আগরতলা, ২২ জুলাই- উপজাতিভিত্তিক রাজনৈতিক দল আইপিএফটির ডাকা ১০ দিনের অবরোধে প্রায় অচল ছিল ত্রিপুরা। আলাদা রাজ্য তুইপ্রাল্যান্ডের দাবিতে ত্রিপুরার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান সড়ক ও রেলপথ বন্ধ করে দেয় তারা। হাঁসফাঁস অবস্থা হয় ত্রিপুরাবাসীর। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সকালে উঠেছে অবরোধ। তাতে আপাতত স্বস্তি মিলেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়েছে কি? সমস্যার গোড়া খুঁজতে হলে যেতে হবে অনেকটা পেছনে। ভারতের অংশ হওয়ার আগে ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরার নাম ছিল তুইপাড়া। মূলত টিপরা উপজাতিদেরই আবাসস্থল ছিল এটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তুইপাড়ার জীবনযাত্রায় বদল আসে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ঢুকে পড়ে এ অঞ্চলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা অংশ ছিল বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠী। তাদের বেশির ভাগই ছিল অভিবাসী। এসব জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা ছিল আলাদা আলাদা। একসঙ্গে থাকতে গিয়ে বিভিন্ন সময় জাতিগত সংঘাত ও সহিংসতা শুরু হয় ত্রিপুরায়। শেষ রাজা মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর দেববর্মার মৃত্যুর পর ত্রিপুরা ভারতের অংশ হয়। রাজ্য হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার আগে এটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ছিল। তবে স্বায়ত্তশাসিত উপজাতি জেলা কাউন্সিল হওয়ার পর জাতিগত সহিংসতা কিছুটা কমে আসে। ত্রিপুরাবাসীর এই শান্তি ও স্বস্তি বেশি দিন টেকেনি। উপজাতিভিত্তিক রাজনৈতিক দল দ্য ইনডিজিনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি) তুইপ্রাল্যান্ড নামে আলাদা রাজ্যের দাবিতে কঠোর অবস্থানে যায়। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা এনসি দেববর্মা। তাঁর যুক্তি, ত্রিপুরায় উপজাতিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। আইপিএফটির ত্রিপুরা থেকে আলাদা হওয়ার দাবি জোরদার হয় অন্ধ্র প্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানা আলাদা হওয়ার সম্মতি পাওয়ার পর। আগরতলায় বড় ধরনের সমাবেশ করে আইপিএফটি। দাবি টিকিয়ে রাখতে প্রতিবছরই তুইপ্রাল্যান্ড রাজ্য দাবি দিবস পালন শুরু করে আইপিএফটি। আট বছর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই দিবসটি পালিত হয়। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এই দিবসে বের করা আইপিএফটির মিছিলে উপজাতি এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ হয়। এরপর আইপিএফটির তুইপ্রাল্যান্ড দাবির আন্দোলন আরও জোরদার হয়। গত বছর ভারতের চার লেনবিশিষ্ট জাতীয় মহাসড়ক এনএইচ ৮ ও রেলপথ অবরোধ করে আইপিএফটি। ১০ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এবারের অবরোধেও একই কৌশল নেয় তারা। এমনকি উলঙ্গ হয়ে প্রতিবাদও করা হয় এবারের অবরোধ ও আন্দোলনে। উপজাতিভিত্তিক হলেও রাজনৈতিকভাবে আইপিএফটি অনেকটাই কোণঠাসা। ২০০৯ সালের লোকসভা এবং ২০১৩ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে কোনো আসন জিততে পারেনি তারা। দেয়ালে পিঠ ঠেকা আইপিএফটির দাবি একটাই। তারা চায় ত্রিপুরা থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাজ্য তুইপ্রাল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে। তারা মনে করছে, রাজ্যে উপজাতিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। যদিও এ আন্দোলনে উপজাতি সব সংগঠনকে সঙ্গে পায়নি আইপিএফটি। এমনকি কিছু কিছু উপজাতি দল তুইপ্রাল্যান্ডবিরোধী আন্দোলনও করেছে। তাই তাদের আলাদা রাজ্যের দাবির পেছনের কারণ কতটা রাজনৈতিক ও কতটা জাতিভিত্তিক, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। ত্রিপুরার রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে এ অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মাত্র সাত মাস পরই ত্রিপুরায় বিধানসভা ভোট। ৬০ সদস্যের ত্রিপুরা বিধানসভার ২০টি আসনই উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। ফলে সরকার গঠনে উপজাতি আসনের গুরুত্ব অনেক। এই ২০টি আসনের মধ্যে ১৯টিই সিপিএমের দখলে। একটি কংগ্রেসের। তাই জিততে হলে উপজাতিদের মন জয় করতেই হবে আইপিএফটিকে। সে ক্ষেত্রে তুইপ্রাল্যান্ড আন্দোলনকে তুরুপের তাস করতে চাওয়াটা আইপিএফটির পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য সব মিলে ত্রিপুরা বিধানসভার ৬০ আসনের মধ্যে সিপিএম জোটের দখলে আছে ৫১টি। বাকি ৯টি বিরোধী দলের। এর মধ্যে কংগ্রেসের আসন ৭টি। ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকারের অভিযোগ, তুইপ্রাল্যান্ডের দাবিতে এ আন্দোলন অগণতান্ত্রিক। ১০ দিনের অবরোধ সত্ত্বেও কোনোভাবেই এই দাবি মেনে নেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। বামফ্রন্ট মনে করে, আইপিএফটির আন্দোলনকে ঘিরে সুযোগ নিতে চায় ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এরও সত্যতা রয়েছে। গত ১০ দিনে আইপিএফটির অবরোধ তুলে নিতে ত্রিপুরা সরকারকে চাপে ফেলতে বিজেপি একপর্যায়ে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সরকারি আবাসন ঘেরাও করে। কংগ্রেসও কম যায় না। রাজ্য সরকারের ভূমিকার প্রশ্ন তুলে তারাও ১২ ঘণ্টার হরতাল ডাকে। ১০ দিনের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত অনেকটা চাপের মুখেই তুলে নিতে বাধ্য হয় আইপিএফটি। অবরোধ চলাকালে রাজ্য সরকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করলেও সুফল মেলেনি। পরে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন ও ১৪৪ ধারা জারি হয়। তবে আইপিএফটির কর্ণধার নরেন্দ্র দেববর্মা দ্বিপক্ষীয় বৈঠককে সাফল্য হিসেবে দেখছেন। দাবি করেছেন, নিজের ইচ্ছাতেই তুলে নিয়েছেন অবরোধ। এ আলোচনায় নরেন্দ্র দেববর্মা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতেই পারেন। অথবা আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অভিনয়ও করতে পারেন। তবে এত দিন ধরে আইপিএফটির এগিয়ে চলার পথনির্দেশ করে তুইপ্রাল্যান্ডকে ঘিরে ত্রিপুরায় যে অস্থিতিশীলতা, তা সহজে কাটার নয়। আইপিএফটি এই আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। তাদের রাজনৈতিক চালে পাল্টা চাল দিচ্ছে বিজেপি ও কংগ্রেস। কমিউনিস্ট সরকারও কঠোর অবস্থানে। ত্রিপুরাবাসীকে এসবের জের যে আরও টেনে যেতে হবে, সব মিলে এটা অনেকটা স্পষ্ট। আর/১০:১৪/২২ জুলাই



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2uLNjje
July 23, 2017 at 05:06AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top