কলকাতা, ১৬ সেপ্টেম্বর - পুলিশি জেরায় স্বামী রজত দে-র আত্মহত্যার তত্ত্ব প্রায় প্রতিষ্ঠিত করেই ফেলেছিলেন স্ত্রী অনিন্দিতা। কিন্তু বিধাননগর কমিশনারেটের এক শীর্ষকর্তার তা বিশ্বাস হয়নি। অগত্যা তিনি নিজেই কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীকে নিয়ে অনিন্দিতাকে জেরা করতে শুরু করেন। তাঁদের সমবেত প্রশ্নের মুখে ভেঙে পড়ে অনিন্দিতা শেষে স্বীকার করেন, তিনিই স্বামী রজতের গলায় মোবাইলের চার্জারের তার পেঁচিয়ে খুন করেছেন। তার পর সেটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর জন্য মৃতদেহের গলায় জড়িয়ে দিয়েছিলেন বিছানার চাদর। বুধবার অনিন্দিতার শাস্তি ঘোষণার আগে মঙ্গলবার রাজ্য পুলিশের ফেসবুক পেজে ওই খুনের ঘটনা এবং তদন্তের বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যে অফিসাররা অনিন্দিতাকে জেরা করেছিলেন, তাঁদের একজন বুধবার বলছিলেন, প্রথমে আমাদেরও মনে হয়েছিল ঘটনাটা আত্মহত্যারই। কিন্তু তার পর আরও তলিয়ে ভাবতে শুরু করি। মনে হয়, অনিন্দিতাকে আরও জেরা করা দরকার। কারণ, ওঁর জবাবে কোথাও কোথাও অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছিল। তার পরেই সত্যিটা বেরিয়ে আসে। অনিন্দিতা স্বীকার করেন নেন, তিনিই রজতকে খুন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে খুন, ষড়যন্ত্র এবং তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে মামলা শুরু হয়। ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর নিউটাউনের ফ্ল্যাটের বসার ঘরে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী, বছর চৌত্রিশের রজত দে-র মৃতদেহ উদ্ধার হয়। দেখা যায়, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তিনি মারা গিয়েছেন। কী ভাবে তাঁর শ্বাসরুদ্ধ হল, তা নিয়েই প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়। রজতের স্ত্রী অনিন্দিতাও পেশায় আইনজীবী। দুজনে প্রায় সমবয়সি। তিনি কলকাতা এবং বম্বে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। অনিন্দিতা প্রথম থেকেই বিষয়টিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করতে থাকেন। দুজনের এক সন্তান ছিল। কিন্তু রজতের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে থেকে দুজনের সম্পর্ক ভাল ছিল না বলে তদন্তকারীরা জানতে পারেন। সামনে আসে অনিন্দিতার গুগল সার্চ এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের ইতিহাসও। যেখানে তিনি বিবাহকে গণশৌচাগার-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। গুগল সার্চে স্ত্রী-র হাতে স্বামী খুনের বিভিন্ন ঘটনা পড়েছেন। ফেসবুকে অনিন্দিতার শেয়ার করা একটি খবরের লিঙ্ক পুলিশ দেখতে পায়, যেখানে এক মহিলা তাঁর স্বামীকে খুন করে, দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে, সেই মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে খাইয়েছিলেন রাজমিস্ত্রিকে। পুলিশের মতে, কী ভাবে খুন করলে তা আত্মহত্যা বলে চালানো যেতে পারে, সে ব্যাপারেও ভাল মতো খোঁজখবর নিয়ে, পরিকল্পনা মাফিক এগিয়েছিলেন অনিন্দিতা। আরও পড়ুন : থাকবেন না দিলীপ, মহালয়ায় গঙ্গার ঘাটে তর্পন করবেন কৈলাশ, মুকুল, রাহুল পুলিশি জেরায় সাত দিনে সাত বার বয়ান বদল করেছিলেন অনিন্দিতা। প্রথমে তিনি দাবি করেন, ঘটনার সময় তিনি অন্য ঘরে শুয়েছিলেন। আলো চলে গেলে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন, রজত বসার ঘরে মেঝেতে বসে আছেন। গলায় বিছানার চাদর জড়ানো। ঠেলা দিতেই তিনি মেঝের উপর পড়ে যান। অনিন্দিতা ভয় পেয়ে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে চলে যান। আবার কখনও তিনি বলেন, রজত নিজেই বসার ঘরের সিলিং থেকে বিছানার চাদর গলায় জড়িয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। আরও একাধিক তত্ত্ব তিনি খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন। বস্তুত, অনিন্দিতার বিভিন্ন বয়ানে একটা সময় পুলিশের একাংশ বিভ্রান্তই হয়ে পড়েছিল। তাদের মনে হয়েছিল, ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতা এবং ৯০ কিলো ওজনের রজতকে কি অনিন্দিতার পক্ষে তুলে ধরে গলায় ফাঁস দেওয়া সম্ভব? তদন্তে রজতের সমান ওজন ও উচ্চতার একটি ডামিও ব্যবহার করে হয়। সেখানেও আত্মহত্যার বিষয়টিই ক্রমশ প্রাধান্য পাচ্ছিল। সিনিয়র অফিসারদের প্রথম সন্দেহ হয়, যখন তাঁরা জানতে পারেন, ঘটনার কিছু দিন আগে তাঁদের সন্তান এবং পোষা কুকুরকে বরাহনগরে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অনিন্দিতা নিজেই। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তাঁদের ভাবায়, সেটি হল, ওই অবস্থায় দেখেও রজতকে হাসপাতালে পাঠানোর কোনও ব্যবস্থা না করা। অর্থাত্, তাঁকে বাঁচানোর কোনও শেষ চেষ্টা না করা। প্রসঙ্গত, রজতের ওই ভাবে মেঝেতে বসে থাকার খবর অনিন্দিতা প্রথম জানান তাঁর শ্বশুরমশাই সমীর দে-কে। তার পর খবর দেন নিজের ভাই অভীককে। সমীরবাবু এবং অভীক প্রথমে অনিন্দিতাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছন। কিন্তু অভীক পুলিশে খবর দেননি। রজতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও কোনও চেষ্টা করেননি। সমীরবাবুই প্রথম পুলিশকে বিষয়টি জানান। ঘটনাচক্রে, তিনি প্রথম থেকেই বলছিলেন, রজত আত্মহত্যা করেননি। তাঁকে খুনই করা হয়েছে। রজতের দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা যায়, তাঁর গলায় লিগেচার মার্ক ছিল। যা দড়ি, সরু তার বা রেশম ব্যবহার করলেই একমাত্র হওয়া সম্ভব। বিছানার মোটা চাদর জড়িয়ে শ্বাসরোধ করলে তা সম্ভব নয়। তখন পুলিশ আবার বিষয়টি নতুন ভাবে দেখতে শুরু করে। তদন্তে দেখা যায়, মোবাইলের চার্জারের তার জড়িয়ে রজতের গলায় ফাঁস দেওয়া হয়েছিল। তার পর বিভ্রান্তি তৈরি করতে তার উপর বিছানার চাদর জড়ানো হয়। কাজে আসে অনিন্দিতার বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট এবং তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটও। দেখা যায়, ওই দম্পতির সম্পর্ক শেষ দিকে কার্যত তলানিতে এসে ঠেকেছিল। তখন খুনের মোটিভ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হন তদন্তকারীরা। সেই পথে অনিন্দিতাকে টানা জেরা করতে থাকেন বিধাননগর কমিশনারেটের শীর্ষ অফিসাররা। সেখানেই তিনি ভেঙে পড়ে রজতকে খুনের কথা স্বীকার করেন বলে পুলিশ আদালতে জানিয়েছিল। সুত্র : আনন্দবাজার এন এ/ ১৬ সেপ্টেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/33tYyg6
September 16, 2020 at 01:09PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন