ইউরোপ ::একজন বামপন্থি রাজনীতিক হিসাবে যিনি ৩০ বছর সংসদের পেছনের আসনে থেকে গেছেন, বিতর্কিত নানা ইস্যু সমর্থন করেছেন, বিবেকের তাড়নায় হরহামেশা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, সেই জেরেমি করবিন ২০১৫ সালে দলের নেতা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিস্ময় তৈরি করেন।
নেতৃত্বের নির্বাচনে অংশ নিতে লেবার পার্টির বামপন্থি অংশটি করবিনকে রাজি করিয়েছিলেন। তবে ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেননি, তিনি নির্বাচিত হবেন। বেটিং কোম্পানিগুলো বলেছিলো তার সম্ভাবনা ২০০র মধ্যে ১।
কিন্তু স্বল্পভাষী, দাড়িওয়ালা ৬৬ বছরের এই এমপির ব্যক্তিত্বে এমন অজানা কিছু ছিল যা লেবার পার্টির সদস্যদের আকর্ষণ করেছিলো। অন্য তিন চৌকশ, কমবয়সী, কেরিয়ার রাজনীতিকের বদলে তারা করবিনকে বিপুল ভোটে নেতা নির্বাচিত করে ফেলেন।
টনি ব্লেয়ার এবং গর্ডন ব্রাউনের নেতৃত্বের সময়ে লেবার পার্টির প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যারা তাদেরকে আবার উদ্বেলিত করতে সমর্থ হন জেরেমি করবিন। দলে দলে লেবার পার্টিতে নাম লেখাতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ যুবকরা।
যে বামধারার রাজনীতিকে লেবার পার্টি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন টনি ব্লেয়ার, জেরেমি করবিনের নির্বাচনে তার পুনরুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন লেবার পার্টির এমপিদের সিংহভাগ। তারা বলতে থাকেন করবিন আবার লেবার পার্টিকে অতীতে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তাতে দলের ক্ষমতায় ফিরে আসার সমস্ত সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। ছায়া সরকার থেকে একের পর এক লেবার এমপি পদত্যাগ করেন। খোলাখুলি বিদ্রোহ শুরু করেন নেতার বিরুদ্ধে।
চাপের মধ্যে কয়েক মাসের মধ্যে আবার নেতা নির্বাচন ডাকেন জেরেমি করবিন। আবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। নেতৃত্ব নেয়ার দু বছর না যেতেই সাধারণ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম জেরেমি বার্নার্ড করবিনের। উইল্টশায়ার কাউন্টির কিংটন সেন্ট মাইকেল নামে ছবির মত এক গ্রামে ছেলেবেলা কাটে তার। চার ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ছিলেন তিনি।
মা ছিলেন শিক্ষক, বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। কিন্তু দুজনেই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। বাড়িতে রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা বিতর্ক হতো। জেরেমি করবিনের বড় ভাই পিয়েরস একজন কড়া বামপন্থি।
স্কুল ছাড়ার প্রায় পরপরই পোশাক শ্রমিকদের ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন জেরেমি করবিন। পরে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিকাল ইউনিয়নে এবং ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পাবলিক এমপ্লয়িজের সাথে যুক্ত হন।
কিন্তু তার আসল উৎসাহ ছিলো লেবার পার্টি। ১৯৭৪ সালে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে উত্তর লন্ডনের হ্যারিংগে কাউন্সিলের নির্বাচিত হন তিনি। ঐ একই বছর সহকর্মী নারী কাউন্সিলর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেন চ্যাপম্যানের সাথে তার বিয়ে হয়।
মিস চ্যাপম্যান বলেছিলেন, মি করবিনের “সততা” এবং “নৈতিকতায়” আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু রাজনীতির প্রতি তার আসক্তিতে হতাশ হয়ে পড়েননি মিস চ্যাপম্যান। “রাজনীতি আমাদের জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। প্রতি সন্ধ্যাতেই জেরেমি বাইরে থাকতো।”
মিস চ্যাপম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে একদিনও তাকে রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে যাননি জেরেমি করবিন। বিয়ে টেঁকেনি বেশিদিন কিন্তু তারা যোগাযোগ রেখেছেন।
নিজের সাদাসিধে জীবনযাপন নিয়ে জেরেমি করবিন ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি বেশি টাকা পয়সা খরচ করিনা, খুব সাধারণ জীবন আমার। আমার কোনো গাড়ি নেই। সাইকেলে যাতায়াত করি। আমি উচ্চশিক্ষায় যাইনি কখনো, ফলে যাদের উচ্চশিক্ষা নেই, তাদের প্রতি নিচু চোখে তাকাইনি। আবার যাদের উঁচু ডিগ্রি রয়েছে তাদের প্রতি আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকিনি। আমাদের রাস্তাগুলো যারা ঝাড় দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই এই সমাজের অত্যন্ত মেধাবী লোকজন।”
১৯৮৭ সালে চিলির একজন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ক্লডিয়া ব্রাশিটা দ্বিতীয়বারের মত বিয়ে করেন করবিন। এই বিয়ে থেকেই তিনটি ছেলে। এক ছেলে লেবার পার্টিতে। এই বিয়েও টেঁকেনি। ১৯৯৯ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
পরে ২০১২ সালে মেক্সিকোর একজন মানবাধিকার আইনজীবীকে বিয়ে করেন করবিন।
১৯৮৩ তে লন্ডনের ইজলিংটন এলাকা থেকে লেবার পার্টির হয়ে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন করবিন। তখন থেকে বারবারই তিনি সেখানকার এমপি।
টনি ব্লেয়ারও উত্তর লন্ডনের একই এলাকার বাসিন্দা। একই সময়ে দুজন সংসদে ঢোকেন। কিন্তু রাজনীতি তাদের ব্যবধান বিশাল।
টনি ব্লেয়ারের অবাধ বাণিজ্য নীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন জেরেমি করবিন। সে জন্য বার বার সরকারের আনা বিভিন্ন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন তিনি। দলের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
৭০ এবং ৮০র দশকে লেবার পার্টিতে যখন অর্ন্তকলহ চরমে ওঠে, করবিন তখন দলের বামপন্থি অংশের সাথে ছিলেন।
লেবার পার্টির প্রয়াত বাম নেতা টনি বেনের শিষ্য ছিলেন তিনি। টনি বেনের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। দুজনেই বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সরকারের হাতে থাকতে হবে। একতরফা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের সমর্থক ছিলেন তারা। অভিন্ন আয়ারল্যান্ডের সপক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।
ফিলিস্তিনীদের স্বশাসনের পক্ষে কথা বলেছেন সবসময়। শান্তি আলোচনায় হামাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। একসময় আইআরএ’র সাথে মীমাংসা আলোচনার কথা বলেছেন।
৮ই জুনের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিদ্বন্দি কনজারভেটিভ এবং দক্ষিণপন্থি মিডিয়া এই সব প্রশ্ন তুলে তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে।
তবে সেসব অগ্রাহ্য করে জেরেমি করবিন ক্রমাগত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, রেলখাতের রাষ্ট্রীয়করণ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর কথা বলে গেছেন। বহু মানুষ তার এই সব বার্তায় আকৃষ্ট হয়েছে।
from যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2sKaYNx
June 09, 2017 at 04:02PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন