যেখানে পড়েছে পা, পায়ের ছায়া; বুঝি ঘন সবুজে ঢেকে গেছে সব। রূপালি আকাশের সবুজ সূর্যের নাম নায়করাজ রাজ্জাক। সুদীর্ঘ পথযাত্রার এ লগ্নে এখনও উজ্জ্বল, স্বতন্ত্র এবং অনন্য তিনি। তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন সোমেশ্বর অলিমঙ্গলবার দুপুর। গুলশানের পথঘাট অনেকটা গাড়িশূন্য। হরতাল থাকায় হেঁটে বা রিকশায় চলেছেন অনেকে। আমাদের গন্তব্য গুলশান-২ এর লক্ষ্মীকুঞ্জ। সেখানে অপেক্ষায় আছেন জীবন্ত এক কিংবদন্তি। আজকের কথামালা তাকে নিয়েই। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নতুন এক সূর্য ওঠে বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে। অচিরেই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই সূর্যের দ্যুতি। ষাটের দশকের বাকি বছরগুলো এবং সত্তরের দশকেও তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তিনি আবদুর রাজ্জাক। নায়করাজ রাজ্জাক নামেই সুপরিচিত তিনি। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নাকতলায় জন্মগ্রহণ করেন রাজ্জাক। কলকাতার খানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় সরস্বতী পূজা চলাকালে শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই রাজ্জাকের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। অপেক্ষার এক পর্যায়ে লক্ষ্মীকুঞ্জের বৈঠকঘরের বারান্দায় এলেন রাজ্জাক। বাইরে তখন রোদের দাপট, বাতাসও আছে। টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরেছিলেন নায়করাজ। চশমা ঠিক করে কথা বলতে শুরু করলেন। দেশীয় আলোচিত ঘটনা প্রাসঙ্গিক হয়ে এলো। আমাদের আলাপ শুরু হলো। আমি শিল্পী মানুষ। দেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হয়। আবার ভাবি, এ নিয়ে কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট লোকজন আছেন। তারা নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল তাদের কাজে। তবে সত্যি বলতে কিশিল্পী ও রাজনীতিবিদের কাজ প্রায় একই। দুজনই মানুষের জন্য কাজ করেন। আমি সাধারণ মানুষের অন্তরে ঠাঁই পেয়েছি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। কথায় কথায় জানা গেল, ১৯৫৯ সালে বোম্বের ফিল্ম ইনস্টিটিউট ফিল্মালয়ে ভর্তি হন রাজ্জাক। এর পর কলকাতার পংকতিলক এবং শিলালিপি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন রাজ্জাক। এ সময় কমলাপুরে থাকতেন তিনি। স্ত্রীর সঙ্গে তার সংসার জীবন ৫৩ বছরের। এর মধ্যে রাজ্জাকের উত্থানের সব ধাপ দেখেছেন প্রিয়তমা স্ত্রী। স্বামীকে আকাশচুম্বী উচ্চতায় নিয়ে যেতে করণীয় সবই করেছেন এ নারী। রাজ্জাক স্মৃতিচারণে ফিরে গেলেনআমি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এফডিসিতেই ঘরবাড়ি। সময় বের করতে পারি না। এত ব্যস্ততার পরও আমি শুক্রবার কাজ রাখতাম না। স্ত্রী ও সন্তানদের কথা ভেবে এটুকু ছাড় দিতাম। যদিও এটা পর্যাপ্ত ছিল না। আমার স্ত্রী তবু কিছু বলত না। সে আমাকে কাজের জন্য উৎসর্গ করেছে। আমার দৃষ্টিতে শি ইজ অ্যা গ্রেট ওমেন এভার আই সিন। সে সময়ে রাজ্জাককে নিয়ে নানা রকম গসিপ হতো। স্ত্রী এসবের কিছুই কানে তুলতেন না। রাজ্জাক বললেন, আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধ অনেক বেশি। ও কখনও আমার শুটিং দেখতে যেত না। কোনো পার্টি বা মহরতেও না। মাঝেমধ্যে ঘরোয়া আয়োজনের কোনো দাওয়াতে আমার সঙ্গী হতো। ওর বক্তব্যতুমি হিরো। সবখানে তোমার সাথে আমাকে যেতে হবে কেন? এটা ভালো দেখায় না। রাজ্জাক ঢাকায় এসে যোগাযোগ করেন ঢাকার প্রথম ছবি মুখ ও মুখোশ-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে। তিনি রাজ্জাককে ওই সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ইকবাল ফিল্মসে চাকরি নিয়ে দেন। পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারীর কাজ পেলেন তিনি। সহকারী পরিচালক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি উজালা। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন, আখেরী স্টেশন ও ডাক বাবু ছবিতে তিনটি ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক। একদিন হঠাৎ সুযোগ পান নায়ক হওয়ার। জহির রায়হান রাজ্জাককে বেহুলা চলচ্চিত্রের নায়ক বানিয়ে দেন। বেহুলার নামভূমিকায় অভিনয় করেন সুচন্দা। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় বেহুলা। রাজ্জাক বললেন, তখন আমরা কয়েকজন জহির রায়হানের সঙ্গেই থাকতাম। আমরা তার আদর্শের অনুসারী ছিলাম। চলচ্চিত্রের জন্য আপনার ত্যাগের কথা সবারই জানা। কতদূর এগোলো আমাদের চলচ্চিত্র? এমন প্রশ্নের পর নায়করাজকে একটু চিন্তিত মনে হলো। এর মধ্যে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে পরে কথা হবে জানিয়ে দিয়ে তিনি জবাব দিলেন। বললেন, ৯০-এর দশক পর্যন্ত একটা ভালো মানদণ্ডে ছিল আমাদের ছবি। তখন এক বা দেড় লাখ টাকা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হতো। এখন বাজেট বাড়লেও ছবির মান কমে গেছে। আমরা কয়েকজন শিল্পী দিনরাত কাজ করেছি। এখন খুব খারাপ লাগে। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ এখন আসলেই আর নাই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়ও বলে দিলেন তিনি। রাজ্জাকের মতে, এখন সরকারি উদ্যোগে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সরকার আন্তরিক হলে, এখানে সুনজর দিলে খারাপ চিত্রটার বদল ঘটতে পারে। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখায় গতকাল (১৪ মার্চ ২০১৩) সরকারিভাবে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হলো সবুজ নায়ক রাজ্জাককে। এর আগেও বিভিন্ন সংগঠন তাকে সম্মানিত করেছে। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পেয়ে তিনি খুুব আপ্লুত। রাজ্জাক বললেন, সরকার ও দেশের মানুষ সঠিক সময়ে আমাকে মূল্যায়ন করেছে। কাজের স্বীকৃতি পেয়ে আমি গর্বিত, আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ। অভিনয়ের পাশাপাশি নায়করাজ রাজ্জাক ১৯৭৩ সালে রংবাজ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। গড়ে তোলেন প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন। অনেক ছবি প্রযোজনা করেন তিনি। এ পর্যন্ত পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র। তার সর্বশেষ পরিচালিত ছবি আয়না কাহিনী এখন মুক্তির অপেক্ষায়। তার মতে, দেশের এই অবস্থায় ছবিটি মুক্তি দেওয়া ঠিক হবে না। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মুক্তি পাবে আয়না কাহিনী। এদিকে চলচ্চিত্র, নাটক ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজ্জাক নিয়মিত হলেও কলকাতার ছবির ব্যাপারে তিনি এখন অনাগ্রহী। তিনি বললেন, সন্তানরা এই বয়সে একা দেশের বাইরে যেতে দিতে চায় না। আমিও তাদের কথা দিয়েছি। যে কারণে কলকাতার চলচ্চিত্রে আর কাজ করার সুযোগ নেই। তাছাড়া ওদের গল্পগুলোও এখন আমাকে আগের মতো টানছে না। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ঘরোয়া নামে ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়েই তিনি অর্জন করেন নায়করাজ রাজ্জাক খেতাব। উপাধিটি তাকে দিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরী [খোকা]। কয়েক দিন আগে পরপারে চলে গেছেন খোকা। রাজ্জাক বললেন, এমন চলচ্চিত্র সাংবাদিক আর পাব না। আমার জীবনের সেরা সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন খোকা। চিত্রালীতে প্রকাশ পেয়েছিল। খোকা তার লেখায় আমার কঠোর সমালোচনা করতেন। একই সঙ্গে আমার সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। এ পর্যন্ত মোট সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে তার স্মরণে এলোকি যে করি [১৯৭৬], অশিক্ষিত [১৯৭৮], বড় ভাল লোক ছিল [১৯৮২], চন্দ্রনাথ [১৯৮৪], যোগাযোগ [১৯৮৮] ছবিগুলোর নাম। স্ত্রী, সন্তান ও নাতি-নাতনি নিয়ে সুখী মানুষ রাজ্জাক। তেমন কোনো অপ্রাপ্তি নেই তার জীবনে। সন্তানদের কাছে আদর্শ পিতা হয়ে তিনি এখন একান্নবর্তী একটা পরিবারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একইভাবে বিশাল চলচ্চিত্রাঙ্গনের অভিভাবকও তিনি। দুটি সংসারই সামলে চলেছেন রাজ্জাক। সংসার মানেই হাজারো সমস্যা। এত কিছুর মধ্য দিয়েও জীবন এগিয়ে চলে। ব্যক্তিগত সংসারে অভাব-অনটন না থাকলেও রাজ্জাক অন্য সংসারটি নিয়ে চিন্তিত। তাই এখনও দিনরাত খেটে যাচ্ছেন চলচ্চিত্র-সংসারের জন্য। একজন আদর্শ অভিভাবক যেমন তার পরিবারের হারিয়ে যাওয়া জৌলুসের জন্য আফসোস করেন, রাজ্জাকও তার ব্যতিক্রম নন। সংসারে সুদিন আনতে এখনও ক্লান্তিহীনভাবে খেটে যাচ্ছেন মানুষটি। জীবন্ত কিংবদন্তি বুঝি এভাবেই হতে হয়. এমএ/ ০৯:৩২/ ২১ আগস্ট
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2wx7HG0
August 22, 2017 at 03:33AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন