আকরাম উদ্দিন ও মুজাহিদুল ইসলাম সর্দার, সুনামগঞ্জ ::
মহাজনি ও এনজিও ঋণের চাপে ও পরিবারের লোকজনদের খাদ্য সংকটে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকে মহাজন ও এনজিওর ঋণ পরিশোধ কীভাবে করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন রইল না হাওর এলাকার মানুষের। কৃষি-মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হাওরপারের মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস্য হাওর। এই হাওরে আর কিছুই রইল না। পাহাড়ি ঢলের পানিতে ধানের পর মৎস্য ভান্ডার খ্যাত হাওর ও নদ-নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠে। ধান পচে ও মাছ মরার গন্ধে নদী ও হাওরের পানি দূষণের কবলে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে, সুনামগঞ্জের ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য হয়ে পড়েছে মাছের বাজারগুলো। হাওরে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া কাঁচা ধানগাছ পচে পানি দূষিত হয়ে মাছ মরে যাওয়ার পর জেলা মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে এসব মাছ ধরতে ও না খেতে নিষেধ করার পর থেকে বাজারের এই অবস্থা হয়েছে।
প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে করে বেঁচে থাকা মানুষেরা হাওরে বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছেন না। এনজিও ঋণ, সুদখোর ও মহাজনি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নিজের জমির পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করা লোকজন মহাসংকটে পড়েছেন। পরিবারপরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পারি জমাচ্ছেন। ঋণের চাপে অনেকে হালের গরু বিক্রিও করছেন পানির দামে।
হাওরপারের হাতিয়া গ্রামের কৃষক লিটন মিয়ার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, প্রায় ৫ হাল জমি চাষ করেছিলাম। সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়মতো বাঁধ নির্মাণ না করায় অকাল বন্যায় হাওরের কাঁচা বোরো ফসল তলিয়ে যায়। বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এক মণ ধানও ঘরে তুলতে পারিনি। উপজেলার উমেদনগর গ্রামের কৃষক পাবেল মিয়া বলেন, সুদি ঋণ করে জমি চাষ করেছিলাম ফসল হারিয়ে আমরা আজ দিশেহারা।
সুনামগঞ্জে মাছের বাজার ফাঁকা : সুনামগঞ্জের ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য হয়ে পড়েছে মাছের বাজারগুলো। হাওরে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া কাঁচা ধানগাছ পচে পানি দূষিত হয়ে মাছ মরে যাওয়ার পর জেলা মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে এসব মাছ ধরতে ও না খেতে নিষেধ করার পর থেকে বাজারের এই অবস্থা হয়েছে।
জেলার ১৪২টি ছোট-বড় হাওরের বোরো ধান ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ কাঁচা ধানগাছ তলিয়ে যাওয়ার পর এখন সেগুলো পচে হাওরের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। এ কারণে গত ১৬ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন হাওর ও নদীতে মাছের মড়ক দেখা দেয়। মাছ মরে পানিতে ভেসে উঠে। প্রথম দুদিন এসব মাছ স্থানীয় মানুষজন ধরলেও পরে এসব মাছ না ধরতে ও খেতে নিষেধ করা হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, যেহেতু পানি দূষণে এসব মাছ মরে গেছে তাই এগুলো খেলে মানুষের নানা রোগ বালাই হতে পারে।
গতকাল সোমবার সকাল নয়টায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের প্রধান মাছের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কোলাহল নেই। নেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের কোনো ব্যস্ততা। একরকম ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য ছিল বাজার। শহরতলির ইব্রাহিমপুর গ্রামের বাসিন্দা মাছবিক্রেতা লোকমান হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ ধরে আমরা বেকার। হাওরে মাছ ধরা হচ্ছে না, তাই আমরাও মাছ পাচ্ছি না। বাজারে মাছ নিয়ে বসেও লাভ নেই, কোনো ক্রেতা আসছেন না। আরেক মাছ বিক্রেতা আমির হোসেন বলেন,‘আমরা তো বিপদে পড়েছি। মাছ বিক্রি না করলে সংসার চালাব কেমনে। কতদিন এভাবে চলে কে জানে।’ পৌর শহরের আরপিননগরের ব্যবসায়ী আবু মিয়া বলেন, ‘আপনি যে সময় আইছেন, এই সময়তো বাজারে মানুষের ভিড়ে পা ফেলা কঠিত হতো। এখন দেখেন কোনো মানুষ নেই। কি করব বুঝতে পারছি না।’
বাজারের পাশেই সবজি কিনছিলেন স্কুল শিক্ষক জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, হাওরে যেভাবে মাছ মরেছে এটা জানার পর এখন মাছ খাই কীভাবে। এই কয়দিন ধরে সবজি টবজি খেয়েই আছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার মাছ খাব।’ শরিফ উদ্দীন নামের আরেক ব্যক্তি বলেন,‘কেউ কেউ বলছে মাছ খেলে কোনো সমস্যা হবে না। তার পরও মানুষের একটা ভয় ঢুকে গেছে। তাই অনেকেই মাছ খাচ্ছে না।’
শুধু সুনামগঞ্জ পৌর শহরের মাছের বাজারে নয়, একই চিত্র জেলার গ্রামগঞ্জের হাটবাজারেও। জগন্নাথপুর উপজেলা শহরের মাছের বাজারেরও একই চিত্র দেখা গেছে। শহরের ইকরছই গ্রামের বাসিন্দা আলী আহমদ বলেন, তাদের উপজেলার নলুয়ার হাওরেই প্রথমে মাছের মড়ক দেখা দেয়। ব্যাপকহারে মাছ মরে ভেসে উঠে ও পচে যায়। মানুষ এসব দেখে এখন নিজে থেকেই মাছ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পরে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে মাইকিং করে মাছ ধরতে ও না খেতে বলা হয়েছে।’
সুনামগঞ্জে সিভিল সার্জন আশুতোষ চন্দ্র দাশ বলেছেন, মরা কিংবা পচা যাওয়া মাছ না খাওয়াই ভালো। একই সঙ্গে দূষিত পানি ব্যবহারে মানুষের নানা চর্মরোগ হতে পারে।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শংকর রঞ্জন দাস বলেছেন, আমরা সব হাওরের মাছ ধরতে নিষেধ করিনি। যেসব হাওরে বা নদীতে পানি দূষণ হয়েছে সেখানের মাছ ধরা ও না খেতে বলা হয়েছে। এখন কোথাও আর মাছ মরছে না। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তাদের হিসাব মতে, সুনামগঞ্জে হাওরে পানি দূষণের কারণে ৫০ মেট্রিক টন মাছ মারা গেছে। কবে থেকে মানুষ আবার মাছ থেকে পারবেÑএই প্রশ্নে তিনি বলেন,‘আমরা দুএকদিনের মধ্যে বিষয়টি জানাব।’
পানি দূষণ ও মাছের মড়ক সম্পর্কে বাংলাদেশ পরমাণু কমিশনের বিশেষজ্ঞ দিলীপ কুমার সাহা বলেছেন, হাওরে তলিয়ে যাওয়া ধান গাছ পহে পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। কমেছে অক্সিজেনে মাত্রা। এ কারণে মাছ, হাঁস ও অন্যান্য জলজপ্রাণী মারা গেছে। এখন বৃষ্টি হওয়ায় পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়েছে। কমেছে অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণ। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2pnrMZs
April 28, 2017 at 06:16AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন