কলকাতা, ০৬ অক্টোবর- দুর্গাপূজার সকালে অঞ্জলি দেওয়ার যে মন্ত্র পাঠ করা হয়, তারই একটি শব্দ পরিবর্তন করে সময়োপযোগী করার দাবি উঠেছে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ওই মন্ত্রের একটি জায়গায় পুত্রান্ দেহি বলতে হয়। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর গণমাধ্যমে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে পুত্রান্ দেহি বলে আসলে ঈশ্বরের কাছে শুধু পুত্র চাওয়া হয়ে আসছে। শুধুমাত্র পুত্র সন্তানের কামনা করাটা লিঙ্গ বৈষম্য, এমনই মনে করছেন অনেকে। শাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন তিন ভাগে যে অঞ্জলি দেওয়া হয়, তার দ্বিতীয় ভাগটি এরকম- আয়ুর্দ্দেহি যশোদেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে। ধনং দেহি পুত্রান্ দেহি সর্ব কামাংশ্চ দেহি মে। অর্থাৎ, দেবীর কাছে আয়ু, যশ এসবের সঙ্গেই পুত্র কামনা করা হচ্ছে। দাবি উঠছে, পুত্রান্ দেহির বদলে সন্তানান্ দেহি বলা হোক, যাতে পুত্র বা কন্যা নির্দিষ্ট করে না প্রার্থনা করে সন্তানের কথা বলা হোক ওই মন্ত্রে। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা পূজার মন্ত্র বদল করা যায় কি না, তা নিয়ে বেদ-পুরাণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতান্তর তৈরি হয়েছে। বেদ-পুরাণের গবেষক অধ্যাপক রোহিনী ধর্মপাল বলছেন, বহু ক্ষেত্রেই হিন্দু শাস্ত্র-পুরাণে কিছুটা লিঙ্গ-বৈষম্য রয়েছেই। এখানে নারীদের কথা একটু কম, পুরুষদের কথা বেশি আছে। এই একটা শব্দ পরিবর্তন করে যদি লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা যায়, তাহলে আপত্তির কিছু তো দেখি না আমি। তবে শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী মনে করেন যে, পুত্রান্ দেহি বলা হলেও সেটিতে আসলে সন্তান কামনাই করা হচ্ছে। মন্ত্রটা কে কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যের শুরুতে রয়েছে- জগত: পিতরৌ বন্দে, অর্থাৎ নিখিল জগতের পিতরৌ - মানে পিতা এবং মাতা, অর্থাৎ পার্বতী- পরমেশ্বরকে বন্দনা করি। পিতরৌ হল পিতা শব্দের দ্বিবচন। একটা শব্দেই কিন্তু বাবা এবং মা দুজনকেই বোঝানো হচ্ছে, বলছিলেন প্রসাদ ভাদুড়ী। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, যে সমাজে, যে যুগে মন্ত্রগুলি লেখা হয়েছে, সেই সময়কার ছাপ নিঃসন্দেহে রয়েছে মন্ত্রের মধ্যে। তিনি বলছিলেন, সে যুগে নিঃসন্দেহে পুত্র সন্তানই চাইতেন বেশিরভাগ মানুষ। কারণ আর্যরা যখন যুদ্ধ করতে করতে অগ্রসর হচ্ছে, তখন লড়াই করার জন্য শক্তিশালী পুত্রের প্রয়োজন বলেই মনে করা হত। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে পর্যন্তও তো আমাদের সমাজেই পুত্র সন্তানই চাইতেন মানুষ। তাই ওই সময়ের মানুষের চিন্তা-ভাবনায় লিঙ্গ বৈষম্য ছিল, এটা বলার কোনো অর্থ হয় না। তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, গবেষণা হতে পারে, কিন্তু পরিবর্তন কী ভাবে করবেন আপনি? অধ্যাপক রোহিনী ধর্মপালের মত অবশ্য বলছেন, বেদে কিন্তু নারীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। ২৭ জন নারী ঋষি বেদের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুক্ত লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তী নানা যুগে নারীদের স্থান সঙ্কুচিত হতে শুরু করে, অনেক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় মেয়েদের ওপরে। ব্রাহ্মণ্যবাদ আর পুরুষতান্ত্রিকতার ফসল ওগুলো। এত বছর ধরে যদি সেই খারাপ দিকের পরিবর্তনগুলো মেনে নিয়ে আমরা মন্ত্রোচ্চারণ করে থাকতে পারি, এখন সন্তান কামনার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য বদল কেন করা যাবে না? দুর্গাপূজার অঞ্জলির মন্ত্র পরিবর্তন করা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও অনেকেই পোস্ট শেয়ার করছেন, বা অন্যের পোস্ট লাইক বা কমেন্ট করছেন। এরকমই একজন, কলকাতার বাসিন্দা কাবেরী বিশ্বাস বলছিলেন, এই পোস্টটা দেখার পরে মনে হল যে, এভাবে তো কখনো ভাবিনি! যদিও অঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণের সময়ে পুত্রান্ দেহি কথাটা বলতাম, মনে মনে কিন্তু সন্তানই প্রার্থনা করতাম। মায়ের কাছে পুত্রসন্তান আর কন্যাসন্তান - দুইয়েরই মূল্য সমান। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ায় এবার ঠিক করেছি সন্তানান্ দেহিই বলব। নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী কিন্তু মনে করেন, এটা অবাস্তব। যুগ যুগ ধরে যে মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে, সেটাকে কি পাল্টে দেওয়া যায় একটা ক্যাম্পেইন চালিয়ে? দেখবেন এবারও অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে পুরোহিতও যেমন পুত্রান্ দেহি-ই বলবেন, তেমনই যারা অঞ্জলি দেবেন, তাঁরাও সেটাই উচ্চারণ করবেন। পুত্রান্ দেহির বদলে সন্তানান্ দেহি বলার যে দাবি উঠেছে, তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেন নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী শ্বাশতী ঘোষ। তবে তিনি বলছেন, মন্ত্র বদলের থেকেও দরকার নিজের মন পরিবর্তন, যেখানে পুত্র সন্তান আর কন্যা সন্তানের মধ্যে যে কোনো ভেদ নেই, এটা মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে। সূত্র: অমিতাভ ভট্টশালীর প্রতিবেদন বিবিসি বাংলা, কলকাতা এন কে / ০৬ অক্টোবর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2Vjz2FH
October 06, 2019 at 09:25AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top