উত্তম কুমার, নামেই যার পরিচয়। বাংলার রবার্ট ব্রুস খ্যাত এই নায়কের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিলো ১৯৪৭ সালে, মায়াডোর নামের একটি চলচ্চিত্রের পার্শ্বঅভিনেতা হিসেবে। যদিও ছবিটি মুক্তির স্বাদ লাভ করতে ব্যর্থ হয়।পরের বছর ১৯৪৮ সালে দৃষ্টিদান ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান উত্তম কুমার। তবে এবার আর পার্শ্বঅভিনেতা নয়, বরং ছবিটির নায়ক অসিত বরণের কিশোর বয়সের চরিত্রে অভিনয় করে নিজ যোগ্যতার প্রমাণ দেন। আর বছর ঘুরতেই কামনা নামের একটি ছবিতে নায়িকা ছবি রায়ের বিপরীতে নায়ক হিসেবে আর্বিভূত হন বাংলা চলচ্চিত্রের এই বরপুত্র। ক্যারিয়ারের শুরুতে টানা আট বছর একটি করে ছবিতে অভিনয় করেন উত্তম কুমার। কিন্তু ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস, এর একটি ছবিও ব্যবসায়িক ভাবে সফল হয়নি। ফলাফল হিসেবে উত্তম কুমার থেকে ফ্লপ মাস্টার পরিণত হন তিনি। তবে বসু পরিবার চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রথমবারের মতো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন তিনি। এরই মধ্যে ১৯৫৩ সালে সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে দর্শকদের সামনে আসেন উত্তম। যা তাকে বাংলা চলচ্চিত্রে স্থায়ী আসন গড়তে সাহায্য করে। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। ফলাফল হিসেবে অরুণ কুমার, অরূপ কুমারের যুগ পেরিয়ে ১৯৫৪ সালে শুরু হল উত্তমযুগ। এরই ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে উত্তম-সুচিত্রা জুটি বেশ কিছু দর্শকনন্দিত ছবি উপহার দেন। যার মধ্যে রয়েছে হারানো সুর, পথে হল দেরী, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃষ্ণা কিংবা সাগরিকার মতো ছবি। বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত, অমানুষ, আনন্দ আশ্রম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। একটি নায়ক অন্যটি চিড়িয়াখানা। রোমান্টিক গল্পের নায়ক হিসেবে পরিচিত লাভ করলেও উত্তম কুমার দুএকটি ভিন্ন স্বাদের ছবিতেও অভিনয় করছিলেন। যার একটি নায়ক। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। পাড়ার অভিনেতা থেকে অরিন্দম হয়ে উঠার গল্পে অভিনয় করতে গিয়ে উত্তম নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে চিড়িয়াখানা ছবিতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন উত্তম। তবে নিজেকে সু-অভিনেতা হিসেবে প্রমাণ করেন এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছবিতে স্বভাব সুলভ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। কারণ এই ছবিতে উত্তম কুমার তার পরিচিত ইমেজ থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছিলেন। এতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। উত্তমের সেই ভুবন ভোলানো হাসি, প্রেমিকসুলভ আচার-আচরণ বা ব্যবহারের বাইরেও যে থাকতে পারে অভিনয় এবং অভিনয়ের নানা ধরন, মূলত সেটাই তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও চিড়িয়াখানা ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে এর আগে ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত হারানো সুর ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন সমগ্র ভারতজুড়ে। সেই বছর হারানো সুর পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট। ইংরেজি উপন্যাস রানডম হারভেস্ট অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করা হয়। প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার নিজেই। কমেডি চরিত্রেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। দেয়া নেয়া ছবিতে হৃদয়হরণ চরিত্রে অভিনয় করে সেই প্রতিভার বিরল স্বাক্ষরও রেখে গেছেন। এক গানপাগল ধনীপুত্র অভিজিৎ চৌধুরীর বাবা কমল মিত্রের সঙ্গে রাগারাগি করে বন্ধু তরুণ কুমারের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। বাবা গান পছন্দ করেন না, কিন্তু অভিজিৎ চৌধুরীর লক্ষ্য ছিল অনেক বড় শিল্পী হওয়া। নায়িকা তনুজার মামা পাহাড়ি স্যানালের বাড়িতে হৃদয়হরণ নামে ড্রাইভারের কাজ নেয়। সাবলীল অভিনয় দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন হৃদয়হরণ চরিত্রটি। ছবিটির একটি আকর্ষণীয় সংলাপ ছিল টাকাই জীবনের সবকিছু নয়। এছাড়াও অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি গানও রয়েছে জীবন খাতার প্রতি পাতায়, যতোই করো হিসাবনিকাশ, পূর্ণ হবে না। ব্যক্তিগত জীবনে উত্তম কুমার ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। তার পিতার নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম চপলা দেবী। তার ছোট ভাই তরুণ কুমার একজন শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন। তারা একত্রে বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচিত্রে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমার গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন, তাদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। গৌরব চট্টোপাধ্যায়, উত্তম কুমারের একমাত্র নাতি, বর্তমানে টালিগঞ্জের জনপ্রিয় ব্যস্ত অভিনেতা। ১৯৬৩ সালে উত্তম কুমার তার পরিবার ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি তৎকালীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে বসবাস করেন,তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ২৪ জুলাই ১৯৮০ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি অভিনেতা।
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2tmshXO
June 29, 2017 at 09:20AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন