কিকে মাতেও। স্প্যানিশ ফুটবল ভক্তদের কাছে খুব পরিচিত এক মুখ। দেশটির জনপ্রিয় রাতের ফুটবল শো এল চিরিঙ্গুইতো ডি ইউগোনেস-এর একজন কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করে থাকেন তিনি। মিলানের বিখ্যাত সানসিরো স্টেডিয়ামে ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া বনাম ইতালিয়ান ক্লাব আটলান্টার ম্যাচে গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন তিনিও। করোনাভাইরাস ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হিসেবে এখন দেখা হচ্ছে ভ্যালেন্সিয়া এবং আটলান্টার এই ম্যাচটিকে। যেখানে জমায়েত হয়েছিলেন প্রায় ৪০ হাজার দর্শক। করোনা ভাইরাস তখন কেবল ইতালিতে একটি-দুটি আক্রান্ত হওয়ার খবর শোনা যাচ্ছিল। ইতালিয়ান ডাক্তারদের সঙ্গে কিকে মাতেওও এখন বলছেন, ওই সময় সানসিরোয় এতবড় ফুটবল জমায়েত না হলে হয়তোবা ইতালি, স্পেনে এভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেতো না। অর্থ্যাৎ, ইতালিয়ান ডাক্তাররা এখন করোনাভাইরাস এভাবে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সেই ম্যাচটিকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন। ভ্যালেন্সিয়ার ম্যাচ কাভার করার জন্যই স্পেন থেকে ইতালিতে গিয়েছিলেন কিকে মাতেও। তিনি সেখানে প্রেস কনফারেন্সে অংশ নেন। ম্যাচে তিনি ছিলেন অনেক মানুষের সঙ্গে। ম্যাচ শেষে মিক্সডজোনে কয়েকজন ফুটবলারের ইন্টারভিউও নিয়েছিলেন। ইতালিতে সেদিন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত ছিল মাত্র তিনজন। নিজের রিপোর্ট শেষ করে মিলান থেকে ভাড়া করা গাড়ীতে করে পাশের এক ছোট শহরে গিয়ে রাত্রি যাপন করেন কিকে মাতেও। পরেরদিন চলে আসেন তিনি ভ্যালেন্সিয়ায়। এরপর সপ্তাহের শেষ দিন পর্যন্ত কোনো ঘটনার খবর আর পাননি তিনি। পরের সোমবার সন্ধ্যার পর মাতেও বুঝতে পারেন তার শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। শরীরে জ্বর এসেছে, অবসাদ আর ক্লান্তির সঙ্গে শুকনো কাশিও ছিল তার। মঙ্গলবার সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বুঝতে পারেন, তার শরীরের খুব বাজে অবস্থা। ওইদিন থেকেই উত্তর ইতালিতে প্রচুর করোনা আক্রান্ত রোগির খবর আসতে শুরু করে বিশ্ব মিডিয়ায়। মাতেও তখনই সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তারী পরীক্ষা করে দেখানোর। মাতেও বলেন, আমি খারাপ অনুভব করছিলাম। তবে খুব সিরিয়াসলি নয়। সাধারণ উপসর্গ হলো, আপনার ঠান্ডা লাগা। এরপর নাক বন্ধ হয়ে আসা, এরপর ধীরে ধীরে শরীর খারাপ হতে শুরু করবে। আমি যেহেতু মাত্রই মিলান থেকে ফিরেছি, এ কারণে চিন্তা করলাম, অবশ্যই আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, করোনাভাইরাস শরীরে বাসা বেধেছে কি না। প্রথমে স্পেনের ইমার্জেন্সি নাম্বার ১১৮- তে কল দিয়ে নিজের অবস্থার কথা বর্ণনা করেন তিনি। সব শুনে ইমার্জেন্সি থেকে বলা হলো, সিরিয়াস কিছু না। বলা হলো, নিজের কাজ করে যেতে। কিন্তু দিনের বাকি অংশ তিনি আইসোলেশনেই কাটান স্ত্রী এবং সন্তান নিয়ে। বুধবার সকালে আবারও ইমার্জেন্সি নাম্বারে কল দেন তিনি। দিয়ে নিজের অবস্থার কথা বর্ণনা করেন এবং বলেন তিনি মিলান গিয়েছিলেন। পরে মেডিক্যাল ইউনিট থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার পরীক্ষা করা হবে। অর্থ্যাৎ, আরো ২৪ ঘণ্টার ব্যবধান। মাতেও সিদ্ধান্ত নেন, স্থানীয় প্রাইভেট ক্লিনিকে যোগাযোগ করবেন। সেখানে করোনাভাইরাস টেস্ট করার সুবিধা ছিল না। এরপর তিনি চলে আসেন ভ্যালেন্সিয়া ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকে। ওইদিনই টেস্ট করান। পরদিন, বৃহস্পতিবার টেস্টের রেজাল্ট আসলো এবং নিশ্চিত হওয়া গেলো, মাতেও করোনাভাইরাস আক্রান্ত। এরপরই মাতেও পুরো আইসোলেশনে চলে যান এবং গত এক সপ্তাহে যাদের যাদের সঙ্গে মিশেছেন বলে মনে করতে পেরেছেন, সবাইকেই আইসোলেশনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নিজে পুরোপুরি আইসোলেশনে যাওয়ার পর মাতেও বহির্বিশ্বের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বাইরে কি হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি আর কিছুই জানতে পারেননি। কেউ তাকে দেখতে আসতে পারেনি, তিনিও চাননি কারো সঙ্গে দেখা করতে। এভাবে ৯দিন আইসোলেশনে ছিলেন মাতেও। শুধু দুএকটি বই ছিল পড়ার জন্য। টিভি ছিল দেখার জন্য। চারজন ডাক্তার নিয়ম করে তাকে চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। ১০ম দিনে গিয়ে ডাক্তাররা ঘোষণা দিলো মাতেও ওকে। করোনামুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন কিকে মাতেও। অর্থ্যাৎ পরিস্কার হয়ে গেলো, মিলানের সানসিরো স্টেডিয়ামে ভ্যালেন্সিয়া আর আটলান্টার মধ্যকার ম্যাচে উপস্থিতির কারণেই করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন কিকে মাতেও। সৌভাগ্য তার, ১০দিন আইসোলেশনে থেকে নিজেকে সুস্থ করে তুলতে পেরেছিলেন তিনি। ইতালির প্রথম সারির একটি সংবাদপত্রে ইমিউনোলজিস্ট ফ্রান্সেসকো লে ফোকে বলেছেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আটলান্টা ও ভ্যালেন্সিয়া ম্যাচে বিপুল জনসমাবেশ হয়েছিল। লোম্বার্ডি অঞ্চলের বার্গামোইতে আটলান্টা ক্লাব অবস্থিত। ওইদিন মিলানের সানসিরো স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিলেন চল্লিশ হাজারের উপর দর্শক। বার্গামো থেকে দলে-দলে মানুষ যান খেলা দেখতে। পরে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসে ইতালিতে সবচেয়ে আক্রান্ত শহর এই বার্গামোই। ইতালির ডাক্তারদের এখন মনে হচ্ছে, এই বিপুল জনসমাবেশ থেকেই দ্রুত ছড়িয়ে থাকতে পারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। যদিও ওই সময় অতটা সাবধানী হয়নি কেউ। পাওলো রোসি, জিয়ানলুইজি বাফন, রবার্তো ব্যাজিওদের দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগ সিরি আ-তে খেলে আটলান্টা। ঘরের মাঠে বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট দলটি তারা ৪-১ গোলে হারিয়েছিল স্পেনের ভ্যালেন্সিয়াকে। ফ্রান্সেসকো বলছেন, এত ভয়ঙ্করভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে আটলান্টা-ভ্যালেন্সিয়া ম্যাচও থাকতে পারে। ইতালীয় ক্লাবের জয় দেখে সে দিন উৎফুল্ল জনতা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিল, হাতে হাত মিলিয়ে উৎসব করছিল। তাতেই সর্বনাশ হয়ে থাকতে পারে বলে শঙ্কা এখন ইতালিতে। বার্গামোতে যেভাবে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা, তাতে ডাক্তারদের একাংশের এই শঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমনই করুণ পরিস্থিতি সেখানে যে, মৃতদের সমাধিস্থ করার জায়গাও ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের সমাধিস্থ করা যাচ্ছে না, সেই সব কফিন তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর ট্রাক। ডাক্তার ফ্রান্সেসকোর সংযোজন, ১৯ ফেব্রুয়ারির ওই ম্যাচের পরে এক মাস পেরিয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ চরম আকার নেয় সংক্রমণ শুরুর এক সপ্তাহের আশেপাশে। চল্লিশ হাজার মানুষ গা ঠেসাঠেসি করে, একে অন্যের থেকে এক সেন্টিমিটারের থেকেও কম দূরত্বে বসে আছেন! মৃত্যুপূরীতে পরিণত ইতালিতে বসে অনেকে এখন ভাবতে গিয়েও শিউরে উঠছেন! যেখানে মানুষের জমায়েতই করোনাভাইরাস রোধের সব চেয়ে বড় শত্রু। ফ্রান্সেসকো বলছেন, আমার মনে হয়, অনেকে জ্বর বা সর্দি-কাশি থাকলেও ম্যাচ দেখতে যাওয়া বাতিল করতে চায়নি। আগে থেকে টিকিট কিনে রেখেছে। কে আর ম্যাচ দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়? তার পরেই ডাক্তারের উপলব্ধি, হয়তো তখন কেউ বুঝতে পারেনি। কারণ, ততটা ছড়ায়নি সংক্রমণ। ফিরে তাকিয়ে দেখলে এখন মনে হচ্ছে, সে দিন অত লোকের সমাবেশ সর্বনাশ ডেকে এনেছে! ওই ম্যাচ দেখতে আসা দর্শকদের অনেকের কয়েক দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাস পরীক্ষায় পজিটিভ ধরা পড়ে। স্পেন থেকে খেলতে আসা ভ্যালেন্সিয়া দলের পঁয়ত্রিশ শতাংশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন। একা ফ্রান্সেসকো নন, এমন সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন ইতালির আরও কয়েকজন ডাক্তার। বার্গামো থেকে সড়কপথে মিলান এক-দেড় ঘণ্টার পথ। ম্যাচের দিন সেই সড়কপথে এত গাড়ি ছিল যে, ট্র্যাফিক জ্যামে বহুক্ষণ আটকে থাকেন অনেক মানুষ। বার্গামোয় পোপের নামাঙ্কিত হাসপাতালের ফুসফুস সংক্রান্ত রোগের প্রধান ফাবিয়ানো ডি মার্কো বলেছেন, করোনার প্রকোপ এত দ্রুত, এত সাংঘাতিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি, ১৯ ফেব্রুয়ারির ওই ম্যাচ। জনতার বিস্ফোরণ ঘটেছিল সে দিন। ফাবিয়ানো জানিয়েছেন, কিভাবে তাদের হাসপাতালে মুহূর্তের মধ্যে বদলে গিয়েছিল করোনা নিয়ে পরিবেশ। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম তারা বুঝতে পারেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে রোগী আসা শুরু হয়েছে। রাত আটটা নাগাদ তিনি প্রথম মোবাইল বার্তা পান; কিন্তু তখনও পরিস্থিতি সামাল দিতে না-পারার মতো কিছু ঘটেনি। শুক্রবারে প্রথম করোনা-আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়। রোববার দুপুরের মধ্যে তাদের হাসপাতালের সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্ত বিভাগ ভর্তি হয়ে যায়। তখনও কেউ বুঝতে পারেননি, হিমশৈলের চূড়া দেখা গেছে মাত্র। এরপর ফাবিয়ানোর কথায়, সব কিছু বদলে গেল ১ মার্চ। হাসপাতালে পৌঁছে বুঝতে পারিনি, হাসপাতালে এসেছি না যুদ্ধক্ষেত্রে! যে দিকে চোখ যায়, শুধু নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী। সব ঘর তো উপচে পড়ছেই, এমনকি করিডরগুলোও ভর্তি। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক স্ট্রেচার। সকলের শ্বাসকষ্ট। আতঙ্ক, আতঙ্ক! আটলান্টার ফুটবল অ্যাকাডেমিকে বলা হয় ইটালির লা মাসিয়া। সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার গাইতানো সিরিয়া থেকে শুরু করে রবার্তো ডোনাডিনি, আলেসিয়ো ডোমেঙ্গিনি- দারুণ সব ফুটবলার উপহার দিয়েছে তারা। কে ভাবতে পেরেছিল, ফুটবলপ্রেম একদিন ডেকে আনবে মৃত্যুমিছিল! সূত্র : জাগো নিউজ এন এইচ, ২৩ মার্চ



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2QxW5f1
March 23, 2020 at 04:40AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top