চার্লি চ্যাপলিন; কর্মচারী থেকে বিশ্বসেরা অভিনেতা

fবিনোদন ডেস্ক ::উনিশশো বাহাত্তর সালের এপ্রিল মাস। নির্বাক চলচ্চিত্রের সবচেয়ে খ্যাতিমান তারকা চার্লি চ্যাপলিন ২২ বছর পর আমেরিকায় ফিরলেন। যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করার পর দু’দশক ধরে তিনি সুইজারল্যান্ডে বাস করছিলেন।

জেনেভায় চার্লি চ্যাপলিনের যে বিশাল বাড়িটি রয়েছে সেটি এখন একটি যাদুঘর। বাড়ির চারপাশে বাগান। দূরে দেখা যাচ্ছে লেক জেনেভা।

এই বাড়িটি ঘুরে দেখাচ্ছিলেন চার্লি চ্যাপলিনের এক ছেলে। নাম তার ইউজিন চ্যাপলিন। তার জন্ম এই সুইজারল্যান্ডেই। মায়ের নাম উনা। বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম।

ইউজিন বলছেন, “এই বাড়িতে আমাদের জীবনটা ছিল এক আনন্দময় বুদ্বুদের মতো। খুব সুন্দর বাড়ি। কোথাও কোন সমস্যা নেই। একেবারে আদর্শ জীবন। বাইরের কোন সমস্যা আমাদের জীবনকে স্পর্শও করতো না।” উনিশশো সাতাত্তর সালের বড়দিনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চ্যাপলিন এই বাড়িতেই থাকতেন।

তার জীবনের শেষ দিনগুলির কথা বলছিলেন ইউজিন, “শেষদিকে বাবা খুব একটা ছবি বানাতেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই সুখী। তিনি আশপাশের এলাকায় ঘুরতে যেতেন। যে ধরনের স্বাভাবিক জীবন তিনি কামনা করেছিলেন, সুইটজ্যারল্যান্ডে তিনি সেটাই পেয়েছিলেন।”

কিন্তু চার্লি চ্যাপলিনের সন্তান হিসেবে তাদের জীবন কী স্বাভাবিক ছিল? ইউজিন জানাচ্ছেন, সংসারে তাদের মা-ই ছিলেন প্রধান। তিনিই বাড়ির সবকিছু দেখাশোনা করতেন। তার বাবা যখন কাজ করতেন, তখন তিনি সব দরোজা বন্ধ করে দিতেন। কোন ধরনের হৈচৈ পছন্দ করতেন না। বাড়িতে ছিল কড়া নিয়ম।

“রাতে আমরা যখন এক সাথে খেতে বসতাম। খাবার টেবিল থেকে উঠতে চাইলে অনুমতি নিতে হতো। আমাদের শিক্ষার ব্যাপারে বাবা ছিলেন খুবই কঠোর।”

“তিনি চাইতেন আমরা যেন পড়াশুনায় ভাল করি। আদবকায়দা শিখি। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, তুমি জীবনে যা খুশি তাই করতে পার। কিন্তু মনে রেখ যা করবে তা যেন ভাল মত করতে পার।”

ইউজিন চ্যাপলিন বলছেন, আদব কায়দা এবং শিক্ষার ওপর এত জোর দেয়ার ব্যাপারটা এসেছিল লন্ডনে তারা বাবার ছেলেবেলার দারিদ্র এবং কঠোর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। চার্লি চ্যাপলিনের বয়স যখন মাত্র ১৪, তখন তার মাকে পাগলা গারদে পাঠানো হয়। এবং তরুণ বয়স থেকেই মিউজিক হলগুলোতে কাজ করে তাকে অর্থ উপার্জন করতে হয়েছিল।

উনিশ বছর বয়সে চার্লি চ্যাপলিন আমেরিকায় পাড়ি জমান। পরবর্তী জীবনে বিশ্বজোড়া যে খ্যাতি তিনি পেয়েছিলেন তার সূচনা ছিল সেখানেই। আমেরিকায় এবং হলিউডে তখন ছিল নির্বাচক চলচ্চিত্রের যুগ। কৌতুক করার ব্যাপারে চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। লিটল ট্র্যাম্প নামে পরিচিত মাথায় বওলার হ্যাট, ঢোলা প্যান্ট এবং ছড়ি হাতে ভবঘুরের যে চরিত্রটি তিনি তৈরি করেছিলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেটা বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের থাকার সময় চার্লি চ্যাপলিন ৮০টিরও বেশি ছবি তৈরি করেন। সেসব ছবির চিত্রনাট্য তিনি তৈরি করতেন। মূল অভিনেতা ছিলেন তিনি। ছবি পরিচালনাও তিনিই করতেন। শেষ পর্যন্ত ছবি পরিবেশনার কাজও তার কোম্পানিই করতো। এসব ছায়াছবি থেকে তিনি যে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছিলেন, সেটা তার সৃষ্টিশীলতাকে দিয়েছিল বিশাল স্বাধীনতা। হলিউডে তাকে দিয়েছিল অনন্য এক অবস্থান।

কিন্তু এই খ্যাতি একই সাথে ব্যক্তিজীবনকে ঘিরে ফেলেছিল নানা ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনায়। চার্লি চ্যাপলিনের বামপন্থী চিন্তাভাবনার জন্য সেই সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর কিছু মানুষ তার শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। সে সময়ে হলিউডের অনেক অভিনেতা, চিত্র পরিচালক কিংবা লেখকের মতোই চার্লি চ্যাপলিনকেও ‘কংগ্রেশনাল কমিটি অন্য আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটি’র সামনে হাজিরা দেয়ার সমন জারি করা হয়।

তিনি বরাবরই অস্বীকার করেন যে তিনি একজন কমিউনিস্ট। কিন্তু ১৯৫০ সাল নাগাদ তার ব্যাপারে নানা ধরনের গুজব, এবং কেলেঙ্কারির ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। তার নববিবাহিত চতুর্থ স্ত্রী উনাকে সাথে নিয়ে চার্লি চ্যাপলিন যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করে ইয়োরোপে চলে যান।

সেই সময়টার কথা বলছিলেন ইউজিন চ্যাপম্যান, “বিয়ের সময় আমার মায়ের বয়স ছিল ১৮ বছর। আর আমার বাবার বয়স ছিল ৫৪। লোকে এই বিয়েটাকে ঠিক ভালভাবে নেয়নি। তিনি যখন জাহাজে চড়ে ইয়োরোপের দিকে যাচ্ছিলেন তখন তার কাছে একটি টেলিগ্রাম আসে। সেটাতে তাকে জানানো হয় যে তার মার্কিন ভিসা আর নবায়ন করা হবে না।”

“তিনি যদি আবার যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে চান, তাহলে নৈতিকতা সম্পর্কিত একটি কমিটির সামনে তাকে হাজিরা দিতে হবে। এটা শুনে তিনি তখন বলেছিলেন, কোনভাবেই তিনি হাজিরা দেবেন না। এরপর তিনি চলে চান সুইজারল্যান্ডে। ঐ ঘটনায় তিনি মনে খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না। কিন্তু তার খ্যাতি আর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে অনেক লোকই ভালভাবে গ্রহণ করে পারেনি।”

এর পরের ২০ বছর ধরে চার্লি চ্যাপলিন সুইজারল্যান্ডে ৩৫-একরের এক বিশাল বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। চলচ্চিত্র দুনিয়ার জ্ঞানী-গুণীজন নিয়মিতভাবে তার সাথে দেখা করতে যেতেন। যুক্তরাষ্ট্রে না গেলেও বিশ্বের অনেক দেশেই তারা ভ্রমণ করেন।

এই সময়ে চ্যাপলিন আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন এবং তার পুরনো ছবিগুলোর নতুন সম্পাদনা শুরু করেন। বাড়িতে যতই কঠোর নিয়মকানুন থাকুক না কেন, চার্লি চ্যাপলিন একই সঙ্গে খুবই কৌতুকপ্রিয় ছিলেন বলে বলছেন তার ছেলে ইউজিন চ্যাপলিন।

সত্তর-এর দশক থেকে আমেরিকার রাজনৈতিক আবহাওয়া বদলে যেতে শুরু করে। মার্কিন চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে চার্লি চ্যাপলিনকে অস্কার পুরষ্কার দেয়া হয়। এবং যুক্তরাষ্ট্রে সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রে খারাপ অভিজ্ঞতার কথা তার মনে ছিল। তাই ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন নিশ্চুপ।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর কথায় রাজি হয়ে চার্লি চ্যাপলিন নিউ ইয়র্কের বিমান বন্দরে এসে নামলেন। সেটা ছিল ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস। তার বয়স তখন ৮৩ বছর। তার চুল সব সাদা। দুই দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে চ্যাপলিন পা রাখেন।

এর পরের দিনগুলোতে তিনি বিভিন্ন শহরে বেড়াতে যান। অনেক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করেন। যে অস্কার অনুষ্ঠানে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন সেখানকার অতিথিরা দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে চ্যাপলিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু ততদিনে চার্লি চ্যাপলিনের শরীর ভেঙে গিয়েছিল। নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ দেখা দিয়েছিল।

আমেরিকা সফরের পাঁচ বছর পর ১৯৭৭ সালের বড়দিনে সুইজারল্যান্ডের বাড়িতে চার্লি চ্যাপলিন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

বাবার পথ ধরে ইউজিন চ্যাপলিন এখন নাট্য পরিচালনা, স্টেজ পরিচালনা এবং সঙ্গীতকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

তিনি এখন সুইটজাল্যান্ডের তাঁর পৈত্রিক বাড়ির কাছাকাছি এক নিভৃত পল্লীতে বসবাস করছেন।



from যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2qQUQMK

May 17, 2017 at 05:44PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top