মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্বজুড়েই নানা পরিবর্তন আসছে। পাল্টে যাচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা নানা সমীকরণ। নতুন সমীকরণের একটি হিসাবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে ইরান-পাকিস্তান-চীন জোট। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মাখামাখির প্রতিক্রিয়াই দেশ তিনটিকে নতুন বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এ সমীকরণকে বাস্তবে রূপ দিতেই যেন ইরানি পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আলাদিন ব্রুজারদি পাকিস্তানে তিন দিনের সফর শেষ করলেন। সফর শেষের বিবৃতিতে তিনি জোরালোভাবে বলেছেন, ‘ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে অনেক গভীরে প্রোথিত সহযোগিতাকে কেউ প্রভাবিত করতে পারবে না।’
ব্রুজারদি এরপর ইরান, চীন ও পাকিস্তানের উচিত ‘ত্রিভুজ সহযোগিতা গঠন করার কথা বলে জানিয়েছেন, এটা এই অঞ্চলের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।’ সম্ভবত এবারই প্রথম ইরান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেউ প্রকাশ্যভাবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপাদান হিসেবে ইরান, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ‘ত্রিভুজ সহযোগিতার’ কথা ঘোষণা করলেন।
কূটনীতিক ও কৌশলগত চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত এবং তেহরানের রাজনৈতিক এস্ট্যাবলিশমেন্টে প্রভাবশালী ব্রুজারদির মুখ থেকে এ ধরনের কথা বের হওয়ার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। অনেকেই জানেন, তিনি ইরানের কূটনৈতিক উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রায়ই সিরিয়া ও লেবানন সফর করেন, যা ইরানের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিমালার একেবারে ঘনিষ্ঠপর্যায়ে পড়ে।
প্রথম যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো ব্রুজারদির মন্তব্যের সময়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি কথাটি বলেছেন। তেহরান ধারণা করছে, এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির রূপান্তর পর্বটি গঠিত হতে যাচ্ছে পারস্য উপসাগর, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া নিয়ে।
এ হিসাবটি মাথায় রেখে, জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রেসিডেন্ট আমলের মার্কিন হস্তক্ষেপবাদী নীতিতে ফিরে যাওয়া হবে বলে ইরান আশঙ্কা করছে। মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্ক পুনর্জীবিত করা এবং ইসরাইলের উদ্বেগকে কেন্দ্রে রেখে মার্কিন মধ্যপ্রাচ্যনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃঢ়প্রত্যয়ের বিষয়টি অগ্রাহ্য করতে পারে না ইরান।
আবার সৌদি আরবও মনে করছে, ট্রাম্প প্রায় নিশ্চিতভাবেই ইরানের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবেন এবং বারাক ওবামার প্রশাসনের শেষ কয়েক বছর ধরে চলা নীতিতে পরিবর্তন এনে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কর্তৃত্ব নতুন করে ঘোষণা করবেন।
ফলে যৌক্তিকভাবেই বলা যায়, মার্কিন-ইরান সম্পর্কে বড় ধরনের অবনতি ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না এবং এ প্রেক্ষাপটে ইরানের এ অঞ্চলে ‘কৌশলগত গভীরতা’ যতটুকু সম্ভব নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আবার ট্রাম্পের আমলে অদূরভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কে পাকিস্তানও অনিশ্চয়তার সামনে পড়তে পারে। ২০১১ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্কে ক্রমাগত জমতে থাকা মতপার্থক্য ছাড়াও বিষয়টা অনেকাংশে নির্ভর করবে আফগান যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
কিছু একটা ঘটবে বলে পাকিস্তান দৃঢ়ভাবে মনে করছে। ট্রাম্প যদি সামরিক সমাধান চান, তবে হাক্কানি নেটওয়ার্কের কার্যক্রম দমন করার জন্য পাকিস্তানের ওপর প্রবল মার্কিন চাপ সৃষ্টি হবে। একইভাবে চীনের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নজরে থাকবে।
তেহরান ধরে নিতে পারে, এ অঞ্চলে মার্কিন হস্তক্ষেপবাদী নীতি প্রতিরোধ করতে এবং সার্বিকভাবে আমেরিকার প্রভাব কমাতে ইরান, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে।
তেহরান মনে করতে পারে, আফগানিস্তানে সীমাহীন সময় পর্যন্ত প্রবল আমেরিকান সামরিক উপস্থিতি ইরান, পাকিস্তান ও চীনা স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় এখানে একটি অভিন্ন অবস্থান রয়েছে। এ আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ইরান যদি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) তার স্বার্থ জোরালোভাবে দেখতে পায়, তবে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
মজার ব্যাপার হলো, ব্রুজারদি এখানে রাশিয়াকে এনে একে ‘চার পক্ষীয় সহযোগিতামূলক’ সমীকরণ করেননি। এর কারণ সম্ভবত, সে মস্কো ও দিল্লিকে বিব্রত করতে চায়নি। তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও ইরানকে সম্পৃক্ত করে এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে ওই ধরনের কৌশলগত সমীকরণের সৃষ্টি হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কের আবহাওয়ায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে। আফগানিস্তান প্রশ্নে দুই দেশে তাদের মতপার্থক্য সফলভাবে একই বিন্দুতে আনতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে তারা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থানে নেই। ইরানও তালেবানের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলেছে। দুই দেশই ‘আফপাক’ অঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের উত্থানকে অভিন্ন হুমকি মনে করছে।
অন্য দিকে, ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর সুন্নি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর, যাদের কেউ কেউ গোপন সৌদি সমর্থনও পেয়ে আসছে, কার্যক্রম দমনের জন্য দেশটির দরকার পাকিস্তানের সহযোগিতা।
আবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাবেক পাকিস্তান সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের কমান্ডে থাকা সৌদি আরবের ইসলামি সামরিক জোটের, যা সৌদি আরবের নিরাপত্তার প্রতি পাকিস্তানের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই প্রতিনিধিত্ব করছে। এ ব্যাপারে তেহরান অস্বস্তি অনুভব করতে পারে।
তাহলে ব্রুজারদি যখন ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ সম্পর্কের কথা বলেন, তখন তিনি অবলীলায় তাদের সম্পর্কের মধ্যে থাকা জটিলতা এগিয়ে গেছেন। আসল কথা হলো, ১৯৭৮ সালে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর থেকে ইরানি ও পাকিস্তানি ‘ভাইদের’ মধ্যে কখনো আস্থা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের সাবলীল সম্পর্ক বিরাজ করেনি।
সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, তেহরানকে যে বিষয়টি ইসলামাবাদের কাছে নিয়ে গেছে তা হলো, সে মনে করছে, ট্রাম্পের সম্ভাব্য আঞ্চলিক রাজনীতির ফলে ইরানের মতো পাকিস্তানের মধ্যেও উদ্বেগের সৃষ্টি হবে। সহজ কথায়, ইরান চাচ্ছে ‘কৌশলগত গভীরতা’।
ইরান চাইবে না, সৌদি কক্ষপথে জোরালোভাবে থেকে যাক পাকিস্তান। আর পাকিস্তানও ভারত ও ইরানকে সম্পৃক্ত করে কৌশলগত অক্ষের পুনর্জীবন প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যেতে ইতস্ততা করবে না।
শেষ কথা হলো, ইরান ও পাকিস্তান উভয়েই মার্কিন প্রাধান্যের বিরুদ্ধে চীনকেই মনে করছে আত্মরক্ষার মাধ্যম। সিপিইসিও অর্থনৈতিক মাত্রা এনে দিয়েছে।
এই পর্যায়ে আরেকটি বিষয় উত্থাপন করা যায়, ট্রাম্প যতক্ষণ হোয়াইট হাউজে থাকবেন, ততক্ষণ মার্কিন-ইরান গঠনমূলক সম্পৃক্ততার কোনো ধরনের অবকাশ না থাকলেও পাকিস্তানি পরিপ্রেক্ষিত ভিন্নও হতে পারে।
পাকিস্তানি এলিটদের অগ্রাধিকার হতে পারে দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে নতুন মার্কিন প্রশাসনের সাথে সহাবস্থানের কোনো একটা রফা হয়ে যাবে। পাকিস্তানি এলিটরা ভারতের দিকে ট্রাম্পের ঝুঁকে পড়া ঠেকাতে সম্ভব সব কিছুই করবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল জেমস ম্যাটিস এবং এনএসসি জেনারেল মিখাইল ফিনের সাথে অনেক দিন ধরে পাকিস্তানিদের জানাশোনা রয়েছে। তবে ভারত অবশ্যই হিসাব কষছে, এটা দুইধারী তরবারি হতে পারে। কারণ ট্রাম্পের দু’জন নিরাপত্তা ‘জার’ রয়েছেন, যাদের সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে পাকিস্তানের দ্ব্যর্থবোধকতা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই।
নিশ্চিত করেই বলা যায়, ওয়াশিংটনের ঘেরাটোপে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রবল কূটনৈতিক লড়াই অপেক্ষা করছে। এই লড়াইয়ের ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত কৌশলগত অক্ষ গঠনের জন্য ব্রুজারদির আহ্বানে পাকিস্তানের সাড়া দেয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু কমটাই নিশ্চিত বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
from মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্য – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2ll3dxf
February 09, 2017 at 12:38AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন