলেননি। গ্যালারিতে ব্যাট ঘুরিয়ে দর্শক সারিতে বসে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হেসেছেন মাত্র। ম্যাচ জেতার পরও নবম সেঞ্চুরির স্মারক স্টাম্প তুলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও নিয়ম আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সাকিব। কেননা এবারে আইসিসি নিয়ম করেছে স্টাম্প তোলা যাবে না। কারণ অনেক তার আর চিপ থাকে তার সঙ্গে। বাংলাদেশ ম্যাচ জয়ের পর একজনকে খুঁজছিলাম। যিনি খেলা-কোচিং ছেড়ে এখন গানবাজনা ধরেছেন। ক্যারিবীয় একটি ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট তিনি। আইসিসির অনুরোধে এসেছেন এখানে। মাইকের সামনে ধারাভাষ্যও দিচ্ছেন, তবে কোট-টাই পরতে রাজি হননি! সঙ্গীত ভুবনের লোক এখন; কিন্তু ক্রিকেট যে তার রক্তে। গতি ছোটানো তার নেশা। মুস্তাফিজের চল্লিশের কাছাকাছি বোলিং তাকে মুগ্ধ করেছে। প্রেসবক্সের বাইরে কথা বলতে বলতে সেই কার্টলি অ্যামব্রোসই আক্ষেপ করলেন, এখন তো আর পেসারদের জন্য পিচই বানায় না কেউ। এই মাঠে নাকি তিনশও তাড়া করা কোনো ব্যাপারই না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩২১ রানের টার্গেট দেওয়ার আগেই অ্যামব্রোসের এই ভবিতব্য। তার সেই কথাই সত্য প্রমাণ করলেন সাকিব আল হাসান। এদিন আসলে মনে মনে দুটি শঙ্কা নিয়ে খেলতে নেমেছিল টাইগাররা। টনটনের ৬৭ মিটারের ছোট্ট বাউন্ডারি লাইন আর দুই হার্ডহিটার গেইল- রাসেল। সেই দুজনকেই খালি হাতে ড্রেসিংরুমে পাঠানো গিয়েছিল। ছক্কাও সেই তুলনায় তেমন নয়, ক্যারিবীয়দের গোটা ইনিংসে মাত্র এগারোটি। মেঘলা আকাশ, পিচের তাজা ঘাস আর একদিক থেকে হাওয়া বইতে থাকায় টস জিতে বোলিংটা নিয়েছিলেন মাশরাফি। কাজেও দিয়েছিল তা। ১৩টি বল ঠুকঠাক করার পর শূন্য রানে আউট গেইল। সাইফউদ্দিনের বলে একদিকে ঝাঁপিয়ে দুই হাতে দারুণ ক্যাচ নিয়েছিলেন মুশফিক। এ নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশ্বকাপের চার ম্যাচে গেইল দুবার শূন্য মারলেন। শূন্য হাঁকিয়েছিলেন আন্দ্রে রাসেলও। মুস্তাফিজের শর্ট বলে ক্যাচ তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন রাসেল। এই ক্যাচও দুর্দান্তভাবে নিয়েছিলেন মুশফিক। যা তাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা করে দিয়েছিল। ক্যারিবীয় দুই তারকাকে শূন্য হাতে ফেরানো গেলেও শাই হোপ ও শিমরন হেটমেয়ার ছিলেন আঠার মতোই ক্রিজে লেগে। টাইগারদের সঙ্গে খেলা থাকলেই জ্বলে ওঠে হোপের ব্যাট- এই মিথটা মেনে এদিনও তার পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস। বাংলাদেশের বিপক্ষে যা টানা ছয় ফিফটি। তবে সেঞ্চুরি করতে পারেননি হোপ। ১২১ বলে ৯৬ রান করে আউট হওয়ার পর ইনিংস বিরতির সময় ফ্যানজোনে গিয়ে শুনতে পেয়েছি কিছু ক্যারিবীয় সমর্থক তাকে স্বার্থপর বলছেন। অনেকগুলো বল নাকি তিনি নষ্ট করেছেন। ছোট্ট মাঠে যেখানে হেটমেয়ার ১০৪ মিটার লম্বা ছক্কা হাঁকিয়েছে, ১০৫ মিটার দূরে ফেলেছেন হোল্ডার। এমনকি পুরানও ভিআইপি বক্সের টালির ছাদ ভেঙে ফেলেছেন। সেখানে শাই হোপের ছক্কা মাত্র একটি। এটাকে অপমানই মনে করছেন টনটনে থাকা হাতেগোনা ক্যারিবীয় সমর্থকরা। তারা মানতে চান না যে, এই হোপ দুটি বড় বড় জুটি করেই দলের রান তিনশ ছাড়িয়েছেন। ৩৫ থেকে ৩৮ ওভার- ষাট রান এসেছিল ক্যারিবীয়দের! তবে কামব্যাক করেছিলেন মুস্তাফিজ। এক ওভারে হেটমেয়ার আর রাসেল ফিরে যাওয়ার পর সাড়ে তিনশর টার্গেট চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে ক্যারিবীয়দের। হোল্ডার এসে রাসেল-মূর্তি ধারণ করেছিলেন বটে, তার ১৫ বলে ৩৩ আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। কিন্তু শেষ পাঁচ ওভারে মেধাবী বোলিং করে যান মিরাজ, সাইফ আর মুস্তাফিজ। শেষ ছয় ওভারে তারা দিয়েছিলেন মাত্র ৩৮ রান, টনটনের মাঠে যা ১৮ রানের সমান! অবশ্য লাইন আর লেন্থ ঠিক রাখতে গিয়ে বেশি বেশি ওয়াইড দেওয়া হয়ে গেছে। অতিরিক্ত ২২ রানের মধ্যে ১৬টিই ছিল ওয়াইড! তবে যাদের দশ নম্বর পর্যন্ত ব্যাটসম্যান ছক্কা হাঁকাতে পারেন, তাদের সামনে এমন কিছুটা হতেই পারে। বিশ্বকাপে এর আগে সর্বোচ্চ ৩১৮ রান তাড়া করে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জিতেছিল বাংলাদেশ। নেলসনের সেই রেকর্ড ভেঙে দিল টনটন। প্রথম খেলতে আসা ছেলেগুলোকে এক দারুণ জয় উপহার দিল ইংল্যান্ডের এই শান্ত গ্রামটি। সূত্র:সমকাল এনইউ / ১৮জুন



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2WLZ7Bo
June 18, 2019 at 04:12AM
18 Jun 2019

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top