ঢাকা, ১৯ জুলাই- বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে টেলিভিশন নাটকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়ে যান আসাদুজ্জামান নূর। শুধু হুমায়ূনের চরিত্রগুলোর অভিনেতাই নন, লেখকের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন তিনি। আজ হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন এই অভিনেতা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহীদ রেজা নূর। প্রশ্ন : আপনি হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর আমাকে বলেছিলেন, হুমায়ূনের সঙ্গে বন্ধুত্ব একটা জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু একটা পর্যায়ের পর তিনি একটি দেয়াল তুলে দিতেন। সে জায়গাটা ওঁর একার। আপনি আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন? আসাদুজ্জামান নূর : ব্যাপারটা সেভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব না। আমরা কিছু বন্ধুবান্ধব ছিলাম, সব বিষয়েই কথা বলতামপ্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে, কিছুই বাদ থাকত না। কিন্তু হুমায়ূন কখনো কখনো সবকিছু বলত না। হয়তো তার অনেক কাজ বন্ধুরা মেনে নিচ্ছি না। কিন্তু সে প্রসঙ্গটির ওপর একটা দেয়াল তুলে দিত। আমরা তুলতে চাইলে হয় সে উঠে পড়ত, নয়তো আমাদের ঘর থেকে বের করে দিত। সে জন্য আমার মনে হয়েছে, প্রকৃত বন্ধুবৎসল হলেও কোথাও না কোথাও একটা আড়াল রাখত সে। আমি সেটা অতিক্রম করতে পারিনি, অন্যরাও পেরেছে বলে মনে হয় না। স্ত্রী বা প্রেমিকার কথা বলতে পারব না। প্রশ্ন : হুমায়ূন আহমেদের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলুন, যা আপনার জন্য ছিল অস্বস্তিকর। আসাদুজ্জামান নূর : হুট করে রেগে যেত হুমায়ূন। সে রাগ ছিল দানবীয়। আমাদের সঙ্গে এমনটা কমই হতো। অন্য অনেকের সঙ্গেই হতো। আমার তখন ভয়ই লাগত, হুমায়ূন নিজেই না অসুস্থ হয়ে যায়। মজার ব্যাপার, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সে রাগ পড়ে যেত। মনে হতো যেন কিছুই হয়নি। যার সঙ্গে হলো, তার সঙ্গেই খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। প্রশ্ন : আগুনের পরশমণির একটা ঘটনার কথায় আসি। একটা রাগারাগির ব্যাপার নাকি ছিল সেখানে? আসাদুজ্জামান নূর : হ্যাঁ, একেবারেই শেষের দিকে। কিছু শট মনঃপূত হয়নি। আবার নেওয়া হবে। সম্ভবত উত্তরার কোথাও শুটিং হচ্ছিল। আমাকে কল দিয়েছিল, সময়মতো গেছি। কিন্তু ছয় ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও ডাক পড়ল না। আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছি। হুমায়ূন বলেছিল, এসে একটা শট দিয়ে চলে গেলেই হবে। আমি বেশ রেগে বলেছিলাম, এভাবে তো কাজ করা যায় না। হুমায়ূনও আমার ওপর রেগে বলল, আপনার কাজ থাকলে আপনি যান। আমি চলে এসেছি। এরপর রাত প্রায় একটা-দেড়টার দিকে আমার বাড়ির কলবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি বন্ধুবান্ধবসহ হুমায়ূন, হাতে একটা ফুলের তোড়া। ওই রাত্তিরে আমার স্ত্রী আবার রান্নাবান্না করল। খাওয়াদাওয়া করতে করতে ভোর। প্রশ্ন : টেলিভিশনে বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেই আপনি দারুণ রকম জনপ্রিয় হয়েছিলেন। আপনাকে নাকি নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। আপনি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। চরিত্রটি নিয়ে আপনি কতটা পরিতৃপ্ত? আসাদুজ্জামান নূর : হ্যাঁ, আমাকে বলা হয়েছিল, তোমার তো সফট ফেস। স্ক্রিনে আসো ভালো মানুষের চেহারা নিয়ে। গুন্ডাপান্ডার রোলে তুমি ফেল করবা। আমি ভাবলাম, মুনার প্রেমিক হিসেবে আমি যেভাবে উঠি, বসি, চলি, সেভাবে করলেই হয়ে যাবে। আমাকে কোনো চেষ্টা বা পরিশ্রম করতে হবে না। কিন্তু বাকের ভাই চরিত্রটি যদি করি, তাহলে ভেবেচিন্তে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। নাটক লেখার পর কাজ শুরু করতে সময় লাগে না। ভেবেছিলাম চুলটা আরেকটু লম্বা করব, একটা ঝুঁটি বাঁধব। পরে সানগ্লাসে চোখ ঢেকে, গলায় চেইন, হাতে ব্রেসলেট পরে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলাম। প্রশ্ন : হাওয়ামে উড়তা যায়ে তো বাকের ভাইয়ের ব্র্যান্ড সংগীত হয়ে গিয়েছিল... আসাদুজ্জামান নূর : একবার নওগাঁয় গেছি, জলিল ভাইয়ের (আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক) অনুষ্ঠানে। খেয়েদেয়ে গাড়িতে উঠেছি, তখন একটি বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে আমার হাতে একটা ক্যাসেট দিয়ে বলল, এটা আপনি শুনতে শুনতে যাবেন। ভাবলাম, নিজের করা গানটান দিয়েছে বুঝি। গাড়িতে উঠে ছাড়লাম, দেখি হাওয়া মে উড়তা যায়ে। হাহ হাহ হা! প্রশ্ন : আপনি একবার বলেছিলেন, এর আগে এভাবে কেউ নাটক লেখেনি। নাটকের কাঠামো, সংলাপ, গল্প একদম মানুষের মনের কথা বলে যে দেখলে মনে হয়, এটা আমার গল্প, সেই রকম করে তিনি নাটক লিখতেন। আসাদুজ্জামান নূর : হুমায়ূনের আগে যাঁরা নাটক লিখেছেন, সেগুলোয় সংলাপ ছিল মেলোড্রামাটিক, কাব্যিক। ঠিক ওই ভাষায় আমরা ওইভাবে কথা বলি না। হুমায়ূন জায়গাটা পাল্টে দিল। ছোট ছোট সহজ সংলাপ। তার মধ্যে ছিল নাটক। যতই মুখের কথাকে সংলাপে নিয়ে আসি, নাটকে নাটকীয়তা না থাকলে তো হবে না। সেটা এক শ ভাগ থাকত হুমায়ূনের নাটকে। সেসবের ভেতরেই প্রেম, হিউমার, বেদনা। দৃশ্যগুলো খুব বড় হতো না, বাক্যগুলোও খুব বড় হতো না, কিন্তু সব মিলিয়ে একটা চমৎকার নাটকীয়তা তৈরি হতো। ওগুলো কিন্তু কমেডি নাটক ছিল না। সংলাপগুলোই ছিল রসে ভরা। প্রশ্ন : নুহাশপল্লীর সঙ্গে আপনার অনেক স্মৃতি। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর কি কখনো গেছেন সেখানে? আসাদুজ্জামান নূর : না। নুহাশপল্লীতে আর যাওয়া হয়নি। যেতে ইচ্ছে করে না। বন্ধুরা কখনো কখনো ভেবেছিলাম যাব, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। হুমায়ূন মারা যাওয়ার আগে নিউইয়র্কে তিন দিন ওর পাশে ছিলাম। ফিরে আসার সময় আবার লন্ডন থেকে ফোন করেছিলাম, অন্যপ্রকাশের মাজহার বলেছে, এখন সে কিছুটা ভালো। কিন্তু তারপর...ওর লাশ যখন দেশে এল, আমি ছিলাম না। ভালোই হয়েছে। সে সময় যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা খুবই বেদনাদায়ক। দেশে থাকলে আমাকেও কোনো না কোনোভাবে তার সঙ্গে যুক্ত হতে হতো। আর/১০:১৪/১৯ জুলাই



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2uJ3Llf
July 20, 2017 at 05:20AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top