ঢাকা::
সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়ে ১৫ দিন ধরে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বাসিন্দা ফজলু মিয়া। হাসপাতালে কোনো বেড পাননি।
তাঁর ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। মেঝেতেও রোগী গিজগিজ করছে। তাই ওয়ার্ডের বারান্দায় শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফজলু মিয়ার মতোই অসংখ্য রোগী ওয়ার্ডের মেঝে কিংবা বারান্দায় শয্যা পেতে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেরই একই চিত্র। গতকাল বুধবার হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ১ নম্বর ওয়ার্ডের পুরুষ মেডিসিন ইউনিট ১ ও ৩। এখানে নিউরোলজি, ডার্মাটোলজি ও নেফ্রোলজির চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভর্তি করা হয়। শয্যাসংখ্যা ৭৭। সব কটি শয্যায় রোগী। মেঝেতেও ৩৩টি অস্থায়ী শয্যা পেতে রোগী রাখা হয়েছে। একই তলার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা মেডিসিন ইউনিট ১ ও ৩-এর চিত্রও একই রকম। এখানে ১৬টি পেয়িং বেডসহ মোট শয্যাসংখ্যা ৬৫। স্থান সংকুলান না হওয়ায় মাটিতে ১৬টি শয্যা পেতে রোগী রাখা হয়েছে। একই চিত্র দ্বিতীয় তলার কার্ডিওলজি বিভাগে। সেখানে ১৩ শয্যার পাশাপাশি আরো সাতটি অস্থায়ী শয্যা পাতা হয়েছে। একই তলার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের অর্থোপেডিক মহিলা ইউনিট ১ ও ২ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে ৩৯ শয্যার সব কটি পূর্ণ হয়ে মাটিতে আরো ১৭টি শয্যা ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি ওয়ার্ডের বারান্দায় আরো ১১টি শয্যায় রোগী রাখা হয়েছে।
হাসপাতালের তৃতীয় তলার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অর্থোপেডিক পুরুষ ইউনিট ১ ও ২-এর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এখানে নির্ধারিত ৬৬টি শয্যা পূর্ণ হওয়ার পর মেঝেতে আরো ৫৫টি শয্যা পাতা হয়েছে। তাতেও সংকুলান না হওয়ায় ওয়ার্ডের বারান্দায় আরো ১৯টি শয্যা পেতে রোগীদের রাখা হয়েছে। বারান্দায় ভর্তি থাকা বড়লেখা থেকে আসা রোগী ফজলু মিয়ার ভাগ্নে ছমির মিয়া জানান, মামাকে ২৪ মে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। রোগীর চাপ এত বেশি যে বারান্দায় জায়গাটুকু পাওয়াটাও যেন ভাগ্যের ব্যাপার। প্রচণ্ড গরমে খুব কষ্ট হলেও এ াড়া উপায় নেই।
সিলেট বিভাগের চার জেলার কোটি মানুষের উন্নত চিকিৎসার একমাত্র আশ্রয়স্থল এই হাসপাতাল। ১৯ বছর আগে হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যা থেকে ৯০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বাস্তবে ৫০০ শয্যার হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধাও নেই এখানে। বাস্তবে শয্যা যেমন বাড়েনি, তেমনি বাড়ানো হয়নি প্রয়োজনীয় লোকবল ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। সেই ৫০০ শয্যার চিকিৎসক, নার্স ও লোকবল দিয়ে ৯০০ শয্যার হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। অথচ এখানে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার রোগী এখানে ভর্তি থাকছে। গতকাল সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, এক হাজার ৮৭৮ জন রোগী ভর্তি অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে তিন হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকে। হাসপাতালে ওষুধপত্র ৯০০ জনের জন্য বরাদ্দ থাকলেও দ্বিগুণসংখ্যক ভর্তি রোগী থাকায় এগুলোও ভাগাভাগি করে দেওয়া হচ্ছে। তাই অনেককেই বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে হয়।
হাসপাতাল প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ৯০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য লোকবল প্রয়োজন দুই হাজার ২৬৪ জন। প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠালেও আজ পর্যন্ত কোনো পদই সৃষ্টি হয়নি। হাসপাতালে বর্তমান লোকবল মাত্র এক হাজার ৭০ জন। ৯০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য হাসপাতালে ৪৩৯ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ২১৫ জন, যা চাহিদার অর্ধেকেরও কম। একইভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সের ৮৪০টি পদের স্থলে মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে ৭০৬টি। এর মধ্যে কর্মরত ৪৪৪ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ৭১৭টি পদের বিপরীতে রয়েছে ৪০৫টি পদ। এর মধ্যেও আবার ৮০টি পদ শূন্য। হাসপাতালের সেবা তত্ত্বাবধায়ক, উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক, বায়োকেমিস্ট ও ফার্মাসিস্ট (গ্র্যাজুয়েট) পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এসব পদে ভারপ্রাপ্ত লোক দিয়ে কোনোমতে কাজ চালানো হচ্ছে। নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা থাকায় শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় চিকিৎসা কার্যক্রম চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের।
শয্যাসংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ) ডা. রথীন্দ্র চন্দ্র দেব কালের কণ্ঠকে বলেন, বৃহত্তর সিলেটের সবচেয়ে বৃহৎ ও উন্নত মানের হাসপাতাল হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে অনেক রোগী এখানে চলে আসে। সে কারণে প্রায় নিয়মিতই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি রোগীকে এখানে সেবা দিতে হয়।
হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দুই মাস আগে যোগদান করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক। হাসপাতালের সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সব কিছু স্বীকার করে নিয়েই শোনালেন আশার কথা। বললেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের সেরা হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে হাসপাতালের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাবে। ’
দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত করতে নানা কার্যক্রম শুরু করেছেন নতুন পরিচালক। এর মধ্যে হাসপাতালকে পরিচ্ছন্ন করতে সাপ্তাহিক পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বেশ আলোচিত হচ্ছে। প্রতি মাসের প্রথম ও তৃতীয় বৃহস্পতিবার ঘটা করে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। এতে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি চিকিৎসক এমনকি নার্সরাও অংশ নিচ্ছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নেওয়া রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার। তাদের সঙ্গে ন্যূনতম দুজন করে স্বজন থাকলে সেই সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার হয়ে যায়। এর বাইরে বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে প্রতিদিন রোগীদের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক স্বজন ভিড় জমায়। ফলে হাসপাতালের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে যায়। এ থেকে উত্তরণে রোগীর সঙ্গে একজনের বেশি স্বজন না থাকা এবং দর্শনার্থীদের জন্য সময় বেঁধে দিতে প্রচারণা শুরু হয়েছে। উদ্যোগটি দ্রুত কার্যকর করতে ঈদের পর ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হবে।
বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে পরিচালক বলেন, ‘লোকবল কম থাকায় সরকারি বিধি মেনে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু লোক নেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ রয়েছে। দালালদের উৎপাত রয়েছে, গাড়ি পার্কিং নিয়েও কিছু অভিযোগ আছে। বিষয়গুলো সমাধানে হাত দেব পর্যায়ক্রমে। ’
from সিলেট – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2rXyPf0
June 08, 2017 at 09:43AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন