ঢাকা::স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য দলের ভেতরের মানুষদের ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করেছেন শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যায় তৎকালীন মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদের জড়িত থাকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এই ষড়যন্ত্রের সাথে আরও অনেকে জড়িত ছিল’।
‘আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। সে সুযোগটা (তারা) করে দিয়েছিল’।
বুধবার সকালে গণভবনে ৩৬তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি এসব ষড়যন্ত্র দেখে আসছি। আমি এগুলোর পরোয়া করি না। আমি বিশ্বাস করি যতদিন মহান আল্লাহ এবং বাংলার জনগণ পাশে রয়েছেন, মা-বাবার দোয়া ও আশির্বাদ রয়েছে ততদিন এই লক্ষ্য অর্জনকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছয় বছর প্রবাসে থাকার পর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তারপর এখন তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দিবসটি উপলক্ষে এদিন প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩০ জুলাই আমি ও শেখ রেহানা দেশ ছেড়ে যাই। সেসময় বিদেশে যাওয়াতো ছিল স্বপ্নের মত ব্যাপার। কিন্তু সেবার বিদেশে যেতে যেন কিছুতেই মন টানছিল না। আমরা খুব কাঁদছিলাম। কিন্তু যেতে হলো। এই তেজগাঁও এয়ারপোর্ট হয়েই আমরা দিল্লী এবং সেখান থেকে জার্মানী। কামাল, জামাল, রাসেল সবাইকে রেখে গিয়েছিলাম। কামাল-জামালের বউ সুলতানা রোজী সবাই এসেছিল এয়ারপোর্টে।
আর এই ১৭ মে যেদিন ফিরে আসি, সেদিন লাখো মানুষ। হাজার-হাজার মানুষ, সেই মানুষদের ভীড়ে আমি ৩০ জুলাই যাদের রেখে গিয়েছিলাম তাদের কাউকে পাইনি। আর বনানীতে গিয়ে পেলাম সারি সারি কবর। জানি না, আল্লাহ আমাকে কত শক্তি দিয়েছেন সহ্য করতে। এই দেশের জন্যইতো আমার বাবা সারাটা জীবন এতো কষ্ট করেছেন।
কারাগারে যেখানে তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছিলেন সেটাতো আজ উন্মুক্ত। সবাই গিয়ে দেখে আসতে পারেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) দুঃখকে কোনো দিন দুঃখ, কষ্টকে কোনো দিন কষ্ট মনে করেননি। বাংলাদেশের মানুষের কথাই ভেবেছেন, আমার বাবা এবং মা দু’জনেই।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, একটাই লক্ষ্য নিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলোম এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। সেটাই যেন করতে পারি। আর কোনো চাওয়া-পাওয়ার নেই।
আবেগাপ্লুত কন্ঠে শেখ হাসিনা আরো বলেন, আমি দুঃখিত এত কথা যে আমাকে বলতে হবে সেটা চিন্তাও করি নি। তবুও মনে হয় আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও জানার দরকার রয়েছে। আমি যখন দেশে ফিরি সে সময় আজকের অনেকের জন্মই হয়নি। আর তখন যারা ছিলেন তাদের অনেকেও বেঁচেও নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি একটাই কথাই বলব আমরা যারা রাজনীতি করি তারা যদি জাতির পিতার রাজনীতির দিকে তাকাই এবং তার আদর্শটা ধারণ করে রাজনীতি করি তাহলে আমরা দেশকেও কিছু দিতে পারব, দেশের মানুষকেও দিতে পারবো। মানুষ ধন-সম্পদের জন্য কতকিছু করে, কিন্তু মৃত্যু হলেতো আর কিছুই সাথে নিয়ে যেতে পারে না।
সান-শওকত, বিলাসিতায় জীবন কাটালে মৃত্যুর পর অনেক কিছুই মিথ্যা হয়ে যায়। কাজেই মানুষের জন্য যদি কিছু করে যাওয়া যায়, সেটাই সব থেকে বড় পাওয়া। আমরা বাবার কাছ থেকে মায়ের কাছ থেকে সেটাই শিখেছি। আর আজকে যতটুকু যাই চেষ্টা করে যাচ্ছি সেই শিক্ষা থেকেই করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, এদেশকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছানো আমার লক্ষ্য যেন আমার বাবার আত্মাটা শান্তি পায়। ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট সব হারিয়েছি, সব হারিয়ে নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় বিদেশে ছিলাম।
পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক অধ্যায় সম্পর্কে তিনি বলেন, কখনো ভাবতেও পারিনি এরকম ঘটনা আমাদের জীবনে আসবে। মাত্র ১৫ দিন আগে আমি আর রেহানা দেশে ছেড়ে বিদেশে যাই। অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। চলে আসবো কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ফিরতে পারলাম না। ’৭৫ এর কালো দিন আমাদের জীবনে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু আমরা হারিয়েছি তা তো না বাংলাদেশের জনগণ যে স্বপ্ন নিয়ে, যে আকাঙ্খা নিয়ে জাতির পিতার ডাকে অস্ত্র হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ক্ষুধা, দারিদ্র মুক্ত সমাজ গঠন, মর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
তিনি বলেন, আমরা সন্তান হিসেবে একটানা দুই বছর বাবাকে কাছে পাই নি। যে বয়সে ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় বাবার হাত ধরে, আমাদের সে সৌভাগ্য কখনো হয়নি। যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে কারাগারে। স্কুল-কলেজ জীবনে সব সময় ঐ কারাগারে যেয়েই সাক্ষাত করতে হতো। আমার বাবা একটা জাতির জন্য, একটা দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তিনি নিজের জীবনের দিকে একবারও ফিরে তাকাননি। সব কিছু বিলীন করে দিয়েছিলেন এদেশের মানুষের জন্য। মানুষের স্বার্থে।
শেখ হাসিনা বলেন, তখন এদেশের ৮০/৯০ ভাগ মানুষই তো দারিদ্র্যের নিচে ছিলো। তারা একবেলা খাবার পেতো না, পরণে জীর্ণ কাপড়, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। যা আমার বাবাকে সব সময় পীড়া দিতো। মানুষের ভাগ্য গড়ার জন্যই তো তিনি সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী তারাও কম অত্যাচারিত-নির্যাতিত হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সাবধান করেছিলেন, যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস করতেন না। বলতেন যে ওরা তো আমার ছেলের মতো আমাকে কে মারবে। যিনি বাংলাদেশের জনগণকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছিলেন তাদের একটা বিক্ষিপ্ত অংশের গুলিতে জীবন দিতে হলো বঙ্গবন্ধুকে। আমার এখনো মনে হয়, তাকে গুলি করছে তারই দেশের লোক, তার হাতে গড়া ঐ সেনাবাহিনীর সদস্য। তার হাতে গড়া মানুষ। জানি না তার মনে তখন কি প্রশ্ন জেগেছিলো? কিছু জানারও উপায় নেই, কারণ ঐ বাড়িতে তো কেউ বেঁচে ছিলো না।
from ঢাকা – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2qsIRDU
May 17, 2017 at 10:53PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন