লন্ডন, ১৫ জুলাই- বিশ্বকাপ মানেই তো ক্রিকেটের বিশ্ব মেলা। আর সেই বিশ্বকাপের ফাইনাল শুধু দুই দলের বিশ্বসেরার লড়াইই নয়, অনেক তারার মেলাও। আজ লর্ডসে সেই ক্রিকেটের সব নামি-দামি আর বিশ্ব তারকাদের সমাগম। কে নেই? সেই ১৯৭৫ সালে যার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হয়েছিল প্রথম বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন, সেই ক্যারিবীয় ক্রিকেটের অবিসংবাদিত সুলতান ক্লাইভ লয়েড উপস্থিত। যে লড়াকু ক্রিকেটারের হাত ধরে অস্ট্রেলিয়া প্রায় দূরন্ত-দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল, যিনি এই লর্ডসে ২০ বছর আগে শেষ বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতে ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিলেন- সেই সাবেক অসি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর দেখা মিললো। ভারতীয় ক্রিকেটের কালজয়ী তারকা বিশ্ব ক্রিকেটের সব সময়ের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র শচিন টেন্ডুলকার, ক্যারিবীয় ক্রিকেট তথা বিশ্ব ক্রিকেটের রেকর্ডের বরপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারাও এসেছেন ফাইনাল উপলক্ষে। এই লর্ডসে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের হিরো অসি লেগস্পিনার, স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্ন, গতি সম্রাট ওয়াকার ইউনুস, ইয়ান বিশপসহ আরও অনেক তারকাই আজ ফাইনাল দেখতে হাজির হয়েছেন লর্ডসে। সে সাথে আইসিসির বর্তমান চেয়ারম্যান শশাঙ্ক মনোহর, আইসিসি প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন, ইসিবি, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন, পিসিবি সভাপতি এহসান মানিসহ বিশ্ব ক্রিকেটের প্রায় সব রথি-মহারথিরই সমাবেশ ঘটেছে লর্ডসে। তাদের সাথে বিভিন্ন দেশের ও আইসিসি এবং স্টার স্পোর্টস-স্কাই টিভির ধারভাষ্য দিতে আসা অনেক সাবেক তারকা ক্রিকেটারও ছিলেন। আপনি একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন, দেখা হয়ে যাবে একেকজন বিশ্ব তারকার সাথে। একটু অন্যমনস্কভাবে হাঁটাচলা করছেন, পরক্ষণেই দেখবেন আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন লারা, শচিন কিংবা ওয়াকার । যে অধ্যাবসায়ী ও অসামান্য ক্রিকেটারের অধিনায়কত্বে ১৯৯৯ সালে এই যুক্তরাজ্যে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে এসে পাকিস্তানকে হারিয়ে হই চই ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ- সেই আমিনুল ইসলাম বুলবুলও ছিলেন আজকের ফাইনালে। অসি ক্রিকেটের দুরন্ত ফাস্ট বোলার ডেমিয়েন ফ্লেমিংসহ আরও অনেক তারার মেলা বসেছিল লর্ডসে। এসব নামি-দামি তারকার সাথে ১৪ জুলাই রোববার ক্রিকেট মক্কায় ইংল্যান্ড-নিউজিল্যানন্ড ফাইনাল দেখতে আসা ৩০ হাজার ক্রিকেট অনুরাগি তো ছিলেনই। যারা প্রতটি মুহূর্ত প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। আনন্দে-উল্লাসে মেতে ছিলেন। বিশ্বকাপের ফাইনাল আসলে মন-প্রাণ ভরে উপভোগ করার মতই একটা উপলক্ষ। আর সেটা লর্ডসে হলে তো কথাই নেই। তা হয়ে ওঠে এক অন্যরকম ও পরিপূর্ণ ফাইনাল। সেটা শুধু মাঠের ক্রিকেটের কারণে নয়। লর্ডসের অনুপম ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য্য, লর্ডস মিউজিয়াম, অন্যরকম আদলে গড়া ড্রেসিং রুম, ঐতিহ্যবাহী লর্ডস বেলকনি, এর মধ্যে অনার্স বোর্ড, এই মাঠে বিশ্বকাপ ছাড়াও সেই ১৯৪০-১৯৫০ দশক থেকে বিভিন্ন সময় টেস্ট-ওয়ানডের বিভিন্ন ব্যক্তিগত সাফল্য ও মাইলফলক স্থাপন কারীদের ছবিসহ সে সব সাফল্যের ফলক এবং সর্বোপরি লর্ডসের ঠিক বাইরে উত্তর দিকের নর্থ প্লাজায় সবুজ ঘাসের চত্বরে শুয়ে বসে খেলার দেখার মনোমুগ্ধকর পারিপার্শ্বিকতা এবং চিরায়ত ঐতিহ্যর মিশেলে লর্ডস সত্যিই ক্রিকেটের তীর্থভূমি। মোটকথা ইংলিশ ও কিউইরা আজ লর্ডসে বিশ্বকাপের ফাইনাল প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। উপভোগের উপলক্ষ্য আর উপাদানও মিলেছে প্রচুর। এবারের পরিবেশটা আরও বেশি প্রাণবন্তু। আকর্ষনীয় এবং উপভোগ্য। ২৭ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনাল স্বাগতিক ইংল্যান্ড। অথচ, ইংলিশরা এ নিয়ে তেমন মাতামাতিই করেননি। আগের দিন তো বোঝাই যায়নি, এখানে বসতে চলেছে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। আবেগ-উচ্ছাসের বহিঃপ্রকাশ তাদের কম। আচার আচরণেও অনেক রক্ষনশীল ইংলিশরা। অথচ আজ ফাইনালে সেই ভাব-গাম্ভীর্য রুপ যেন কোথায় হারালো। সাদার ভেতরে রেড ক্রস আঁকা ছোট ছোট পতাকায় সয়লাব লর্ডস। প্রসঙ্গতঃ ইংল্যান্ডের পতাকা এটি। এক নাগাড়ে না চেঁচালেও সারা দিনের বড় সময় ধরে বেশ আনন্দ-উল্লাসেই কাটালেন ইংলিশরা। তাদের উৎফুল্ল আর চাঙ্গা করলো নানা ব্যান্ডের উদ্দীপক মিউজিক। দুটি বিশেষ ব্যান্ড পার্টি সকালে খেলা শুরুর আগে থেকে সেই যে বাজানো শুরু করলো, থামলো গিয়ে খেলা শেষে। খেলা শুরুর পর এক বল পর-পরই বেজে উঠলো নানা জনপ্রিয় ইংলিশ সঙ্গীত। সে সুরের মুর্চনায় ইংলিশ সমর্থকরা সারা দিন ভালই আনন্দ করলেন। কিউইরা সংখ্যায় কম থাকলেও মাঝে মধ্যেই কানে এলো কিউই.. কিউই.. কিউই...। কাম অন কিউইজ। কাম অন। মাঠের লড়াইটাও হলো বেশ। নিউজিল্যান্ডের ২৪১ রান দেখে যারা ভেবেছিলেন খেলা হবে একপেশে। কিউইরা পারবে না। তারা চোখ চেয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলেন লড়াই হলো সেয়ানে সেয়ানে। ওই ২৪১ রানের পুঁজি নিয়েই বল হাতে বারুদ ঝরালেন ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরি ( ১০-২-৪০-১), কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম (১০-২-২৫-১ ), লকি ফার্গুসন (১০-০-৫০-৩), জিমি নিশাম (৭-০-৪৩-৩)। তার বিপক্ষে প্রাণপন লড়াই করলেন বেন স্টোকস আর কিপার বাটলার (৫৭)। খেলা গড়ালো শেষ ওভারে। বোল্টের ছয় বলে দরকার ছিল ১৫ রানের। প্রথম দুই বলে রান না দিয়ে তৃতীয় বলে ছক্কা খেয়ে বসলেন বোল্ট। হাঁকালেন স্টোকস। পরের বলে ছয় না হাঁকিয়েও ৬ রান পেলেন স্টোকস। ডিপ মিড উইকেটে ঠেলে ডাবলস নিতে দৌড়ালেন তিনি। ফিল্ডার মার্টিন গাপটিলের লক্ষ্যহীন থ্রো কিপারকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল সীমানার ওপারে। তাতেই কঠিন হিসেব সহজ হয়ে গেল। শেষ দুই বলে দরকার পড়লো তিন রানের; কিন্তু স্টোকস স্ট্রাইকে থেকেও পারলেন না। শেষ দুই বলে দুজন রান আউট হলেন। প্রথমে স্ট্রাইকে থাকতে গিয়ে ডাবলস নিতে গেলেন স্টোকস। সঙ্গী আদিল রশিদ রান আউট হলেন। আর শেষ বলে ডাবলস নিতে গিয়ে পার্টনার উড রান আউট হলে স্কোর সমান হয়ে গেল দুই দলের। ভারতের সাথে আজকের চেয়ে কম ২৩৯ রানের পুঁজি নিয়ে জিতেছিল কিউইরা। আজ ইংলিশদের সাথে প্রায় একই ঘটনার জন্ম দিয়েও পারলো না তারা। বোলারদের দৃঢ়তায় খেলা গড়ালো সুপার ওভারে। বিশ্বকাপের ৪৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম সুপার ওভারে নির্ধারিত হলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সারা বিশ্বকাপ আড়াইশোর আশপাশে রান করে বোলারদের হাত ধরে বিশেষ করে ফাস্ট বোলিংয়ের কাঁধে ভর করে ফাইনালে প্রবল লড়াইয়ের পর নিউজিল্যান্ডের সামনে বিশ্বকাপ জেতার সুযোগ এসেছিল ব্যাটসম্যানদের হাত ধরে। জোফরা আর্চারের ওভারে দরকার ছিল ১৬। প্রথম বল ওয়াইড। পরের বলে ছক্কা। আর তিনটি ডাবলস নিয়ে। ছয় নম্বর ডেলিভারিতে সিঙ্গেলস নিলেন নিশাম। শেষ বলে স্ট্রাইক পেয়ে গাপটিল পারলেন না দুই রান নিতে। জয়ের খুব কাছে গিয়ে তীরে এসে তরি ডুবলো কেন উইলিয়ামসনের দল। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের দারুণ জয়ে মাতলো লর্ডস। অন্যতম ফেবারিটের তকমা গায়ে মেখে মাঠে নেমে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নও ইংল্যান্ড। মানে বিশ্বকাপের স্বার্থক স্বাগতিক এবার ইংল্যান্ড। ক্রিকেটের জন্মভূমির দীর্ঘ দিনের আক্ষেপ মিটলো এবার। সূত্র: জাগোনিউজ আর/০৮:১৪/১৫ জুলাই
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2lqm2Av
July 15, 2019 at 04:50AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন