শিবগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় দিনভর রুদ্ধশ্বাস অভিযান রাতে স্থগিত ❀ মুহুরমুহু গুলির শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহনী এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় সোয়াত সদস্যরা অভিযান বুধবার রাতে স্থগিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে আবার শুরু হবে এই অভিযান। সন্ধ্যা ৬ টা ৪০ মিনিটে শুরু হওয়া অভিযানচলাকালে মুহুরমুহু গুলির শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পতি হয়ে উঠে। পুরো এলাকাজুড়ে সাধারণ মানুষ চরম আত্মংক মধ্যে রয়েছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এসি তোহিদুল ইসলাম জানান, ত্রিমোহনী শিবনগর এলাকায় জঙ্গি আবু’র আস্তানায় জঙ্গিরা অবস্থান করছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের টিম ত্রিমোহনী শিবনগরের প্রত্যান্ত এলাকা সাইদুর রহমান জেন্টু বিশ্বাসের বাড়ি ঘিরে ফেলে। পুলিশ ভোর ৫ টার দিকে থেকে ঘিরে ফেলে বাড়িটি। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের টিমের অভিযান টের পেয়ে ওই বাড়ি থেকে একটি বিষ্ফোরণ ঘটনানো হয় এবং পুলিশকে লক্ষ করে ১ রাউন্ড গুলিও ছোড়া হয়। জবাবে পুলিশও বেশ কয়েক রাউন্ড পাল্টা গুলি চালায়।
ভোরেই ত্রিমোহনীতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে এমন খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক জনতা ভিড় জমায় ্ওই এলাকায়। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন ত্রিমোহনী ও সংলগ্ন শিবনগর গ্রামে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম এই ১৪৪ ধারা জারি করেন এবং তা মাইকযোগে এলাকায় প্রচার করা হয়। একই সময় ওই বাড়ি সংলগ্ন সাধারণ মানুষকে দুরে সরিয়ে দেয়া হয়।
পুলিশ সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাইদুর রহমান জেন্টু বিশ্বাসের ওই বাড়িতে ত্রিমোহনী গ্রামের আফসার আলীর ছেলে জঙ্গি রফিকুল ইসলাম আবু (৩০) ও তার স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন (২৩) ও দু’ শিশুকন্যা থাকতে পারে।
স্থানীয়রা জানায়, ত্রিমোহনী গ্রামের দরিদ্র আফসার আলী দু’ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রফিকুল ইসলাম আবু। পেশায় হাটে ঘাটে মশলা বিক্রেতা। প্রায় ৮ বছর আগে শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ইউনিয়নের আব্বাস বাজারের রুহুল আমীনের মেয়ে সুমাইয়াকে বিয়ে করে। বিয়ের পর তাদের দু’টি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। প্রথম কন্যা সন্তান নুরী (৭), অপর সন্তান সাজিদার বয়স মাত্র ৫ বছর। এলাকাবাসী জানায়, বিয়ের পর থেকে রফিকুল ইসলাম আবু পিতার বাড়ির সঙ্গে তেমন সর্ম্পক রাখতোনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার বেশ কয়েকজন মানুষ জানান, রফিকুল ইসলাম আবু’র শ্বশুর রুহুল আমীন জেএমবি’র সদস্য ছিলেন। সেই সুত্রধরেই রফিকুল ইসলাম আবু জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে।
শিবনগর গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে সমির আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ গভীররাতে প্রশাসনের লোকজন এলাকায় ঢুকে আবু’র খোজ খবর নেয়। ফজরের দিকে তার বাড়িটি ঘিরে ফেলে। হটাৎকরে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে আবু’র বাড়ি ঘিরে ফেলায় আমারা হকচকিয়ে যায়। ভয়ে এলাকা ছেড়ে দূরে সরে যায়’।
তিনি বলেন, ‘ পেশায় মশলা বিক্রেতা আবু ত্রিমোহনী হাট, চাতরা হাট, কানসাট হাটসহ আশেপাশের হাট বাজারে মশলা তরিতরকারি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কারো সঙ্গে তেমন মিশতো না। কথা বার্তাও বেশি বলতোনা। নিয়মিত নামাজ কালাম করতো। কিন্তু সেই যে এতোবড় জঙ্গি হবে তা আমরা ভাবতে পারিনি’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার মানুষ বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আগে থেকেই সেই ধর্মীয় কর্মাকান্ড করতো। একদিন আগে ঈদ উদ্যাপন, রোজা রাখা এসব কাজ করতো। তার স্ত্রীও ছিলো পর্দাশীল। প্রতিবেশিরাতো দূরের কথা পরিবারের লোকজনও তাকে ভাল করে দেখতে পায়নি।
পোশাকের সঙ্গে হাতে পায়ে মোজাও ব্যবহার করতো। আবু’র ছোট ভাই সবুরের স্ত্রী রুনা খাতুন বলেন, ‘ আমি একই পরিবারের মানুষ তবুও তাকে কখনও দেখিনি। শুধু চোখ দুটো খুলা থাকতো’।
পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য
বিয়ের পর থেকে রফিকুল ইসলাম আবু’র পরিবারের সঙ্গে বনিবনা ছিলনা। স্ত্রী সুমাইয়া খাতুনের সঙ্গে আবু’র মা ফুলশান খাতুনের বিবাদ লেগেই থাকতো। আবু’র সঙ্গে বাবার পরিবারের যোগাযোগ ছিল না বলে জানিয়েছেন আবুর মা ফুলসানা বেগম (৫০)। আবুর বাবা আফসার আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আবুর মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি জানান, ৮ বছর আগে বিয়ে করার পর থেকেই তার ছেলে শ্বশুর বাড়িতে থাকত। বাবা-মার সাথে আবুর খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না, তবে মাঝে মধ্যে আসত। সর্বশেষ ৫/৬ মাস আগে বাবার বাড়িতে কিছুদিন ছিল। এরপর বাবার সাথে ঝগড়া হওয়ায় তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়।  পরে আবু তার বাড়ির আধা কিলোমিটার দূরে জেন্টু বিশ্বাসের একটি অব্যবহৃত একটি নতুন বাড়ি ভাড়া নেন। বাড়ির মালিক জেন্টু বিশ্বাস তাকে  মূলত বাড়িটি দেখাশুনার জন্য বিদ্যুৎ বিলসহ সামান্য টাকায় ভাড়া দেয়া হয় বলে জানান বাড়ির মালিকের ছেলে আনারুল ইসলাম বাবুল। তিনি জানান, গত ফ্রেব্রুয়ারী থেকে তাদের বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল আবু। সেই বাড়িতে গড়ে তুলে জঙ্গি আস্তানা।
ভোরে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের টিমের অভিযানের মুখে বিকেলে দু’টি হেলিকপ্টারযোগে শিবগঞ্জে আসে সোয়াতের একটি টিম। সোয়া চারটার দিকে শিবগঞ্জ স্টেডিয়ামে হেলিকপ্টার অবতরণের পর সোয়াতের টিম ঘটনাস্থলে যায় ৫টার দিকে। সেখানে সোয়াত টিম আবু’র মাকে ডেকে নিয়ে প্রথমে চেষ্টার করে তার মায়ের আহবানের মাধ্যমে তাদের বাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে আসার। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে ৬টা ৪০ মিনিটে শুরু হয় সোয়াতের অভিযান। এক সময় বিকট শব্দে কয়েক বিষ্ফোরণ ঘটে। চলে লাগাতর গুলিবর্ষণ। গুলি বর্ষণে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে।
অভিযানকালে রাত সাড়ে ৮টার দিকে আর কোন গুলির শব্দ শোনা যায়নি। এরই মাঝে সোয়াতের এ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার রাত ৯টার সময় গণমাধ্যম কর্মীদের ব্রিফিং-এ জানান, সোয়াতের অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে আবার অভিযান শুরু হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ২৬-০৪-১৭


from Chapainawabganjnews http://ift.tt/2qfwwjf

April 26, 2017 at 11:35PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top