বিশেষ প্রতিবেদন :: গত বছরের ১ জুলাই শুক্রবার রাতে রাজধানীর গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশকে ওলট-পালট করে দেওয়া জঙ্গী হামলার ঘটনাটি ঘটে। রাত পৌনে নয়টার দিকে ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসী রেস্তোরাঁয় অতর্কিত হামলা চালিয়ে ২০ জন বিদেশি নাগরিকসহ ৩০-৩৫ জন লোকজনকে জিম্মি করে রাখে। এরপর থেকে পুরো চার কিলোমিটার এলাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে রাখে।
পরদিন শনিবার সকালে রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। বিদেশি নাগরিকসহ মোট ১৩ জনকে জীবিত এবং মোট ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম এবং বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন নিহত হন। এ ঘটনায় বাংলাদশে দুই দিনের শোক ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নিহত ২০ জনের মধ্যে দুইজন বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, নয়জন ইতালি, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয়। দুই বাংলাদেশি হলেন- ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ হোসেন, ডেএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ইশরাত আখন্দ। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় তরুণী তারুশি জেইন। জাপানিদের নাম পাওয়া যায়নি।
এছাড়া নিহত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান অবিন্তা কবির। তিনি এলিগ্যান্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান রুবা আহম্মেদের একমাত্র মেয়ে। অবিন্তা কবির ২০১৬ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশে আসেন। নিহত ইতালি নয় নাগরিক হলেন- আদেলে পুগলিসি, মারকো তোন্দা, ক্লদিয়া মারিয়া ডি’আন্তোনা, নাদিয়া বেনেদেত্তি, ভিনসেঞ্জো ডি’আলেস্ত্রো, মারিয়া রিভোলি, ক্রিস্তিয়ান রসি, ক্লদিয়া কাপেলি এবং সিমোনা মন্তি।
পরে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এই ধরনের অতর্কিত হামলা চালিয়ে মানুষজনকে জিম্মি করার ঘটনা বাংলাদেশে সেটিই ছিল প্রথম।
২০১৪ সালের জুন মাসে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ এবং ‘ও কিচেন রেস্তোরাঁ’। ভবনটির ওপরের তলায় ছিল বেকারির রান্নাঘর এবং মালামাল রাখার ঘর। আর নিচতলায় বেকারির বিক্রয়কেন্দ্র, রেস্তোরাঁর রান্নাঘর এবং রেস্তোরাঁর অতিথিদের বসার জায়গা। অতিথিদের সংখ্যা বেশি হলে দোতলায়ও বসার ব্যবস্থা করা হতো। লেকপাড়ের সবুজ লনযুক্ত এই বেকারি ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই প্রিয়।
সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকত হলি আর্টিজান। শুক্র ও শনিবার সকাল ৮টায় খুলত আর বন্ধ হতো রাত ১০টায়। ওই দুই দিন এখানে সকালের নাশতার ব্যবস্থা থাকত। বাকি পাঁচ দিন খোলা থাকত সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। অন্তত ৫০-৬০ জন অতিথি থাকতেন নিয়মিত। রেস্তোরাঁয় আসা অথিতিদের ৮০ শতাংশই ছিলেন বিদেশি নাগরিক ।
বেকারিতে ইতালিয়ান বিভিন্ন ধরনের কেক ও রুটিজাতীয় খাবার আর রেস্তোরাঁয় মূলত স্প্যানিশ খাবার বানানো হতো। এ ছাড়া অতিথিদের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল স্যামন মাছ, কোরাল মাছ, স্প্যানিশ খাবার পায়লা, কালামার ও গামবাস। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, পিৎজাও খেতেন অনেকে। আর ছিল ১০-১৫ ধরনের সালাদ।
গত বছরের ১ জুলাই রাতে জঙ্গি হামলা ও পরদিন যৌথ বাহিনীর কমান্ডো অভিযানে তছনছ হয়ে যায় ভবনটি। ভবনটির সীমানা দেয়াল ও বেকারির বেশিরভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নষ্ট হয় ভেতরে থাকা মালামালও। এর পর প্রায় সাড়ে চার মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকে হলি আর্টিজান প্রাঙ্গণ। গত বছরের ১৩ নভেম্বর পুলিশ মালিককে এর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়।
তবে মালিকপক্ষ জানায়, ভবনটিতে তারা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করবে না। বর্তমানে বাড়িটির দেখাশোনার দায়িত্বে দুজন মালিসহ পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। দোতলা ওই ভবনটিতে এখন চলছে মেরামতের কাজ। ফটকে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, কারও ঢোকার অনুমতি নাই। ছবিও তোলা যাবে না। আর মেরামতের কাজ শেষ হলে উঠবেন মালিক সামিরা আহম্মদ ও তার স্বামী সাদাত মেহেদী।
এদিকে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে একের পর এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের অভিযানে বহু জঙ্গি মারা গেছে, আটকও হয়েছেন কয়েকজন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘শিগগিরই গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার নির্ভুল ও নিখুঁত অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে।’
২৮ জুন বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, হামলায় বন্ধু প্রতিম বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক শাহাদাত বরণ করায় খুব সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে নির্ভুল চার্জশিট দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই জন্য অভিযোগপত্র দিতে একটু সময় নিয়েছি। কোনো ত্রুটি ছাড়া অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং খুব শিগগির অভিযোগপত্র দিতে পারব।
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার এক বছর হতে যাচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সেই দিনটি আমাদের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আমরা বুঝতে শিখেছিলাম, এই জঙ্গিরা কী চায়, কী তাদের উদ্দেশ্য, কারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, কারা অর্থায়ন করেছে। সবই খুব সূক্ষ্মভাবে দেখেছি।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2tulmfn
July 01, 2017 at 12:30AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন