রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্যই- যেকোন খেলাধুলায় অতি পরিচিত বাক্য এটি। কোন রেকর্ডই অবিনশ্বর নয়, তা বোঝাতেই মূলত বলা হয় এটি। কিন্তু যখন কোন রেকর্ড ঠিকই কয়েক যুগ কিংবা শতক পেরিয়ে যায়- তখন এর বিশেষত্ব বেড়ে যায় অনেক গুণে। ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাট টেস্টেও এমন অনেক রেকর্ড রয়েছে যেগুলো টিকে রয়েছে ৬০-৭০ বছর ধরে। এমনকি কিছু রেকর্ড অক্ষত রয়েছে প্রায় দেড়শ বছর ধরেই। সেসব রেকর্ড কি আদৌ ভাঙা সম্ভব? যা হয়নি গত ৬০-৭০ বছরে, তা পরবর্তীতে কি হবে?- এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জানতে হবে, সে রেকর্ডগুলো কী? এই প্রতিবেদনে থাকছে ক্রিকেটের সেসব রেকর্ডের কথা, যেগুলো অক্ষত রয়েছে অন্তত ৬০ বছর ধরেঃ সম্পূর্ণ ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের হার ১৮৭৭ সালে টেস্ট ইতিহাসের একদম প্রথম ম্যাচে ১৬৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার চার্লস ব্যানারম্যান। সেই ইনিংসে অসিরা অলআউট হয়েছিল মাত্র ২৪৫ রানে। অর্থাৎ ইনিংসের ৬৭.৩৪ শতাংশ রান একাই করেছিলেন ব্যানারম্যান। যা আজও রেকর্ড হিসেবে টিকে রয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৩ বছরের ইতিহাসে ব্যানারম্যানের খুব কাছে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের মাইকেল স্ল্যাটার। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১৯৯৯ সালের নিউ ইয়ার টেস্টে দলের ১৮৪ রানের মধ্যে তিনি একাই করেছিলেন ১২৩ রান। যা ছিল ইনিংসের ৬৬.৮৪ শতাংশ। বয়স্ক খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক ব্যানারম্যানের সেই সেঞ্চুরি ম্যাচে আরও একটি শতবর্ষী রেকর্ড হয়ে আছে ক্রিকেটের। সেই ম্যাচে ৪৯ বছর ১১৯ দিন বয়সে খেলেছিলেন ইংল্যান্ড জেমস সাদারটন। যা কি না এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট অভিষেকের রেকর্ড। এই রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেননা গত ছয় দশকে ৪০ বছরের বেশি বয়সে টেস্ট অভিষিক্ত খেলোয়াড়ের সংখ্যা মাত্র একজন (দক্ষিণ আফ্রিকা ওমর হেনরি, ১৯৯২ সালে)। সেখানে ৫০ বছরে টেস্ট অভিষেকের কথা ভাবাও অলীক কল্পনা। এক সিরিজে সর্বোচ্চ রান স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের অনেক রেকর্ডের অন্যতম একটি নির্দিষ্ট সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ১৯৩০ সালের অ্যাশেজে পাঁচের ৭ ইনিংসে ৯৭৪ রান করেছিলেন স্যার ডন। প্রায় ৯০ বছরেও এ রেকর্ড ভাঙতে পারেনি কেউ। স্যার ডন ভেঙেছিলেন আগের বছরের অ্যাশেজে স্যার ওয়ালি হ্যামন্ডের করা ৯০৫ রানের রেকর্ড। পরে ডনের রেকর্ড ভাঙা দূরে থাক, বিশ্বের আর কোন ব্যাটসম্যান এক সিরিজে ৯০০ রানই করতে পারেননি। সবচেয়ে কাছে গিয়েছিলেন অসিদের সাবেক অধিনায়ক মার্ক টেলর। ১৯৮৯ সালের অ্যাশেজে তিনি করেছিলেন ৮৩৯ রান। এছাড়া এক সিরিজে ৮০০র বেশি রান করার কৃতিত্ব আরও দুইবার দেখিয়েছেন ডন ব্র্যাডম্যান। সবমিলিয়ে ৭ জন ব্যাটসম্যান পেরেছেন এক সিরিজে ৮০০র বেশি রান করতে। সাম্প্রতিককালের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে স্টিভেন স্মিথ দুই সিরিজে পেরিয়েছেন ৭৫০ রানের কোটা। এক সিরিজে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি টেস্ট ক্রিকেটে এক সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের দখলে থাকলেও, এক সিরিজে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইড ওয়ালকট। ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৫৫ সালের সিরিজে পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছিলেন ওয়ালকট। যা এখনও আর কেউ ছুঁতে পারেননি। সে সিরিজের দুইটি ম্যাচের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছিলেন ওয়ালকট। এটিও করতে পারেননি বিশ্বের আর কোন খেলোয়াড়। সাম্প্রতিক সময়ে এক সিরিজে ৪টি করে সেঞ্চুরির কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা দুই ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি এবং স্টিভেন স্মিথ। এক সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট স্যার ডনের এক সিরিজের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডের মতো এখনও টিকে রয়েছে এক সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ডও। তবে এর মালিক ডনদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের ডানহাতি পেসার সিডনি বার্নস। ১৯১৩-১৪ সালে নিজের ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজে মাত্র ৪ ম্যাচে ৪৯ উইকেট শিকার করেছিলেন বার্নস। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা সে সিরিজে ৪ ম্যাচের ৮ ইনিংসে বোলিং করে ৭ বারই পাঁচ বা তার বেশি উইকেট শিকার করেন বার্নস। এর মধ্যে জোহানেসবার্গের বক্সিং ডে টেস্টের দুই ইনিংসে নেন ১৭ উইকেট। এই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের ক্যারিয়ার সেরা ৯ উইকেট শিকার করেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে মাত্র ৮ জন বোলার পেরেছেন এক সিরিজে ৪০ বা তার বেশি উইকেট নিতে। গত ত্রিশ বছরে এই কীর্তি গড়া একমাত্র বোলার হলেন শেন ওয়ার্ন। ২০০৫ সালের অ্যাশেজে তিনি শিকার করেন ঠিক ৪০ উইকেট। এক সিরিজে সর্বোচ্চ ফাইফারের রেকর্ডটাও সিডনি বার্নসেরই দখলে। ইনিংস ও ম্যাচে সেরা বোলিং ফিগার ১৯৫৬ সালের অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে দুই ইনিংস মিলে ৯০ রানে ১৯ উইকেট নিয়েছিলেন জিম লেকার। এর মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে শিকার করেন ৫৩ রানে ১০ উইকেট। বলা বাহুল্য, এ দুটিই টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাচে ও ইনিংসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। শুধু টেস্ট ক্রিকেট নয়, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেরও রেকর্ড এটি। টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেয়া অন্য বোলার হলেন অনিল কুম্বলে। দীর্ঘ টেস্ট ক্যারিয়ার ১৮৯৯ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত প্রায় ৩১ বছরে ৫৮টি টেস্ট খেলেছেন ইংল্যান্ড উইলফ্রেড রোডস। টেস্ট ইতিহাসে এত দীর্ঘ ক্যারিয়ার নেই আর কোন ক্রিকেটারের। অবসরের সময় রোডসের বয়স ছিল ৫৩। তার এই রেকর্ডের সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছেন শচিন টেন্ডুলকার। তিনি ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছিলেন ২০১৩ সালে। অভিষেকে সেরা ব্যাটিং ও সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকে সেরা বোলিং ও ব্যাটিংয়ের রেকর্ড টিকে রয়েছে প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে। ১৮৯৫ সালে নিজের অভিষেক ম্যাচে মাত্র ৪৩ রানে ৮ উইকেট শিকার করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ডানহাতি স্পিনার অ্যালবার্ট ট্রট। তার রেকর্ড আজ অবধি ভাঙতে পারেনি কেউই। ১৯৭২ সালে বব ম্যাসি এবং ১৯৮৮ সালে নরেন্দ্র হিরওয়ানি নিজেদের অভিষেক ম্যাচে ৮ উইকেট শিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে পারেননি ট্রটকে ছাড়িয়ে যেতে। মজার ব্যাপার হলো, অ্যালবার্ট ট্রট মাত্র ৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে তিন ম্যাচ খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে, বাকি দুই ম্যাচ ইংল্যান্ডের হয়ে। ব্যাট হাতে অভিষেক ম্যাচে সেরা ইনিংসের রেকর্ড ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক টিপ ফস্টারের দখলে। ১৯০৩ সালে নিজের অভিষেক ম্যাচেই ২৮৭ রান করেছিলেন ফস্টার। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলেও ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। ফস্টারের অভিষেকের ১০০ বছর পর ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক রুডলফ নিজের অভিষেক ম্যাচে খেলেন ২২২ রানের ইনিংস। টানা সেঞ্চুরি এবং ফাইফারের রেকর্ড টেস্ট ক্রিকেটে টানা সেঞ্চুরির রেকর্ডটিও প্রায় ৭০ বছরের পুরনো। ১৯৪৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যান এভারটন উইকস টানা ৫ ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন। যা আজও ভাঙতে পারেনি কেউ। ২০০২ সালে ভারতীয় ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড় টানা ৪ ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন। উইকসেরও প্রায় ৬০ বছর আগে বোলিংয়ের এই রেকর্ডটা গড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়াম পেসার চার্লি টার্নার। ১৮৮৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি টানা ৬ ইনিংসে নিয়েছিলেন ফাইফার। সে ৬ ইনিংসে তার শিকার ছিল ৩৩টি উইকেট। ২০১৩ সালে টানা ৫ ইনিংসে ফাইফার নিয়েছিলেন শেন শিলিংফোর্ড। সবচেয়ে কম ও বেশি বয়সে ফাইফার কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন পাকিস্তানের ডানহাতি পেসার নাসিম শাহ। এত অল্প বয়সে তার এমন কীর্তি নিয়ে হইচইও হয়েছিল বেশ। তবে মজার ব্যাপার হলো সবচেয়ে কম বয়সে পাঁচ উইকেট নেয়ার কীর্তিটা তার নয়। তারই স্বদেশি নাসিম উল গনি গড়েছিলেন সবচেয়ে কম বয়সে পাঁচ উইকেট নেয়ার রেকর্ড, যা অক্ষত আছে এখনো। ১৯৫৮ সালের ১৩ মার্চ মাত্র ১৬ বছর ৩০৩ দিন বয়সে ফাইফার নিয়েছিলেন নাসিম উল গনি। ফাইফার নেয়ার দিন নাসিম শাহর বয়স ছিল ১৬ বছর ৩০৭ দিন। সবচেয়ে বেশি বয়সে ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেয়ার কীর্তিটা গড়া হয়েছিল আরও আগে, ১৯৩২ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইনিংসে ১৮ রানে ৬টি ও ম্যাচে ২৪ রানে ১১ উইকেট পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান বোলার বের্ট আইরনমঙ্গার। সে সময় তার বয়স ছিল ৪৯ বছর ৩১১ দিন, এটিই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বয়সে ইনংসে পাঁচ ও ম্যাচে দশ উইকেট নেয়ার রেকর্ড। প্রথমে সেঞ্চুরিকে সবচেয়ে বড় করার রেকর্ড ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন গ্যারি সোবার্স। ওই ইনিংসে শেষপর্যন্ত তিনি অপরাজিত ছিলেন ৩৬৫ রানে। এরপর ২০১৬ সালে করুন আয়ারসহ এমন কীর্তি (প্রথম সেঞ্চুরিতেই ট্রিপল) গড়েছিলেন আরও দুজন। তবে এখনও নিজের অভিষেক সেঞ্চুরির ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটা সোবার্সের দখলে। সবচেয়ে কম বয়সী ট্রিপল সেঞ্চুরির রেকর্ডটিতেও এখনও সোবার্সের নামই লেখা। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর ২১৩ দিন। স্যার ডনের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির সময় বয়স ছিল ২১ বছর ৩১৮ দিন। সোবার্সের এমন কীর্তির সিরিজের শুরুতেই আরও একটি অনন্য রেকর্ড হয়েছিল। যেটি গড়েছিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হানিফ মোহাম্মদ। ফলো অনে পড়ে ব্যাটিংয়ে নেমে পাকিস্তানের হয়ে ৩৩৭ রান করেছিলেন হানিফ, যার জন্য তিনি ক্রিজে ছিলেন ৯৭০ মিনিট। এখনও পর্যন্ত সেটিই সবচেয়ে বেশি সময় ক্রিজে থাকার রেকর্ড। ফলোঅনে পড়েও ট্রিপল সেঞ্চুরি করার একমাত্র কীর্তি সেটি। একই সিরিজে দুই ট্রিপল সেঞ্চুরি সেবারই প্রথম ও শেষবারের মতো দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। এক টেস্টে দুই হ্যাটট্রিক অস্ট্রেলিয়ান লেগস্পিনার জিমি ম্যাথিউসের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একই টেস্টে দুইবার হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ১৯১২ সালে গড়া ওমন কীর্তির পুনারাবৃত্তি করতে পারেননি আর কেউ। ম্যাথিউসের এই জোড়া হ্যাটট্রিক আবার ছিল একই দিনে ভিন্ন দুই ইনিংসে করা। সূত্র : জাগো নিউজ এন এইচ, ২৩ এপ্রিল



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2RXKd6w
April 23, 2020 at 03:08AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top