নিজস্ব প্রতিবেদক ● ৪ ডিসেম্বর, দেবিদ্বার হানাদার মুক্ত দিবস। প্রতিবারের ন্যায় এবারও দেবিদ্বারবাসী দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে উদযাপন করতে যাচ্ছে। ১৯৭১ সলের রক্তেঝরা দিনগুলোতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল। তারই ধারাবাহিকতায় দেবিদ্বার এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে ওই দিন হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমন পরিচালনা করে। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক কুমিল্লা- সিলেট মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিষ্ফোরনে উড়িয়ে দেয়া হয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জেনারেল আর, ডি হিরার নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এই অভিযান পরিচালিত হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং -ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা হয়ে দেবিদ্বারে আসে। হানাদাররা ওই রাতেই দেবিদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ দেবিদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহরটি দেবিদ্বার থেকে চান্দিনা রোডে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার সময় মোহনপুর এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুলি বিনিময় হলে মিত্রবাহিনীর ৬ সেনা সদস্য নিহত হয়। পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে পালিয়ে ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্টে চলে যাওয়ার সংবাদে ৪ ডিসেম্বর ভোর থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপগুলো এবং হাজার হাজার জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে উপজেলা সদর অভিমূখে আসতে থাকে এবং ‘জয়বাংলা” শ্লোগানে বিজয়ের উল্লাসে উপজেলা সদর প্রকম্পিত করে তোলে।
১৯৭১সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে মুক্তিযুদ্ধে দেবিদ্বারবাসীর অবদান ছিল অবিস্মরনীয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ‘যুদ্ধজয়ের নেশা’ দেবিদ্বারবাসীর মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনাছাউনি কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্ট সন্নিকটে থাকায় এ অঞ্চলের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অপর দিকে প্রায় একই ব্যবধানে ছিল ভারত সীমান্ত। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের ভারত সীমান্ত পারাপারে একমাত্র সহজ ও নিরাপদ এলাকা ছিল দেবিদ্বার। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিতে উপজেলার ফতেহাবাদ গ্রামের জমাদ্দার বাড়ি সংলগ্ন ‘নলআরা’(গভীর জঙ্গল) এবং প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর একমাত্র জিবীত সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ’র নিজ বাড়ি এলাহাবাদ গ্রামে দু’টি অস্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি শুভপুর গ্রামেও একটি স্যাটেলাইট মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। এখানে প্রাথমিক যুদ্ধ প্রশিক্ষণসহ যাচাই বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হতো। মুক্তিযোদ্ধাও এ অঞ্চলে অনেক বেশী। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় চট্রগ্রামের মিরেশ্বরাই প্রথম হলেও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দেবিদ্বার। বিগত আ’লীগ সরকারের আমলে ‘নলআরা’(গভীর জঙ্গল)’র অস্থায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্পে একটি স্মৃতিফলক এবং এলাহাবাদ গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘চেতনায় বাংলাদেশ’ নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণ করা হয়।
স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের বাইরে শত্রু সেনাদের সাথে সন্মূখসমরে প্রাণ বাজি রেখে ৩৩ বাঙ্গালীর আত্মহুতীর মধ্য দিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত ১৫ সদস্যের পাক হায়েনাদের একটি দলকে পরাস্ত করে নিরস্ত্র বাঙালীদের প্রথম বিজয় ছিনিয়ে আনার গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের তান্ডবের ছোঁয়া লাগেনি এমন গ্রাম দেবিদ্বারে নেই। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তার পরেই ছিল ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবা অঞ্চল। পাক হায়েনাদের নির্মম তান্ডবের স্বাক্ষর দেবিদ্বার সদরে সৃষ্ট গণকবর। বিগত আ’লীগ সরকার গণকবরে শায়িত শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন। তাছাড়া পাক সেনাদের সাথে সম্মূখসমরেও পিছিয়ে ছিলনা এ অঞ্চল। বরকামতা যুদ্ধ, ভানী এলাকার যুদ্ধ, বারুর যুদ্ধ, মহেশপুর, ধামতী-মাশিকাড়া ও ভূষণা পাক হায়ানাদের হত্যাযজ্ঞ উল্লেখযোগ্য।
পোনরা গ্রামে নৌ-কমান্ডো গ্রুপের উপর হামলা
নৌকমান্ডো’র ল্যাপ্টেন্যান্ট মোঃ ফজলুল হকের নেতৃত্বে নৌকমান্ডের ৫ সদস্যের একটি দল বাগিরতি নদীর তীরে ট্রেনিং শেষে ১৯৭১ সালের ১৫সেপ্টেম্বর ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের কাছে রিপোর্ট করলে, সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ তাদের জাহাজ ডুবির মাধ্যমে নারায়নগঞ্জ বন্দর অকেজো করতে ‘লিংপেড মাইন’সহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি দিয়ে নারায়নগঞ্জ পাঠান। ওই নির্দেশে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রুপ কমান্ডার নৌকমান্ডো ল্যাপ্টেন্যান্ট মোঃ ফজলুল হকের নেতৃত্বে নৌকমান্ডোর ৫ সদস্যসহ ৮সদস্যের একটি নৌকমান্ডো দল দেবিদ্বার উপজেলার পোনরা হয়ে নারায়নগঞ্জ নৌবন্দরে হামলার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে পোনরা গ্রামে রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক সেনাদের এ্যাম্বুসের মুখমোখী হয়ে পড়েন। ওই দিন পাক সেনাদের গুলি এবং বেয়নটের আঘাতে নারায়নগঞ্জ জেলার আবু বকর এবং সমরাস্ত্র বহনকারী দেবিদ্বার উপজেলার খলিলপুর গ্রামের এক অজ্ঞাত ব্যাক্তি শহীদ হন। দাউদকান্দি উপজেলার অধিবাসী গ্রুপ কমান্ডার নৌকমান্ডো ল্যাপ্টেন্যান্ট মোঃ ফজলুল হক, দেবিদ্বার উপজেলার এক মাত্র নৌ কমান্ডের সদস্য মোঃ আবুল হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। অপরাপর সদস্যগন যার যার মতো প্রাণ বাঁচাতে আত্ম গোপনে চলে যান। স্থানীয়রা শহীদ আবুবকরকে পোনরা চৌরাস্তার মোড়ে দাফন করেন এবং খলিলপুরের অজ্ঞাত শহীদ’র লাশ তার স্বজনেরা নিয়ে যান। শহীদ আবু বকরের কবরটি তার পরিবারের সহায়তায় পাকা করণ করা হয়।
ভিংলাবাড়ি- জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ যুদ্ধ
৩১মার্চ কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত ১৫সদস্যের একটি পাকসেনার দল পায়ে হেঁটে, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি বর্তমান কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে কাঁকডাকা ভোরে দেবিদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়ি এলাকায় স্থানীয়দের হাতে অবরুদ্ধ হয়। ওই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যানাগাত ভিংলাবাড়ি থেকে জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় ১৫কিলোমিটার সড়ক পথে যুদ্ধ চলে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত পাক হায়েনাদের সাথে নিরস্ত্র বাঙালীদের সম্মূখ সমরে পুরো দলটিকে পরাস্ত করে ৩৩ বাঙালী আত্মহুতিদান এবং আলফু ফকিরসহ অসংখ্য যোদ্ধার পঙ্গুত্ব বরনের মধ্য দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার গৌরব অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষনার মাত্র ৫দিনের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হায়েনাদের সাথে সম্মূখ সমরে পুরো দলকে পরাস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনার গৌরব বাংলাদেশে সম্ভবতঃ এটাই ছিল প্রথম। যে যুদ্ধটি ‘ভিংলাবাড়ি-জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। নিরস্ত্র বাঙালীরা সেদিন শত্রুসেনা নিধনে দেবিদ্বার থানার অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে। লুন্ঠিত অস্ত্র এবং মরিচের গুড়া নামক বঙ্গজ হাতিয়ারটিও ওই যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। পাক সেনারা সেদিন জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ নামে যে মসজিদটিকে ব্যাঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেছিল স্থানীয়রা ২০১০সালে সেই জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদটি ভেঙ্গে নতুন করে তৈরী করেন। নিরস্ত্র বাঙ্গালীরা কাঁকডাকা ভোর থেকে পাক হায়ানাদের দিনব্যাপী যুদ্ধে পথিমধ্যে আট পাকসেনাকে হত্যাপূর্বক মাটিতে পুতে ফেলে এবং জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়া অবশিষ্ট সাত জনকে হত্যাপূর্বক বস্তা বন্দি করে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরবর্তীতে প্রখ্যাত রাজাকার আফসু রাজাকার এবং আলী আহাম্মদ রাজাকারের নেতৃত্বে এ এলাকাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শিদের তথ্যমতে ওই যুদ্ধে ভিংলাবাড়ি থেকে জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। এই যুদ্ধে পাক সেনাদের গুলিতে প্রথম শহীদ হন চাঁপানগর গ্রামের নুরুল ইসলাম, তারপর বারেরা গ্রামের সৈয়দ আলী, আব্দুল মজিদ সরকার, সরু মিয়া, চরবাকর গ্রামের মমতাজ বেগম, নায়েব আলী, সফর আলী, সাদত আলী, লাল মিয়া, পৈয়াবাড়ি গ্রামের কেনু মিয়া, ঝারু মিয়া, বাজেবাকর গ্রামের আব্দুল মালেক, খলিলপুর গ্রামের আব্দুর রহিম, ফুলতলি গ্রামের ছফর আলী, কংশনগর গ্রামের তব্দল ড্রাইভার, ফরিদ মিয়াসহ ৩৩বাঙ্গালী শহীদ হন।
বরকামতা যুদ্ধ
১৯৭১সালের ১৪এপ্রিল। ওই দিন সমতট রাজ্যের রাজধানীখ্যাত এবং হিন্দু প্রধান ঐতিহ্য মন্ডিত বরকামতা গ্রামে হানা দিবে পাক হায়েনারা, এ সংবাদে সিপিবি নেতা কমরেড আব্দুল হাফেজ (সাবেক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কুমিল্লা জেলা কমিটির সাবেক সম্পাদক এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধচলাকালে ‘ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত বিশেষ গেরিলাবাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ‘ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত বিশেষ গেরিলাবাহিনীর বৃহত্তর কুমিল্লা (কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) জেলা ইউনিট কমান্ড ছিলেন) এবং আব্দুল হালিম পুলিশের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হন স্থানীয় প্রায় ৫হাজার জনতা। মাত্র দু’টি থ্রীনট- থ্রী রাইফেল ও লাঠি হাতে ‘জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে শত্রুসেনাদের উপর আকস্মিক হামলা চালায়। ওইদিন বিকেল ৪টায় ঢাকা- চট্রগ্রাম মহাসড়কের দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা কাঠেরপুল এলাকায় এক প্লাটুন পাক সেনা নেমে পায়ে হেটে বরকামতার দিকে এগুবার প্রস্তুতি কালেই পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী রাস্তার পাশে, পানের বরজের আড়ালে এবং ঝোঁপ-ঝারে লাঠি হাতে উৎপেতে লুকিয়ে থাকা প্রায় ৫ হাজার স্থানীয় জনতা লাঠি উঁচু করে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে এবং দু’টি রাইফেল থেকে গুলি ছুরতে থাকলে এক প্লাটুন পাক সেনার ৫জন পাক সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শত্রুসেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটে ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্টে ফিরে যায়। ওইদিন সন্ধ্যায় গ্রামের সকল মানুষ আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে পাঁলিয়ে যায়।
হিংস্র পাক হায়েনারা ওইদিন রাতে ব্যাপক শক্তি- সামর্থ নিয়ে পুনঃরায় বরকামতা গ্রামে এসে পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলে, লুট-পাট এবং অগ্নি সংযোগে গ্রামের সকল বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। যার লেলিহান শিখা প্রায় সপ্তাহব্যাপী প্রজ্বলিত ছিল। একই সময় দেবিদ্বার উপজেলার জাফরাবাদ গ্রামের কমরেড আব্দুল হাফেজের বাড়িতে রাত্রীযাপন করে ভারত সীমান্ত পারাপারের সময় লেখক সত্যেন সেন এদৃশ্য অবলোকন করেন। এবং তিনি তার লেখা ‘পথে-প্রান্তরে’ বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে বরকামতা গ্রামে হায়েনাদের এ বর্বরোচিত ঘটনার বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
বারুর যুদ্ধ
১৯৭১সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক বারুর গ্রামে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিলে, নিজ গ্রামকে রক্ষা করতে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্ট থেকে কুমিল্লা- সিলেট সড়ক হয়ে আসার পর বারুর গ্রামের প্রবেশ পথে এ্যাম্বুস পাতেন। স্থানীয় রাজাকাররা বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তাদের সহযোগীতায় আগত পাক হায়েনার দলটি উল্টো পথে নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো দলটিকে ঘিরে ফেলে এবং তাঁদের আটক করে। আটককৃতদের দ্বারা খননকৃত একটি গর্তের পাশে চোখ বেঁধে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই দিন বৃষ্টি থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স দিয়ে সতর্ক অবস্থা পর্যবেক্ষনেও সমস্যা হয়েছিল বলে জানা যায়। এ সময় ভাগ্যক্রমে একজন বেঁেচ যান। বাকি বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল আবেদীন, বাচ্চু মিয়া, সহিদুল ইসলাম, আলী মিয়া, আঃ সালাম, সফিকুল ইসলাম, মোঃ হোসেনসহ ৭ জনকে বারুর নিজ গ্রামেই সমাধিস্থ করা হয়।
গণকবর
পাক হায়েনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষর দেবিদ্বার উপজেলা সদরে প্রতিষ্ঠিত গণকবর। ১৯৭১ সালেন ২৪ জুলাই মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের উত্তর ও দক্ষিন বাখরাবাদ গ্রামে এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ২৪০ নিরিহ বাঙালীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওইদিন অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর নারীদের সম্ভ্রম লুন্ঠনের পর ২৩বাঙালীকে ধরে এনে পথিমধ্যে ৩জনকে ছেড়ে দেয়। বাকি ২০জনকে দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাক বিভাগের দক্ষিণপার্শ্বে এনে তাঁদের দিয়ে গর্ত খুড়ে ওই গর্তের পার্শ্বে হাত ও চোখ বেঁধে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। একজন ভাগ্যক্রমে বেঁেচে গেলে বাকি ১৯জনকে ওই গর্তে মাটি চাঁপা দেয়া হয়। বিগত আ’লীগ সরকার গণকবরে শায়িত শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন।
মহেশপুর গ্রামে পাক হায়েনাদের বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ ১৪ নিরীহ বাঙ্গালী
স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে মুরাদনগরসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন নিরাপত্তার জন্য দেবিদ্বার উপজেলার মহেশপুর গ্রামটিকে বেছে নেয়। তাই বিভিন্ন এলাকার যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষরা এ গ্রামে আশ্রয় নেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্সদের সহায়তায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতেন।
১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। মুরাদনগর উপজেলার বাইরা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর বেশকিছু নারী ভারতের শরনার্থী ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য মহেশপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক’র সিএন্ডবি ব্রীজ পার হওয়ার সময় দেবিদ্বার উপজেলার রসুলপুর গ্রামের লিল মিয়া রাজাকার(লিলা চোর) এবং মুরাদনগর উপজেলার বাইরা গ্রামের ফুল মিয়া রাজাকারের নেতৃত্বে একদল রাজাকার ওই মহিলাদের আটক করে এবং তাদের সাথে থাকা টাকা, গহনা মূল্যবান সামগ্রীসহ সব কিছু লুটে নেয়। এসময় মহিলারা তাদের সম্ভ্রম রক্ষায় সব কিছু ফেলে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে আসে মহেশপুরে। একদল রাজাকারও তাদের পিছু নেয়। মহেশপুর সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয় সংলগ্নে এসে তাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয়রা ৩ রাজাকারকে আটক করে জবাই করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজাকাররা পাক সেনাদের নিয়ে মহেশপুর গ্রামে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোগে তান্ডব চালায়।
দিনটি ছিল শুক্রবার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ইউছুফপুর ইউনিয়ন’র মহেশপুর গ্রামে সংঘটিত যুদ্ধদিনের হৃদয় বিদারক একটি ঘটনার দিন। যে ঘটনা আজও স্বজনদের মনে হৃদয় কাঁপানো শিহরণ তোলে। সময়টা বাংলা বর্ষপঞ্জীর শরৎকাল। মাঠে থৈ থৈ পানি, নাইল্যা (পাট) কাটার সময়। আজকের মতো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিলনা। যোগাযোগ’র এক মাত্র বাহন ছিল নৌকা। ওই দিন সকাল বেলা প্রায় ১৫/ ১৬টি নৌকাযোগে প্রায় ৭০/ ৭৫জন রাজাকার এবং পাক সেনা গ্রামে প্রবেশ করে। রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক হায়েনার দল ওই গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যাযজ্ঞসহ নির্মম ও বর্বরোচিত হামলা চালায়। ১৪ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা, ৬ টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভষ্মিভূতসহ ব্যাপক লুটপাট ও তান্ডব চালায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নৌকাযোগে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আব্দুল বারেক, মঞ্জুর আলী, আব্দুর রাজ্জাক, ছাফর আলী, আব্দুল জলীল(দুলু মিয়া), আনু মিয়া, সামসু মিয়া, আব্দুল মালেক, আব্দুল জলিল, রাজ্জাক মাষ্টারের ভাইগ্নাসহ ১১ বাঙ্গালীকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক সেনারা গ্রামের প্রায় ২৫০জন নারী, পুরুষ, যুবক, যুবতী এবং কিশোর ধরে এনে সেনাবাহিনীর হাবিলদার(অবঃ) আব্দুল জলিল মিয়ার বাড়িতে জমায়েত করে। বিকেল ৪টায় তাঁদের হত্যার পরিকল্পনা করে। হায়েনাদের মনোরঞ্জনের জন্য কয়েকজন যুবতী বাছাই করে নৌকায় তুলে নেয়। আটক লোকদের হাত-পা চোখ বেঁধে একে একে আরো ৩ জনকে হত্যা করে। সংবাদ পেয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা গ্রামটি ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। ততক্ষনে হত্যাযজ্ঞ চালানোর সংবাদে বাজেদপুর ঈদগাহ মাঠ থেকেই বৃষ্টির ন্যায় গুলি বর্ষন শুরু করে পাক সেনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি জানান দেয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাক সেনা ও রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে পড়ে। এক পাক সেনা আকস্মিক গুলিবর্ষন করার সময় তার পাশে থাকা এক রাজাকার ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। পাক সেনারা আরো ঘাবড়ে যায়। তারা হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে আটক ১৭জন যুবককে নৌকাযোগে তাদের পাড় করে দিতে হাত ও চোখ বাঁধন খুলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের কারনে মৃত্যুর পথযাত্রী অন্যান্য বাঙ্গালীরাও বেঁচে যায়। পাক সেনারা নৌকায় উঠার সময় নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য নৌকায় তোলে রাখা যুবতীদের নামিয়ে দিয়ে রাজাকারের লাশ ওই নৌকায় তোলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাক হায়েনাদের নৌকাবহরে হামলার পরিকল্পনা করলেও নৌকার মাঝিদের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকায় হামলা না করে বৃষ্টির ন্যায় গুলিবর্ষন করে পাক সেনাদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দেয়।
৭ পাক সেনা হত্যার দায়ে ভানী ও রাজ ামেহার এলাকায় ৩ কিলোমিটার ভষ্মীভূত
৭১ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের ভানী ও রাজামেহার এলাকায় শত্রু সেনারা হামলার প্রস্তুতি নেয়। এ সংবাদে মুক্তিযোদ্ধারা ওই এলাকার মূল প্রবেশ পথে মাইন পেতে রাখে। ঘটনার দিন শত্রুসেনারা একটি গাড়ি বহর নিয়ে ওই এলাকায় প্রবেশ করার সময় মাইন বিস্ফোরনে ৭ শত্রুসেনা নিহত হয়। এঘটনার ক্ষুব্ধ শত্রুসেনারা ওই এলাকার সড়কের দু’পাশের প্রায় ৩ কিলো মিটার এলাকার বাড়ি-ঘর সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি ভূষণা ও ধামতী গ্রামে হামলা ; ১১ নিরীহ বাঙ্গালী হত্যা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৯ সেপ্টেম্বর (১৪ আশ্বিন বাংলা) ধামতী ও ভূষণা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ঘাটি চিহ্নীত করে দু’প্লাটুন পাক সেনা বিশাল গাড়িবহর নিয়ে রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়। পূর্ব থেকে উৎপেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধার একটি দল গুলিবর্ষনে শত্রু সেনাদের রুখে দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের বিশাল বহর সম্পর্কে প্রথমে অবগত না হলেও পরে বুঝতে পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। শত্রু সেনারা ভূষণা গ্রামে ঢুকে ৬টি বাড়ি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দেয় এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মোহম্মদ আলী, আব্দুল গফুর, আব্দুল বারেক, আব্দুস সামাদ, সোনা মিয়াসহ ৫জনকে নির্মমভাবে গুলি করে এবং বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। এর আগে ভূষণা গ্রামের সেকান্দর আলীকে ২৫মার্চ কালো রাতে ময়নামতি সেনা নিবাসে কর্মরত অবস্থায় হত্যা করে, তাঁর লাশ আর স্বজনেরা ফিরে পায়নি। পরে শত্রু সেনারা ধামতী গ্রামের বিখ্যাত চৌধূরী বাড়িসহ ৯০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। শত্রু সেনারা ধামতী আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলিম উদ্দিন পীর সাহেবের নাতী সহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ হালিম হুজুরের ভাইগ্না জোহর আলী ও আব্দুল বারী, সহোদর তাজুল ইসলাম এবং নজরুল ইসলামকে তাদের স্বজনদের সামনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ভিড়াল্লা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান খান’র কবরসহ অসংখ্য স্মৃতি স্বাধীনতার বেদীমূলে এই তরুনদের কবরগুলো পথিকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়, আজও পথিককে অশ্রুসিক্ত করে।
এ ছাড়া দেবিদ্বারের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান সৃষ্টিকারী প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর একমাত্র জীবিত সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত বিশেষ গেরিলাবাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কমরেড আব্দুল হাফেজ, যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের পালাটোনাক্যাম্প প্রধান সাবেক সাংসদ যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক এমএনএ আব্দুল আজিজ খান, আজগর হোসেন মাষ্টারসহ অসংখ্য যোদ্ধা অবদান রেখেছেন।
The post ৪ ডিসেম্বর দেবিদ্বার পাক-হানাদার মুক্ত দিবস appeared first on Comillar Barta™.
from Comillar Barta™ http://ift.tt/2gmRTdR
December 04, 2016 at 09:33AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন