ফরহাদ মজহারকে মারধর করে অপহরণকারীরা

Captureঢাকা::লেখক ও কলামিষ্ট ফরহাদ মজহার জানিয়েছেন, মাইক্রোবাসে তুলেই তাকে মারধর করে অপহরণকারীরা।

উদ্ধারের পর গত মঙ্গলবার পুলিশের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার একথা জানান।

খুলনা থেকে ঢাকায় আসার পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে তাকে প্রায় দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায়, যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন, পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

গতকাল বুধবার যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন বলেন, ফরহাদ মজহার যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ফরহাদ মজহার গত মঙ্গলবার পুলিশ ও আদালতের কাছে জবানবন্দি দিলেও এ ঘটনা নিয়ে এখনো গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলেননি। তিনি বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে তার কক্ষে স্বজন ও বন্ধুদের যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার সাদাপোশাকের লোকজন সেখানে পাহারা বসিয়েছেন।

ফরহাদ মজহারের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্ত্রী ফরিদা আখতার গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। এখন তিনি আগের চেয়ে একটু ভালো আছেন। বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা ভালো।

ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘ফরহাদ মজহার কীভাবে গেলেন, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। আশা করি দু-এক দিনের মধ্যে বেরিয়ে আসবে কী হয়েছিল। অনেকে অনেক রকম কথা বলছেন। কিন্তু তদন্তের পরই সেসব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তিনি বাসা থেকে একা বের হয়েছিলেন, নাকি কেউ তাকে ডেকে নিয়েছে, সেটিই মূল তদন্তের বিষয়।’

সোমবার ভোরে ফরহাদ মজহার শ্যামলীর বাসা থেকে ওষুধ কিনতে বের হয়ে অপহরণকারীদের কবলে পড়েন। এ ঘটনায় তার পরিবার আদাবর থানায় অপহরণ মামলা করে।

সোমবার ভোরে ফরহাদ মহজারকে কি কেউ ফোনে ডেকে নিয়েছিল, নাকি তিনি নিজেই বের হন, আবার অত সকালে তিনি কেন বের হলেন-এসব প্রশ্নের জবাব মিলেছে পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে।

জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, সোমবার ফজরের আজানের পরপর চোখের ওষুধ কিনতে ও হাঁটাহাঁটি করতে তিনি শ্যামলীর ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের ফার্মেসির দিকে যাচ্ছিলেন। হাসপাতাল পার হয়ে গোল্ডেন স্ট্রিটের গলির কাছাকাছি পৌঁছামাত্র পেছন থেকে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস তার পাশে থামে এবং তিনজন লোক নেমে তাকে ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোবাসে তোলে।

অপহরণের পর ফরহাদ মজহার কী করে তার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন? পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘দুই পাশ থেকে দুজন এসে আমার পাশের সিটে বসে। তারা দরজা বন্ধ করেই আমাকে চড়-থাপ্পড় মারে ও গালিগালাজ করতে থাকে এবং বলে, “তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস”। শ্যামলী মোড় থেকে বাম দিকে মোড় নেওয়ার পর এক ফাঁকে আমার পকেটে থাকা মোবাইল ফোন নিয়ে আমার স্ত্রীকে ফোন করে বলি, ওরা বোধ হয় আমাকে মেরে ফেলবে—এই কথা ফিসফিস করে বলি। সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোন কেড়ে নেয় এবং চোখ বেঁধে ফেলে।’

মুক্তিপণ সম্পর্কে পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, অপহরণকারীরা প্রথমে এক-দুই কোটি টাকা দাবি করলেও পরে এক দিনের মধ্যেই ৩৫ লাখ টাকা দিতে বলে। অপহরণকারীরা তার কানে ফোন ধরিয়ে দিলে তিনি তার স্ত্রীকে টাকার বিষয়টি জানান। এরপর অপহরণকারীরা ফোন কেড়ে নেয়।

জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমি কৌশলে বারবার ফোন ব্যবহার করতে চেয়েছি, যাতে সহজেই আমাকে শনাক্ত করা যায়। আমার চোখ বাঁধা থাকায় কোন দিকে গাড়ি যাচ্ছে বুঝতে পারিনি।’

ফরহাদ মজহার পুলিশকে বলেন, ‘মাইক্রোবাসটি খুলনায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোথাও থামেনি। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তারা খুলনায় আমাকে নামিয়ে দেয়। নামানোর সময় তারা বলে, “আমরা আশেপাশে আছি, সোজা ঢাকা চলে যাবি।” তারা ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি টিকিট ধরিয়ে দেয়। তারা আরও বলে, “কাউকে কিছু বলবি না।”’ অপহরণকারীরা টাকার জন্য বেশি চাপ দিচ্ছিল না বলেও তিনি জবানবন্দিতে জানিয়েছেন।

ভোরে ওষুধ কিনতে ফরহাদ মজহার কেন ব্যাগ নিয়ে বের হলেন-পুলিশ কর্মকর্তার এমন প্রশ্নের জবাব তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমার সঙ্গে থাকা ব্যাগটি সব সময় আমার সঙ্গেই ছিল। তারা (অপহরণকারীরা) ব্যাগে হাত দেয়নি। আমার ব্যাগে যা ছিল তা অটুট ছিল। খুলনায় নামার পর খাবারের দোকান থেকে রিকশায় করে হানিফ কাউন্টারে চলে আসি। আমার ফোনটি ব্যাগেই ছিল, ফোন বের করে দেখি চার্জ নেই। আমি কাউন্টারে ব্যাগ থেকে চার্জার বের করে চার্জ দিই।’

বাসে উঠে কাউকে ফোন না করার কারণ সম্পর্কে ফরহাদ মজহার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি বাসে শুয়ে পড়ি। কোনো হুঁশ ছিল না, ফোন করার মতো কোনো এনার্জি ছিল না।’

ফরহাদ মজহারের পরিবারের সদস্যরা জানান, তিনি সব সময় ব্যাগ সঙ্গে রাখেন। তিনি মানিব্যাগ বা অন্য কিছু ব্যবহার করেন না। তার প্রতিদিনের টাকাপয়সা বা খুচরা জিনিসপত্র ব্যাগেই থাকে।

পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দির পর মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ফরহাদ মজহার। আদালতের জবানবন্দিতেও অপহরণ ও ছাড়া পাওয়া সম্পর্কে তিনি প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেন। আদালতের জবানবন্দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে উদ্ধার হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বাস চলতে শুরু করে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। একসময় আমি চোখ খুলে দেখি, আমার সামনে তিন-চারজন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে একজন জানতে চায়, আমি ফরহাদ মজহার কি না। আমি উত্তরে হ্যাঁ বলি। তারা আমাকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে এলে আমি র‍্যাব ও পুলিশের অনেক লোক দেখতে পাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আমাকে অভয়নগর থানায় নিয়ে যায়।’

ফরহাদ মজহারকে বহনকারী হানিফ পরিবহনের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে খুলনা থেকে ছেড়ে আসে সোমবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে। যশোর-খুলনা মহাসড়ক দিয়ে অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় বাসটি পৌঁছায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে।

নওয়াপাড়া বাজার অতিক্রম করে বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলসের সামনে এলে বাসটি থামানো হয়। অভয়নগর থানার পুলিশ বাসটির সুপারভাইজার হাফিজুর রহমানকে ফোন করে বাসটি থামাতে বলেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ ফরহাদ মজহারকে বাস থেকে নামিয়ে আনে। এরপর পুলিশ ফরহাদ মজহারকে ঢাকায় নিয়ে যায়।

আদালতের জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ‘যারা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আমি তাদের চিনি না। তারা আমাকে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই ছেড়ে দেয়। আমার কাছে সবচেয়ে যেটি বেশি মনে হচ্ছে সেটি হলো যারা বর্তমান সরকারকে পছন্দ করে না, তারা সরকারকে দেশের মধ্যে ও বিশ্বদরবারে বিব্রত করানোর জন্য আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।’

ফরহাদ মজহারের পারিবারিক সূত্র জানায়, উদ্ধারের পর ফরহাদ মজহারকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তিনি ভালো করে কথাও বলতে পারছিলেন না। তারপরই পুলিশ তাকে ঢাকায় আদালতে জবানবন্দির জন্য পাঠায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা যেকোনো ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার। এ দেশে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ না দিয়েই অনেক সময় আইন এবং মামলার প্রক্রিয়া অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। রিমান্ড চলার সময়ে আইনজীবী বা অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয় না। আইনজীবীর সঙ্গে ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরামর্শ করতে দিতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। কিন্তু পুলিশ ক্রমাগতভাবে সাংবিধানিক অধিকার ও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করছে। ফরহাদ মজহারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবীর মতে, ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর কারও সঙ্গে পরামর্শ করতে না দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি।



from ঢাকা – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2tT0teF

July 06, 2017 at 06:27AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top