চেতনায় ভাস্বর রক্তাক্ত সাঁওতাল বিদ্রোহ

আজ ৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল দিবস। আজ থেকে ১৬৫ বছর আগে, ১৮৫৫-'৫৬ সালে ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ভাগলপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এ রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের দোসর স্থানীয় জমিদার-জোতদার, মহাজন, ঠকবাজ ব্যবসায়ী ও অত্যাচারী পুলিশের বিরুদ্ধে শোষিত-নির্যাতিত মানুষের এ মহান বিদ্রোহ পরাধীন ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। এটি ছিল বৃটিশের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম।
ঐতিহাসিকরা সেদিন শোষণ ও শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনে আসল ইতিহাসকে গোপন রেখে মিথ্যা, শোষণ, উৎপীড়ন ও সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করে গেছেন এবং ভারতীয় ঐতিহাসিকরাও গণসংগ্রামের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর ইতিহাস রচনা করে গেছেন। যুগের পর যুগ আমরা সেই বিকৃত ইতিহাস পড়ে যাব? কিন্তু আর কতদিন? আদিবাসীদের সমস্যা আলোচনা করতে গিয়ে শ্রী বর্ধন লিখেছেন -“বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক সংগ্রামের একেবারে পয়লা সারিতে আদিবাসীরাও যে ছিল এবং উল্লেখযোগ্যভাবে সর্বাধিক আত্মত্যাগ তারাও যে করেছে এ কথা স্মরণ না করলে তাদের প্রতি প্রকৃত সুবিচার করা হয় না, এবং ভারতের ইতিহাস রচনায় তাদের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়নও করা হয় না। বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা হয় এ সত্য অস্বীকার করার চেষ্টা করেন অথবা মাঝে মাঝে উদারতার বশবর্তী হয়ে আদিবাসীদের এই সংগ্রামকে খুব বেশী হলেও স্থানীয় বিদ্রোহমাত্র বলে উল্লেখ করেন — অর্থাৎ তাঁদের ভাষায় এই সব ঘটনা ছিল আদিবাসীদের আদিম ক্রোধের বহি:প্রকাশ মাত্র, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ওপর তার প্রভাব খুব একটা পড়েনি। বুর্জোয়ারা চেষ্টা করেছে স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসকে কেবল বুর্জোয়াশ্রেণীর ভাবাদর্শগত প্রভাবেই পরিপুষ্ট এবং তাদেরই কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী পরিচালিত একটি আন্দোলন মাত্র বলে চিত্রিত করতে। এই পটভূমিতেই আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আদিবাসীদের অসংখ্য তীব্র সংগ্রামকে দাসত্ব ও শোষণের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতির সংগ্রামের সাধারণ উত্তারাধিরের অঙ্গ হিসাবে স্থান করে দেওয়ার।” (এ. বি. বর্ধন, ‘দি আনসলভড ট্রাইবাল প্রবলেম’, পৃ-৫)।
বৃটিশ শাসন ও শোষণ-উৎপীড়ণের কবল থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য দলে দলে সাঁওতাল সেদিন আপসহীন স্বাধীনতা-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা লাভের জন্য আপসহীন সংগ্রাম ছাড়া কোন পরাধীন জাতির অন্য কোন অস্তিত্ব ও ক্রিয়াকলাপ থাকতে পারে না। এ সংগ্রামে পরাজয় ছিল, আপস ছিল না; সাঁওতালরা নির্ভয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল, কিন্তু আত্মসমর্পণ করে নি। কারণ এ সংগ্রামের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা। ইংরাজ ঐতিহাসিক ও শাসকবর্গও এ কথা স্বীকার করে লিখেছেন-“সাঁওতাল-বিদ্রোহের পশ্চাতে ছিল জমির উপর একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙখা এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাঁওতালদের স্বাধীনতা স্পৃহা, যার ফলে তারা ধ্বনি তুলেছিল: তাদের নিজ দলপতির অধীন স্বাধীন রাজ্য চাই।” (বেঙ্গল ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার ফর সাঁওতাল পরগনাস’, পৃ-৪৮)
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন দুই সাঁওতাল সহোদর সিধু ও কানু। তাঁদের অপর দুই ভাই চাঁন্দ ও ভৈরবও ছিলেন বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ও সংগঠক। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সাথে এ লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন অত্যাচারিত ও গরীব হিন্দু-মুসলমানরাও। জীবন দিয়ে জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁরা তীর-ধনুক নিয়ে ইংরেজ সৈন্য ও পুলিশের কামান-বন্দুকের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অসম যুদ্ধে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষের জীবন দানের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো।
শোষকের চেহারা ও শোষণের ধরন পরিবর্তীত হলেও, শোষণ-নিপীড়ন এখন আরও তীব্র হয়েছে। পুঁজিবাদী শোষণের নিষ্ঠুর যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর চলছে নির্মম নির্যাতন। তাই, মুক্তির লড়াই আজও চলছে। লড়াই চলছে বাংলাদেশে, লড়াই চলছে ভারতবর্ষে। লড়াই চলছে দেশে দেশে, বিশ্বজুড়ে। সে লড়াইয়ে রক্তক্ষয়ী সাঁওতাল বিদ্রোহের অক্ষয় চেতনা আজও নিপীড়িত মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। সিধু, কানু, চাঁন্দ ও ভৈরবসহ হাজার হাজার নির্যাতিত মানুষের বীরোচিত লড়াই এবং অকাতর আত্মদান আজও প্রত্যেক মুক্তিসংগ্রামী মানুষকে অফুরান সাহস যোগায়।
ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর শহীদদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি!
লাল সালাম!

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ লেখকঃ সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী রবিউল হাসান ডলার/ ৩০-০৬-২০


from Chapainawabganjnews https://ift.tt/3g8Cigs

June 30, 2020 at 02:45PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top