ঢাকা::
রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, জোয়ার সাহারা প্রভৃতি মৌজার ১৫ লাখ মানুষের জমিজমা এবং বসতবাড়ির খাজনা ও নামজারি সমস্যার সমাধান কবে হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। একাধিক প্রেসিডেন্ট অর্ডার, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, মন্ত্রিপরিষদের জারি করা আদেশ, কোনো পদক্ষেপই তাদের মৌলিক অধিকারটুকু বহাল করতে পারেনি।
২৮ বছর ধরে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে মাথা ঠুকেও তারা আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না। তাই নগরীর এই লাখ লাখ মানুষ তাদের বসতবাড়ি ঘিরে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আর্তি জানিয়েছেন।
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ অবমুক্তকৃত এক হাজার ৩৮৫ একর জমির খাজনা গ্রহণ ও নামজারি অব্যাহত রাখা সংক্রান্ত আন্ত মন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করেছেন আগামী বুধবার। সভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও ভূমিসচিবও থাকবেন। ভুক্তভোগী ১৫ লাখ নগরবাসী ওই সভায় সমস্যাটি সমাধানের জন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের আন্তরিক ভূমিকার প্রত্যাশা করছে। তাদের আশা, জেলা প্রশাসন ও রাজউকের হাত থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীকে বাঁচাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন তাঁরা।
ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা শামীম বানু শান্তি স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ড এবং তহশিল অফিসকে এসব এলাকার জমিজমার খাজনা এবং নামজারি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০০ সালের ১২ মার্চ ১১৭ স্মারকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্রে এসব এলাকার জমির খাজনা এবং নামজারির বিষয়ে আপত্তি করা হয়েছে; যার জন্য উক্ত এলাকার অধিগ্রহণকৃত জমির অবমুক্ত গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত খাজনা কিংবা নামজারি কার্যক্রম করা যাবে না। এই চিঠিই সংশ্লিষ্ট এলাকার ১৫ লাখ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, একাধিক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মীমাংসিত একটি বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী এবং ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বেআইনি হস্তক্ষেপ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা ১৭ মার্চ এক যৌথ প্রতিবেদনে অধিগ্রহণকৃত উল্লিখিত জমিজমা অবমুক্ত করার মতো নয় বলে অভিমত দিয়েছেন। আলোচ্য ভূমি রাজউক কর্তৃক চূড়ান্তভাবে অধিগ্রহণ করে সেখানে এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বরাদ্দের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে তাঁরা উল্লেখ করেন।
এলাকা ঘুরে জানা যায়, ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিগ্রহণকৃত এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে রাজউক ও জেলা প্রশাসকের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ লাখ মানুষ রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন সর্বস্ব দিয়ে কেনা এবং বাপ-দাদার সম্পত্তি রক্ষার জন্য সংগঠিত হয়েছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫৬-৫৭ ও ১৯৬১-৬২ সালে দুটি এলএ কেস (ভূমি অধিগ্রহণ মামলা) থেকেই এসব এলাকাবাসীর দুর্দশা শুরু। প্রয়োজন না হওয়ায় এলএ কেসের আওতাভুক্ত জমি সরকার অবমুক্ত করে দেয়। পরে জমি অবমুক্ত করে লাখ লাখ মানুষের দুর্দশা লাঘব করার জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ এবং পরে সাহাবুদ্দীন আহমদ লিখিত নির্দেশও দেন। এর পরও নানা অজুহাতে কিছু সরকারি আমলা এবং ডিসি অফিসের কর্মকর্তা এলাকাবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন। দুটি প্রেসিডেন্ট অর্ডারের পরও কিভাবে সে জমি অধিগ্রহণভুক্ত থাকে সেটাই এলাকাবাসী বুঝতে পারছে না।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা যায়, রাজউক থেকে কখনো তাদের বলা হয়নি যে ওই জমি তাদের। এ ধরনের কোনো চিঠি ডিসি অফিসের কোথাও রক্ষিত নেই। কারণ প্রেসিডেন্ট অর্ডারের পর, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের পর পত্রপত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেসব জমি জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে তো তাদের মাথা ঘামানোর কথা নয়। এর মধ্যে ডিসি অফিসের কোনো কোনো কর্মকর্তা কেন বিষয়টি নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে উঠলেন সেটাই রহস্যজনক।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঢাকার ডিসি ও রাজউকের চেয়ারম্যান সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করছেন। তাঁরা জনগণ ও ক্ষমতাসীন সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। ভূমি প্রশাসন-ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা তাঁদের থাকলেও কারো ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক সম্পত্তির মালিকানার ওপর তাঁদের কোনো অধিকার নেই। অথচ তাঁরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেটাই করছেন। হঠাৎ করে তাঁরা কেন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, সে রহস্য অজানা।
পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রাজউক থেকে নকশা পাস করিয়ে বিপুল টাকা খরচ করে বাড়ি নির্মাণ করার পর বলা হচ্ছে, এ জমি বা বাড়ির মালিক রাজউক। তাদের কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? এ ধরনের দাবি যাঁরা করছেন, তাঁদের তো বিবেচনাবোধ থাকা উচিত।
অন্যদিকে জমি অবমুক্ত করে নামজারির অনুমোদন ও খাজনা গ্রহণ করেও ঢাকা ডিসি অফিস এখন বলছে, ওই জমি রাজউকের। তাই এর নামজারি বন্ধ থাকবে এবং খাজনা নেওয়া যাবে না। এ ধরনের পরস্পরবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যারা নিরীহ নগরবাসীর ঘুম কেড়ে নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জোয়ার সাহারার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নুরুল আলম (৮০) বলেন, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভূমিমন্ত্রী ও সচিবের প্রতি আকুতি জানাচ্ছি, আপনারা যেভাবে হোক এলাকাবাসীর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু কেড়ে নেবেন না। গুটিকয়েক আমলার কুদৃষ্টি থেকে নিরীহ মানুষদের রক্ষা করুন। জীবনের শেষ সম্বল বাপ-দাদার ভিটার খাজনা ও নামজারি সমস্যার সমাধান করে দিন। প্রয়োজনে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসস্থান সুরক্ষা করতে পারি। ’
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিষয়টি সমাধানে অধিকাংশ কর্মকর্তা আন্তরিক। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা নিরসনে তাঁরা চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। এ জন্য তাঁরা একাধিক আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক করে যাচ্ছেন। কিন্তু ঢাকা জেলা প্রশাসন ও রাজউকের অসহযোগিতার কারণে নগরীর এই ১৫ লাখ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তারা খাজনা গ্রহণ ও নামজারি অব্যাহত রাখলেও বর্তমানে এর বিরোধিতা করছে। এটা তাদের পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপ।
অভিযোগ উঠেছে, রাজউক চেয়ারম্যান এবং ঢাকা জেলা প্রশাসন যোগসাজশ করে সমস্যাটি জটিল করে তুলছে। তারা জোয়ার সাহারা, বাড্ডা ও ভাটারা মৌজার অবমুক্তকৃত জমিজমা ও বাড়িঘর সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করছে। এমনকি আন্ত মন্ত্রণালয়ের সভাগুলোতে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে। এ কারণে সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২১ মের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও রাজউককে ১৩৮ নম্বর এলএ কেসের অন্তর্ভুক্ত জমির মূল নথিপত্র এবং সে জমির ওপর হাজার হাজার বাড়িঘরের নকশা অনুমোদনের সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন জমি হুকুমদখলের কিছু নথি জমা দিলেও সেখানে জমি অধিগ্রহণের কোনো প্রমাণপত্র নেই। অন্যদিকে রাজউকের পক্ষ থেকে এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত এসংক্রান্ত কোনো নথিপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়নি। ১৯৯০ সালের ৯ এপ্রিল রাজউক ও মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কর্তৃক অবমুক্তকৃত এক হাজার ৩৮৫ একর জমির ডিটেইল ম্যাপ ও দাগসূচি থাকলেও সেটা রাজউক থেকে রহস্যজনক কারণে ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হচ্ছে না।
রাজউকের একটি সূত্র জানায়, রামপুরা ব্রিজ থেকে বিমানবন্দরের নিকুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে হাজার হাজার বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫-২০ তলা ভবনও রয়েছে। যমুনা ফিউচার পার্কও এর মধ্যে রয়েছে। প্রতিটি ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের আগে রাজউক থেকে বৈধ নকশা নেওয়া হয়েছে। রাজউক এসব জমির মালিক হলে অন্যদের বাড়ি করার নকশা অনুমোদন করল কিভাবে? মূলত এমন প্রশ্নবাণ থেকে বাঁচার জন্যই রাজউক ভূমি মন্ত্রণালয়ে নথিপত্র জমা দেয়নি। তাই আগামী ১৪ জুন অনুষ্ঠিত সভায় তাদের এ ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করা দরকার।
ঢাকা জেলা প্রশাসন ও রাজউক ভবন ঘুরে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটা সরকারি দুটি সংস্থার কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। বর্তমানে বিষয়টি ঢাকার ডিসি ও রাজউকের চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাঁরা জোর করে সাধারণ মানুষের বাড়িঘর জমিজমাকে সরকারি জমি হিসেবে দাবি করছেন। অথচ ওই জমির রেকর্ডপত্র, দলিল-দস্তাবেজ কিংবা দখলাদি কোনো কিছুই তাঁদের নেই।
স্থানীয়রা বলছে, তাঁদের এ ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়বে সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
তবে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বলে জানা গেছে। জোয়ার সাহারা, বাড্ডা ও ভাটারা মৌজার লাখ লাখ মানুষের জমিজমা ও বাড়িঘর সংক্রান্ত দুর্দশার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিষয়টি সমাধানের জন্য গত ১৫ মে ভূমি মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। অথচ বিষয়টি টিকিয়ে রেখে রাজউক ও জেলা প্রশাসন ১৫ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, জমির মালিকানা প্রমাণের জন্য রেকর্ডপত্র, দলিল কিংবা দখলাদি প্রয়োজন। অন্যদিকে একটি রেকর্ড গেজেটভুক্ত হলে আগের রেকর্ডটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। ওই আইনেই ১৩৮ নম্বর এলএ কেস থেকে অবমুক্তকৃত জমির মালিকরা ২০১৩ সাল পর্যন্ত খাজনা প্রদান ও নামজারি সম্পন্ন করেছে। এরপর তারা রাজউক থেকে নকশা অনুমোদন করে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
from ঢাকা – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2sdsufl
June 12, 2017 at 10:18AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন