ছিলেন ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রের অনন্য তারকা। মূলধারার ছবিতেও ছিলেন বিশিষ্ট। পর্দা থেকে পরে জড়িয়ে গেলেন সংগঠনে, সামাজিক উদ্যোগে, রাজ্যসভায়। শাবানা আজমী নিজের জীবন ও ভাবনার কথা বলছেন সাজ্জাদ শরিফকে সাজ্জাদ শরিফ: আমরা কীভাবে এগোব? বর্তমান থেকে অতীতে, নাকি অতীত থেকে বর্তমানে? শাবানা আজমী: অতীত থেকেই শুরু করা যাক। সাজ্জাদ: আপনার বাবা কাইফি আজমী ছিলেন কবি ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কমিউনিস্টদের আনাগোনায় আপনাদের ঘর সরগরম থাকত। মা শওকত আজমী ছিলেন নাট্যকর্মী, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কর্মীও। এই দুজনের মধ্যে কার জিন আপনার মধ্যে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল? শাবানা: দুজনারই। আমি আমার বাবা-মায়ের একদম সুষম ফসল। আমি যে আজকে অভিনেত্রী হয়েছি, এর পেছনে আমার মা আছেন। আমার যখন বয়স চার মাস, মা আমাকে পোঁটলায় ভরে পৃথ্বী থিয়েটারে তাঁর নাটকের মহড়ায় যেতেন। আমাদের অত টাকাপয়সা ছিল না। খাওয়ার পয়সা জোগাড় করা বড় কঠিন ছিল। তাই পরেও স্কুলের ছুটির দিনগুলোতে মা আমাকে নিয়ে থিয়েটারে চলে যেতেন, যাতে পৃথ্বী থিয়েটারে দলীয় অভিনয়ে আমিও মঞ্চে যুক্ত হয়ে যেতে পারতাম। পৃথ্বীরাজ কাপুর শিশু অভিনেত্রী হিসেবে আমার নাটকের পোশাক তৈরি করে দিয়েছিলেন। ফলে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। বলা যায়, নয় বছর বয়স থেকেই আমি একটা সাম্যবাদী কমিউনে জীবন যাপন করেছি। একটা বড়সড় ফ্ল্যাটের একেকটা ঘরে কমিউনিস্ট পার্টির একেকজন সদস্যের পরিবার থাকত। সাজ্জাদ: ব্যক্তিগত গোপনীয়তা জিনিসটার স্বাদ আপনি পাননি। শাবানা: কমিউনিজম বস্তুটা কী, তা-ও কি আমি বুঝতাম? হতো কী, বলুন তো? বাবা আমাকে তাঁর কাঁধে চড়িয়ে কৃষক-মজুরদের সভায় নিয়ে যেতেন। আমি দেখতাম, অজস্র লাল পতাকা উড়ছে। ভাবতাম, লাল রং মানে হচ্ছে পার্টি করার সময়। এ রকম ভাবার কারণও ছিল। কৃষক-মজুরেরা আমাকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কাঁধে কাঁধে আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। আমার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করত। আমার তিন বছরের ছোট ভাই বাবা আজমি, সিনেমাটোগ্রাফার। তাকে আর আমাকে নিয়ে বাবা মুশায়রাতেও যেতেন। আমরা অনেক সময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। মা নাটকের কাজে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাইরে গেলে আমাদের দেখাশোনার ভার পড়ত বাবার ওপর। ২২০ বর্গফুটের একটা ছোট্ট ঘরে আমরা থাকতাম। একটা বাথরুম ব্যবহার করতাম আটটা পরিবার মিলে। আলী সরদার জাফরির মতো কবিও সেখানে থাকতেন। বুঝতেই পারছেন, খুবই বুদ্ধিবৃত্তিক একটা আবহাওয়া ছিল সেখানে। আর ছিল নারী-পুরুষ সমতা, সামাজিক ন্যায়, সাধারণ মানুষের উত্থানের বাসনায় ভরা এক অসামান্য পরিবেশ। ব্যাপারটা এই নয় যে আমাকে বসিয়ে, বক্তৃতা শুনিয়ে বিরাট কোনো শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা ছিল জীবনযাপনেরই একটা ধরন। সাজ্জাদ: সেই সতেজ আবহাওয়ায় আপনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠেছেন। শাবানা: আমরা সব রকম উৎসব খোলামেলাভাবে উদ্যাপন করতে করতে বড় হয়েছিঈদ, হোলি, দিওয়ালি, ক্রিসমাস। ধর্ম সেখানে মোটেই প্রত্যক্ষ ছিল না। বাবা তো কমিউনিস্ট ছিলেন। বাড়িতেও তাই ধর্মচর্চা ছিল না। তবে সবার ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। সামাজিক রূপান্তরে যে শিল্পের একটা ভূমিকা আছে, এ ধারণা আমরা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো গ্রহণ করেছি। আমার বয়স যখন সাত, সে সময় বাবা আমাকে একটা কালো পুতুল উপহার দিয়ে বলেন, কালো রংও খুব সুন্দর। আমি একটা কনভেন্টে পড়তাম। অন্য সবার মতো আমিও তাঁর কাছে সব সময় একটা নীল পোশাকপরা পুতুল চাইতাম, যার গায়ের রং হবে সাদা, চুলের রং সোনালি। অনেক পরে বড় হয়ে, যখন আপনি নিজের জীবন নিজে যাপন করতে শুরু করেছেন, তখন বুঝতে পারবেন যে চারপাশের পুরো জগৎটা কীভাবে আপনার শিশুমনে ছাপ ফেলে আপনাকে তৈরি করেছে। সাজ্জাদ: কিন্তু পরে নিজেকে প্রকাশ করার বাহন হিসেবে এবং পেশায় আপনি আপনার মায়ের পথ ধরলেন। শাবানা: হ্যাঁ, মায়ের পথ আমি নিয়েছি, কারণ সব সময় আমি অভিনয় করেই এসেছি। স্কুলে পড়ার সময় আমাকে নায়কের পুরুষ চরিত্রটি করতে দেওয়া হতো। তারপর আমি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে পেলাম ফারুক শেখকে, আমার দুই বছরের সিনিয়র ছাত্র হিসেবে। নাট্যমণ্ডল নামে আমরা হিন্দি নাটকের একটা দল প্রতিষ্ঠা করলাম। আগে সেখানে সবাই শুধু ইংরেজি নাটকই করত। সেরা নাটক, সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রীসব পুরস্কার আমরাই নিয়ে আসতাম। সাজ্জাদ: মানে শৈশব থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত আপনি অভিনয় করেই এসেছেন? শাবানা: ঠিক তা-ই। তারপর আমি মনোবিজ্ঞানের স্নাতক হলাম। বাবাকে গিয়ে বললাম, এবার আমি অভিনয় করতে চাই। আপনি কী বলেন? বাবা বললেন, তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও, আমি তোমাকে সমর্থন দেব। কালকে যদি তোমার মুচি হতে ইচ্ছা করে, আমি তোমাকে সেরা মুচি হওয়ার জন্যই সব রকম সাহায্য করব। তাঁর সমর্থন ছিল নিঃশর্ত। আমি অভিনয় শিখতে পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখানে স্বর্ণপদক পেলাম সেরা ছাত্রী হিসেবে। সাজ্জাদ: যদি ভুল না করে থাকি, তাহলে এর মাঝখানে আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। আপনি জয়া ভাদুড়ীর একটা ছবি দেখেছিলেন, যা আপনার জীবনের লক্ষ্য বদলে দেয়। ছবিটা দেখে আপনি ভেবেছিলেন, বাহ্, এমন অভিনয়ও তাহলে এখানে করা সম্ভব! শাবানা: জয়া ভাদুড়ীর সেই ছবিটা ছিল একটা ডিপ্লোমা ফিল্ম। নাম সমাপ্তি। না, না, সমাপ্তি নয়। যে কাহিনির ওপর ভিত্তি করে ছবিটা তৈরি হয়েছিল, তার নাম ছিল সমাপ্তি। কিন্তু ছবির নামটা যেন কী ছিল...? সাজ্জাদ: সম্ভবত সুমন? শাবানা: হ্যাঁ, সুমন। দেখে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। জয়ার অভিনয়টা শুধু অপূর্ব ছিল না, ছিল একদম সত্যিকারের একটা জিনিস। তো আমি পুনায় এলাম। স্বর্ণপদক পেয়ে গেলাম। শুরু থেকেই আমার বৃত্তির ব্যবস্থা হয়ে গেল। পুনায় ছাত্র থাকতে থাকতেই আমি খাজা আহমদ আব্বাসের ফাসলা ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। এপ্রিল মাসে আমি স্নাতক হলাম স্বর্ণপদক পেয়ে। মে মাস থেকে আমার ছবির কাজ আরম্ভ হলো। আমাকে দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়নি। সাজ্জাদ: আপনার কি চোখে পড়েছে, সত্যজিৎ রায় তাঁর আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস বইয়ে শ্যাম বেনেগালের অঙ্কুর ছবিতে আপনার অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন? শুরুতে তাঁর সন্দেহ ছিল, গ্রামীণ আবহে, গ্রাম্য মেয়ের চরিত্রে আপনার শহুরে ধাঁচের চেহারা আদৌ কাজ করবে কি না। কিন্তু আপনার অভিনয় তাঁকে জিতে নিয়েছিল। শাবানা: তাঁর মন্তব্য আমার অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, নাটকীয় মুহূর্তে অভিনয়ের জন্য তিনি নিজেকে এ দেশের সূক্ষ্মতম অভিনেত্রীদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আপনি কল্পনা করতে পারেন? আমার জন্য সেই মন্তব্য ছিল একেবারে চূড়ান্ত। সাজ্জাদ: আপনি যখন অভিনয় করতে এলেন, তত দিনে ভারতীয় চলচ্চিত্রে একঝাঁ ক নতুন চিত্রপরিচালক চলে এসেছেন। নিউ ওয়েভ বলেন, প্যারালাল সিনেমা বলেনবাণিজ্যিক ছবির বাইরে তাঁরা অন্য ধরনের ছবি করতে শুরু করেছেন। নাসিরুদ্দীন শাহ, ওম পুরি, স্মিতা পাতিলের সঙ্গে আপনিও এসব সমান্তরাল ছবির তারকা হয়ে উঠলেন। মূলধারার ছবি শুরুর দিকে আপনাকে কেন সেভাবে টানেনি? শাবানা: আমি কিন্তু বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করেছি এবং সাফল্যও পেয়েছি। আমি শুরু থেকেই ওই ধরনের ছবি সমান্তরালভাবে করে গেছি। ফাকিরা আমার তৃতীয় ছবি। সে ছবি দারুণ ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছিল, স্বর্ণজয়ন্তী হয়েছিল। সাজ্জাদ: একদিকে আপনি কোনো কোনো ছবিতে সত্যিকার বা বাস্তবোচিত চরিত্র করছেন। আবার অন্যদিকে মূলধারার ছবিতে করছেন জীবনকে ছাপিয়ে যাওয়া চরিত্র। আপনার অভিনেত্রী সত্তায় এর কোনো টানাপোড়েন হয়নি? আপনি সামলেছেন কী করে? শাবানা: সেটা একটা অসম্ভব কাণ্ড। জানেন, বাণিজ্যিক ছবিতে সেই সময়টাতে শুধু একটা কাহিনি থাকত, কোনো চিত্রনাট্য থাকত না। সিন লেখা হতো সেটে আসার পরে। তারা ১০-১২টা ছবিতে একসঙ্গে কাজ করত। এক ছবির জন্য সকাল সাতটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কাজ করে পরের ছবিতে কাজ করত দুইটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছে যে খুব বেশি কিছু চাহিদা ছিল, তা-ও নয়। শুধু দেখতে সুন্দর হতে হতো, আর স্পষ্ট করে সংলাপটুকু বলে যেতে পারলেই চলত। কোনোখানে না আটকে, জড়তা না রেখে কথাগুলো বলে যেতে পারলেই ব্যস। মূলধারার ছবি থেকে ইদানীংকালে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছে উঁচু স্তরের অভিনয়ের চাহিদা আসতে শুরু করেছে। এক অর্থে আর্টহাউস সিনেমায় কাজ করা সহজ। কারণ, সেখানে একটা পরিকল্পিত চিত্রনাট্য আছে। ঘটনার পরিস্থিতিটাও বাস্তব। একবার মুম্বাইয়ের কোথাও রাজেশ খান্নার সঙ্গে অভিনয় করছি। চিত্রনাট্যের একটা পৃষ্ঠা ধরে যখন অভিনয় করছি, তখনো জানি না পরের পৃষ্ঠা কোথায়, তাতে কী আছে। চিত্রনাট্যের আরেক পৃষ্ঠা হয়তো অন্য কেউ অন্য কোথাও ভিন্ন কোনো স্টুডিওতে বসে লিখছেন। সেটা তো ফ্যাক্সের যুগ নয়। তাই লেখা শেষ হলে গাড়িতে করে এসে দিয়ে যেতে হতো। তারপরও যে কিছু একটা দাঁড়াত, সেটাই বড় আশ্চর্যের। সাজ্জাদ: আপনি আর স্মিতা পাতিলভিন্ন ধারার ছবিতে আপনারা ছিলেন সবচেয়ে সক্ষম দুই অভিনেত্রী। কিন্তু আপনারা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন খুব কম মান্ডি আর আর্থ মাত্র দুটো ছবিতে। আর কোনো ছবিতে একসঙ্গে কাজ করার জন্য কি আপনাদের কাছে কোনো প্রস্তাব আসেনি? নাকি আপনাদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল? শাবানা: আমরা ছিলাম একই ইন্ডাস্ট্রির মানুষ, একই চলচ্চিত্রগোষ্ঠীর সদস্য। একই চিন্তাধারা আমাদের প্রভাবিত করেছে। ওর বাবা-মার সমাজতন্ত্রে আস্থা ছিল। আমার বাবা-মাও সমাজ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। ওসব একেবারেই শিশুসুলভ বিষয়। সেসব নিয়ে বেশি কথা বলার কিছু নেই। সাজ্জাদ: বেশ কয়েকজন তরুণ রাগী নির্মাতার অনেকগুলো ছবিতে কাজ করার পর শীর্ষতম দুই চলচ্চিত্রকারের কাছ থেকে আপনার ডাক এল। আপনি সত্যজিৎ রায়ের শতরঞ্জকে খিলাড়ি আর মৃণাল সেনের খন্ডহর করলেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কি আলাদা কিছু ছিল? শাবানা: তফাতটা তরুণ বা প্রবীণের নয়, ধরনের। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ বা অপর্ণা সেনএঁদের সবার কাজ করার প্রক্রিয়া মোটের ওপর একই। বাণিজ্যিক ছবির কাজের ধাঁচ একেবারে আলাদা এবং বিচিত্র। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে সত্যজিৎ আমাকে তাঁর ছবিতে নিয়েছেন। এত অবিশ্বাস্য যে মনে হচ্ছিল সত্য নয়। আমার চরিত্রটা ছোট ছিল, কিন্তু আমি খুবই উপভোগ করেছিলাম। সাজ্জাদ: এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনারা পরিবারের সদস্যরা চাইলে তো একটা চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দিয়ে দিতে পারেন। চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, গীতিকার, গায়ক, অভিনেতা-অভিনেত্রীসবই আপনাদের আছে। এমন আবহাওয়া কি স্বস্তির না চাপের? শাবানা: সবাই একই জগতের লোক হলে সেটা ভালোই হয়। তখন আপনি জীবনযাপনটা বুঝতে পারেন। শিডিউল বদলে যাওয়ার ঝক্কি বোঝেন। কোনো পরিবারের সব সদস্য ব্যাংকার বা করপোরেট জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এই সুবিধাটা হয়। কেন শেষ মুহূর্তে অনেক কিছু বদলে যায়, কেন বাড়ি না ফিরে সারা রাত কাজ করতে হচ্ছেএসব বুঝতে অসুবিধা হয় না। সাজ্জাদ: পরিবারের সদস্য হিসেবে আপনি দুজন কবির নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন। একজন আপনার বাবা। তিনি এক রকমের কবি ছিলেন। আরেকজন আপনার স্বামী জাভেদ আখতার। তিনি আরেক ধরনের... শাবানা: আমার শ্বশুর জান নিসার আখতারও কবি ছিলেন। আসলে জাভেদের ওপরের সাত পুরুষই কবি। সাজ্জাদ: হ্যাঁ। জাভেদ আখতারের এক পূর্বপুরুষ ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবেও অংশ নিয়েছিলেন। তো বাবা এবং স্বামী হিসেবে দুজন কবির অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছে। তাঁদের দুজনের কাব্যিক ব্যক্তিত্বে মিল বা তফাত কতটা? শাবানা: তাঁদের প্রকাশের ধরন আলাদা, কিন্তু ভাবনা বা উদ্বেগের জায়গা অভিন্ন। তাঁদের আদর্শের জায়গা এক। নারী-পুরুষ সমতা, সামাজিক ন্যায়, সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নএসব ব্যাপারে তাঁরা দুজনই অত্যন্ত দায়বদ্ধ। ভাবনার ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যাপক ঐক্য আছে। তবে কাইফি আজমি প্রগতিশীল লেখকদের গোত্রভুক্ত ছিলেন। তাঁদের কিছু বাকরীতি ছিল, নিজেদের প্রকাশ করতে গিয়ে যা তাঁরা ব্যবহার করতেন। কবি হিসেবে জাভেদের অভিজ্ঞতার জগৎ অনেকটাই ব্যক্তিগত। কিন্তু তাঁরা দুজনই চমৎকার। সাজ্জাদ: তাঁরা দুজনই কবি এবং ছবির জন্য গান লিখেছেন। ছবির গানে পরিচালকের নিজস্ব চাহিদা থাকে। মুম্বাইয়ে কবি ও গীতিকারদের এক সেমিনারে বিরাট এক তর্ক দেখেছি। আগে নাকি ছবির চাহিদা মিটিয়েও কবিদের লেখা গানের স্বকীয় আবেদন থাকত। পেশাদার গীতিকারদের লেখা নাকি ইদানীং একেবারেই পানসে। ভেতর থেকে আপনি বিষয়টা কীভাবে দেখছেন? শাবানা: আজকাল ছবির জন্য যেসব গান লেখা হচ্ছে, সেগুলোকে আদৌ লিরিক বলা যায় কি না, তা নিয়েই আমার প্রশ্ন আছে। গানের মেলোডিও ফিকে হয়ে এসেছে। হট্টগোলও এখন সংগীত। এসব গানের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে শাহির লুধিয়ানভি, মাজরুহ সুলতানপুরী, কাইফি আজমি, জান নিসার আখতার, শৈলেন্দ্র কেসরিলাল বা আনন্দ বকশির গান তো মহান। গানের ভাষা তখন ছিল উদুর্। ছবি হিন্দি হলেও গান লেখা হতো উদুর্তে। উদুর্ ভাষার ঐশ্বর্যময় সাহিত্যিক উত্তরাধিকার গানগুলোকে অপূর্ব করে তুলত। সেসব দিন এখন গেছে। সাজ্জাদ: কবির মতো আপনাদের পরিবারে দুজন চিত্রপরিচালকও আছেনজয়া আখতার আর ফারহান আখতার। তাঁদের ছবি নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন? শাবানা: না দেখে থাকা কি আমার পক্ষে সম্ভব? সাজ্জাদ: পরিচালক হিসেবে তাঁদের দুজনকে আপনি কীভাবে তুলনা করবেন? শাবানা: আমি মনে করি, জয়া মূলত একজন লেখক। ব্যাপারটা ওর রক্তের মধ্যে আছে। মানুষ, তার জটিলতা, মনের নানা স্তর ও আলোছায়াএসব ব্যাপারে ওর জানাবোঝাটা বেশ। সে খুবই মেধাবী। তবে আমি দেখতে পাই যে ফারহান আর জয়া দুজনের মধ্যে একই সংবেদনশীলতার উত্তরাধিকার আছে। ওদের জন্য আমি খুবই গর্ব বোধ করি। আমার গর্ব হয় এই কারণে যে ওরা এমন ধরনের ব্যবসাসফল ছবি বানাচ্ছে, যার মধ্যে সংবেদনশীলতা আছে। সাজ্জাদ: আবার আপনার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। অভিনয় থেকে পরবর্তী জীবনে আপনি সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হলেন। এই তাড়না আপনার মধ্যে কোত্থেকে এল? এর পেছনে কি আপনার কৈশোরের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যাকর্ষণ কাজ করেছে? শাবানা: এর পেছনে সব কৃতিত্ব আমার বাবার। জানেন, তরুণ বয়সে কিন্তু আমি মোটেই কোনো পত্রপত্রিকা পড়তাম না। ছবির মধ্যেই আমি ডুবে ছিলাম। সামাজিক সচেতনতা বলতে কিচ্ছু ছিল না। কিন্তু আমাকে তিনি কখনো কোনো চাপ দেননি। কখনো বলেননি, আমার মেয়ে হয়ে তুমি খবরের কাগজ না পড়ে কীভাবে থাকতে পারো? তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন, মাটি এত উর্বরা যে চারা উঠবে এবং তার শেকড় গজাবে। অঙ্কুর ফুটবেই। সেটাই ঘটেছে। সাজ্জাদ: মধ্য সত্তর থেকে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত যেসব ছবিতে আপনি অভিনয় করলেন, সেগুলোরও কি কোনো ভূমিকা ছিল? সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং মানুষের অধিকারের পক্ষে সেসব ছবি খুবই সোচ্চার ছিল। শাবানা: অভিনেতা বা যেকোনো শিল্পীর জীবনে নয়টা-পাঁচটা কাজের বাইরে তাকানোর আহ্বান নিয়ে একটা নিয়তি-নির্ধারক মুহূর্ত আসে। আপনি বলতে পারেন না যে সামাজিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লড়াকু একটি চরিত্রে অভিনয় করে সন্ধ্যা ছয়টায় নিজের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে গিয়ে আমি স্রেফ আরাম করব। যে চরিত্রে সারা দিন অভিনয় করে এলাম, সেটির সঙ্গে আমার আর কোনো লেনদেন নেই। আপনি যদি সংবেদনশীল শিল্পী হন, তাহলে তার কিছু অবশেষ আপনার ভেতরে থেকে যেতে বাধ্য। কারণ, তার উৎস তো আমাদের চারপাশের সজীব জীবন। কলকাতার কাছে নৈহাটিতে আমরা গৌতম ঘোষের পার ছবির শুটিং করছিলাম। একটা গেস্ট হাউসে উঠেছি। এক ধাঙর তরুণী ছিল সেখানে। ছবিতে আমার চরিত্রটা করতে গিয়ে সে-ই ছিল আমার মডেল। চরিত্রটা বোঝার জন্য আমি আমার চরিত্রের সমতুল্য অন্যান্য নারী আর তাদের জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করছিলামতারা কী খায়, কী বলে ইত্যাদি ইত্যাদি। ধাঙরদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। শুটিংয়ের সময় আমার মডেল মেয়েটি বলল, আমাদের বাড়িতে একদিন বেড়াতে আসবেন? আমি বললাম, নিশ্চয়ই আসব। ওখানে বেড়াতে গিয়ে দারিদ্র্যের যে চেহারা দেখতে পেলাম, জীবনেও সে জিনিস আমি দেখিনি। একরত্তি একটা ঘর। আটজন মানুষ তাতে বসবাস করে। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই। একেবারে গুমোট। আমি ভেবে অবাক হয়ে গেলাম, এ রকম অমানবিক অবস্থায় থেকেও মেয়েটি কীভাবে এতটা স্নিগ্ধ থাকতে পারছে। সে হাসে, আনন্দ করেখুবই সুখী একজন মানুষ। আমাকে সে একেবারে হতবাক করে ফেলল। আমি ভাবলাম, তার মতো মানুষদের জন্য কিছু না করে যদি আমি মুম্বাই ফিরে যাই, তার মানে দাঁড়াবে মেয়েটিকে আমি স্রেফ ব্যবহার করেছি। তাকে আমি ব্যবহার করেছি পুরস্কারের জন্য বা ব্যক্তিগত স্বার্থে। যে আস্থায় সে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে, সেটা হবে তার প্রতি প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা। তখন আমি নিভারা হক নামে একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ওরা মুম্বাইয়ের বস্তিবাসীর অধিকার নিয়ে কাজ করে। আমরা ৫০ হাজার বস্তিবাসীর জন্য ঘর তৈরি করে দিয়েছি। সাজ্জাদ: এটা কি পার ছবিটির পর পরই, নাকি আরও পরে? শাবানা: না, না, পরে। কিন্তু এর শুরু হয়েছিল পার ছবিটি দিয়ে। এ ছবির মধ্য দিয়ে বিষয়টির সঙ্গে আমি যুক্ত হলাম। তারপর ধরুন মহেশ ভাটের আর্থ ছবিটির কথা। ওই ছবি মুক্তি পাওয়ার পর নারীরা আমার কাছে আসতে শুরু করল, ফোন করতে লাগল। সে যোগাযোগ তারকার সঙ্গে ভক্তের নয়, একটি নারীসংহতির জায়গা থেকে। এমন একটি প্রত্যাশা থেকে যে সবার বৈবাহিক সমস্যা আমি মিটিয়ে দিতে পারব। আমি তো স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। ভাই রে, আমি তো নেহাত একজন অভিনয়শিল্পী। আমি নিজেই বুঝতে পারিনি যে এমন একটা ঘটনা আমার মধ্য দিয়ে ঘটে গেছে। আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম। আমার এই উপলব্ধি হলো যে একটি চরিত্র রূপায়ণকে ছাপিয়েও পালন করার মতো একটি ভূমিকা অভিনয়শিল্পীর আছে। কারণ, তাঁরা যে চরিত্রটি করেন, অনেকে ভুল করে তাঁদের সেই চরিত্রটি বলেই বিশ্বাস করে নেয়। এটিই ছিল আমার নারী আন্দোলনে জড়িত হওয়ার পেছনের কারণ। আমি এখন মিজওয়াঁ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামের একটি বেসরকারি সংস্থা চালাচ্ছি। আজমগড়ের কাছে ছোট্ট একটা গ্রাম মিজওয়াঁ। এই গ্রামে আমার বাবার জন্ম হয়েছিল। সময় যেন সেখানে স্থবির হয়ে ছিল। সংস্থাটি শুরু করেছিলেন আমার বাবা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের উন্নয়ন পেতে হলে সেটা শুরু করতে হবে গ্রাম থেকে। কারণ, আমার দেশের ৮০ শতাংশ লোকের বসবাস সেখানে। আর লক্ষ্যটা স্থির করতে হবে মেয়েশিশুদের উন্নতির দিকে। সাজ্জাদ: আপনার কর্মকাণ্ডও মূলত বৈষম্য আর নারী ইস্যুগুলোকে ঘিরে। এসব সামাজিক বিষয় আর সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নিয়ে ভারতের বাইরে এই অঞ্চলে আপনি বহুদিন ধরে আনাগোনা করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক হিসেবে এই অঞ্চল সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কী? শাবানা: আমি চাই এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে উত্তম সম্পর্ক স্থাপিত হোক। এই উপমহাদেশের নানা জায়গার মধ্যে মিলের পরিমাণ এত বেশি। আমাদের শক্তির জায়গাগুলো যেমন এক, দুর্বলতার জায়গাগুলোও। কোনো সমস্যা থাকলে রাজনৈতিকভাবে সেসবের সুরাহা করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা আমাদের শক্তির ক্ষেত্রগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করতে পারলে এ অঞ্চলটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত করা সম্ভব। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সুস্থ সম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে যোগ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্রের তো কোনো ভৌগোলিক সীমানা নেই। আমি যখন বাংলাদেশে আসি, এখানকার মেয়েরা এমনভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে, যেন আমি তাদের কোনো বোন। এই আন্তরিকতার উৎস তো চলচ্চিত্র, তাই না? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মানুষের যে ভালোবাসা আমি পাই, সেটা একেবারে তুলনাহীন। আমি নিজেকে এই অঞ্চলের মেয়ে বলেই গণ্য করি। সাজ্জাদ: অনেক দিন ধরেই আপনি নিয়মিত বাংলাদেশে আসছেন। বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হলো? এখানকার কোন পরিবর্তনগুলো আপনার চোখে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে? শাবানা: একটা কথা হলো, উনিশ, বিশ বা একুশ শতকে ব্যাপক পরিবর্তনের পরও যে স্ববিরোধগুলো এ অঞ্চলের মানুষের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, তার উৎস এই দেশগুলোর অবিচ্ছিন্ন ইতিহাসের ধারা। বাংলাদেশ তো অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছে, বিশেষভাবে স্বাস্থ্য খাতে, আরও স্পষ্ট করে বললে মেয়েদের ক্ষেত্রে। মানুষেরও তো এখন শুধু নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হয়ে সরকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলে না। তারও সমান সক্রিয়তা জরুরি। বাংলাদেশে যেটা দারুণভাবে চোখে পড়ে, সেটা হলো সমাজে বিপুল মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এটা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর একটা লক্ষণ। সাজ্জাদ: এটা তো গেল সমাজের একটা দিক। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, পৃথিবীর পাশাপাশি এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও প্রতিক্রিয়াশীল উগ্রপন্থার উত্থান ঘটছে। এই পরিস্থিতি কি এ অঞ্চলের দেশগুলোর বন্ধন আরও শিথিল বা বলতে পারি আরও সংঘাতময় করে তুলবে না? এ অঞ্চলের কোনো সামষ্টিক সাধারণ উন্নয়ন কি নিকট ভবিষ্যতে আপনি দেখতে পাচ্ছেন? শাবানা: এটা তো হতে হবে। আমাদের সেটা সম্ভবপর করে তুলতেই হবে। উগ্রপন্থার এই উত্থান আমাদের সবার জন্যই এক প্রবল দুশ্চিন্তার কারণ। তাই বলে আমরা তো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। প্রতিটা সময়েই কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেটা আমাদের মোকাবিলাও করতে হবে। আমাদের সংকট যদি আমরাই মোকাবিলা না করি, তাহলে আর কে করবে? এ কথা তো আমরা বলতে পারি না যে যা ঘটছে ঘটুক, আমরা আমাদের মতো থাকি। ঘটনার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ চাপানোর চেষ্টা করতে হবে। গতকাল আমি ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কারের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই ছেলেটি যা করল, সেটা শুধু বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের নয়, পুরো পৃথিবীর জন্য একটি আশাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সে বাংলাদেশেরই সন্তান, কোনো বিদেশি নয়। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী এক তরুণ। জঙ্গিদের খপ্পর থেকে সে চলে আসতে পারত, কিন্তু সে তা করেনি। ওর জায়গায় থাকলে আমার সন্দেহ আছে আমি সেটা করতে পারতাম কি না। ফারাজ সেটা করল বন্ধুত্বের কারণে, মানবতার কারণে। তার আত্মত্যাগ যে উদ্যাপন করা হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য সেটা একটা প্রত্যাশা জাগাচ্ছে। মৌলবাদ সমাজকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে চায়। বিভিন্ন দেশের মৌলবাদীরা পরস্পর পরস্পরের শ্রেষ্ঠ বন্ধুসে তারা সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যে মৌলবাদীই হোক না কেন। ওরা একে অপরের প্রতিবিম্ব। এমন কথা আমরা বলতে পারি না যে এ ওর চেয়ে কম খারাপ। তাই সব রকমের মৌলবাদকেই কঠোরভাবে পরাস্ত করতে হবে। সাজ্জাদ: আপনি বড় একটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। ভালোবাসাও পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের। পেছনের দিকে তাকিয়ে অভিনেত্রী বা সামাজিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আপনার উপলব্ধি কী? শাবানা: আমার মনে হয়, আমি বিরাট ভাগ্যবতী। আমি সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিলাম। সাজ্জাদ: আপনি বিনয়ের অবতার হওয়ার চেষ্টা করছেন। শাবানা: না, না। একদম সত্যি কথা, ভাগ্য আমার অসম্ভব পক্ষে ছিল। এ কথা ভাবতে আমি খুবই অপছন্দ করি যে আমার সবকিছু পাওয়া শেষ। নিরজা নামে একটা ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম। ছবিটা ২৩ বছর বয়সী এক বিমানবালার আত্মত্যাগের কাহিনি। আমি মেয়েটির মায়ের চরিত্র করেছি। সম্প্রতি ছবিটার জন্য আমি পুরস্কার পেয়েছি। পুরস্কার পেয়ে ভালোও লেগেছে। তবে আমি আশা করি, সামনে আরও কিছু অপেক্ষা করছে। আমার বিশ্বাস, সবচেয়ে ভালোটা এখনো আমার হাতে আসেনি। হিন্দি ছবিতে এখন খুব ভালো একটা সময় যাচ্ছে। ১০ বছর আগেও অবস্থা এমন ছিল যে তোমার বয়স ৩০ বছর হয়ে গেছে তো তোমার ক্যারিয়ার শেষ। এখন বয়সী অভিনয়শিল্পীদের কথা মাথায় রেখে চরিত্র লেখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে অমিতাভ বচ্চন, ঋষি কাপুর আর আমি বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেলাম। লোকে বলছে, বাহ্, এতটা বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও তো এঁরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পাচ্ছেন। দারুণ একটা ব্যাপার। সাজ্জাদ : আমরা সাক্ষাৎকারের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আপনি তো এ জীবনে অনেক প্রশ্নেরই মুখোমুখি হয়েছেন। এমন কোনো প্রশ্ন কি আছে, আপনি সব সময় যার উত্তর দিতে চেয়েছেন, কিন্তু কখনো কেউ আপনাকে প্রশ্নটি করেনি? শাবানা: যে ব্যাপারটা আমার গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে, সেটা হলো পুরুষতন্ত্র। আমরা অনেক সময় অনুভবও করি না যে কীভাবে এটা আমাদের গভীরে ঘাপটি মেরে আছে। ছেলেরা কেবল ছেলে হওয়ার কারণেই জন্মের পর থেকে কতগুলো সুবিধা পেয়ে আসছে। মেয়েরাও সেভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছে শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্র পর্যন্ত কোনোখানেই মেয়েরা সমান সুযোগ পাচ্ছে না। এটা এমন সূক্ষ্মভাবে কাজ করে যে মেয়েরাও সেভাবে ভাবতে আরম্ভ করে। কেবল গ্রামে নয়, শহরেও। আপনি যদি প্রশ্ন করেন, স্বামী কি আপনাকে পেটায়? উত্তর আসে, মাঝেসাঝে। এর মানে, তারা ধরেই নিয়েছে যে স্বামীর মনমেজাজ খারাপ থাকলে একবার-দুবার এ রকম হতে পারে। কিন্তু এটা মেনে নেওয়ার বিন্দুমাত্র কোনো জায়গা থাকতে পারে না। আমি মনে করি, এর কারণ হলো সমস্ত সমস্যার পরেও বিয়ে টিকিয়ে রাখার পক্ষে একটা শক্তিশালী সামাজিক মতাদর্শ। কোনো মেয়ে যদি বাবা-মায়ের বাড়িতে এসে বলে, আমার স্বামী আমাকে পিটিয়েছে। বাবা-মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেবে, ও, তার নিশ্চয়ই মেজাজ খারাপ ছিল। তুমি তোমার সংসারে ফিরে যাও। একবার মেরেছে তো কী হয়েছে? কিন্তু এটা মেনে নেওয়া উচিত নয়। আপনার মেয়েকে শেখাতে হবে, যেন সে কোনোভাবেই গৃহনির্যাতন মেনে না নেয়। বাবা-মায়েদের মানসিকতা বদলাতে হবে। পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্তি আমাদের পেতেই হবে। পুরুষতন্ত্র উচ্ছেদ করার জন্য পৌরুষের সংজ্ঞা আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে নানা দিক থেকে। শুধু মেয়েরাই এটা করবে না। নারী-পুরুষকে মিলেমিশেই করতে হবে। ছেলেদের প্রশ্ন করতে হবে, সিক্স প্যাক অ্যাবস বা শারীরিক বলের সঙ্গে পৌরুষের ধারণা কেন একাকার হয়ে যায়? পৌরুষের ধারণার মধ্যে সংবেদনশীলতা, কমনীয়তা বা সমতার ধারণা কেন থাকবে না? আমাদের ছেলে ফারহান আখতার মর্দ (MARD) বা মেল অ্যাগেইনস্ট রেপ অ্যান্ড ডিসক্রিমিনেশন নামে একটা সংগঠন চালায়। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে গান গেয়ে, কথা বলে বিষয়গুলো সে ছাত্রছাত্রীদের কাছে ব্যাখ্যা করে। সমান অংশীদার হয়ে নারী-পুরুষ যখন একসঙ্গে এগিয়ে যাবে, তখনই আমরা সুস্থ একটা সমাজ পাব। পুরুষতন্ত্র আমাদের যে মন-মানসিকতা দিয়েছে, তার পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই এর সূচনা ঘটাতে হবে।



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2rQk3np
June 26, 2017 at 03:25AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top