বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাক্ষী সিলেটের রসময় মেমোরিয়েল স্কুল

সুমন দে:: সিলেট নগরীতে এখন যেটা রসময় স্কুল সেটা আগে ছিল প্যারী মোহন নামে একজন দানশীল ভদ্রলোকের বসত বাড়ী। এই স্কুল গড়ে তোলার পেছনে একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছিল। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তখন আমাদের দেশে স্বদেশী ও খাদী আন্দোলন চলছিল। যারা সরকারী স্কুলে পড়াশুনা করতেন তাদের জন্যে অভিভাবকদের দুঃচিন্তা ছিল, কারণ তখন প্রাইভেট কোন স্কুল ছিল না। সরকারী স্কুলে পড়তে হলে অভিভাবকদের বন্ড দিতে হতো। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সন্তানরা অংশগ্রহণ করবে না এই মর্মে বন্ড দিতে হতো; এটা অপমানজনক বিধায় আমাদের অভিভাবকরা একটি প্রাইভেট স্কুল গড়ে তুলতে এগিয়ে আসেন। ১৯৩০ সালে ইংরেজ শাসক বিরোধী সমগ্র উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচলাবস্থা বিরাজ করে।

ফলশ্রুতিতে এহেন অবস্থায় তদানীন্তন আসামের জনশিক্ষা পরিচালক (D.P.T) ক্যানিংহাম এক বিজ্ঞপ্তি মাধ্যমে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সন্তানরা অংশগ্রহণ করবে না এই মর্মে বন্ড দিতে হবে অভিভাবকের প্রথা প্রচলন করেন। প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন বেসরকারি বৃত্তিতে নিয়েজিত অভিবাবকরা। বন্ড দিতে অস্বীকার করে স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তৎকালীণ সিলেটের সমাজ সেবীসহ আইনপেশায় নিযুক্তগণ ভীষণভাবে বিচলিত হন। তাঁরা দুর্গাকুমার পাঠশালায় ‘পপুলার একাডেমী’ (Peoples Academy) নামে প্রাতঃকালীণ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র ৬ মাস সিলেট নগরির দাড়িয়া পাড়াবাসী আইনজীবী প্যারী মোহন দাস মহাশয় তাঁর বসত বাড়ী ও তদসংলগ্ন এলাকা এ স্কুল করার অভিপ্রায় প্রকাশে তাঁর বাড়ীতে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত হয়। এরপর থেকেই প্যারী মোহন পাবলিক একাডেমী গড়ে ওঠে। এই স্কুল গড়ে তোলার জন্যে বীরেন্দ্র সোমসহ অনেকেই নাটক করে অর্থ যোগান দেন। বলতে গেলে এটাই প্রথম নাটকের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালন শুরু হয় সিলেটে। এখানে বলে রাখা ভালো, সিলেটে স্কুল যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এই স্কুলটির ছিল, ‘পপুলার একাডেমী’ পরবর্তিতে প্যায়ারীবাবু জমি ও ঘর দান করায় তার নামেই স্কুলটির নাম ছিল। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম রসময় মেমোরিয়েল হাই স্কুল।”

তদানীন্তন বিখ্যাত আইনজীবী বাবু যতীন্দ্র মোহন দেব চৌধুরী (এমএবিএল) নব প্রতিষ্ঠিত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে এ বিদ্যালয় খেকে সর্ব প্রথম কলকাতা বিদ্যালয়ের অধীনে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পেয়ে স্কুলের ছাত্ররা সরাসরি পরীক্ষা দেয়। প্যারী মোহন দাসের মৃত্যুর পর জানা যায়, তিনি এক সময় তার বসতবাড়ী সিলেট টাউন ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে কিছু টাকা নিয়েছিলেন, ব্যাংক তা নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা নিলে তদানীন্তন আসামের আইন সভার সদস্য বাবু হরেন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর ক্রয় করেন ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে। তাঁর পিতা রসময় বাবুর নামে উৎসর্গ করেন। উক্ত বিদ্যালয়ের নাম রসময় মেমোরিয়েল উচ্চ বিদ্যালয় নামে পুনঃ নামকরণ করা হয়। হরেন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর নিকট আত্মীয় রায় বাহাদুর ধর্মদাস দত্ত মহাশয়ের প্রচেষ্টায় স্কুলের সম্মুখস্থ ২/৩ টি বাড়ী ও পুকুর ক্রয় করা হয়, যার ফলে বর্তমানে স্কুলের বিরাট এলাকার (০.৮৬৩৪) অধিকারী।

আসামের প্রাক্তন মন্ত্রী মরহুম মৌলানা আব্দুর রশীদ সুদীর্ঘ ১৬ বছর স্কুলের শিক্ষকতা করেন। সেই সময়ে স্কুলের যাবতীয় অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। মন্ত্রীত্ব লাভের পর নানা জাতীয় সরকারি অনুদান দ্বারা স্কুলটির ভিত্তি এমনভাবে সুদৃঢ় করেন যে, দেশ বিভাগ পরবর্তী কালের অনেক উত্থান-পতনের মধ্যেও স্বীয় অস্তিত্ব সগৌরবে বহাল রাখতে সমর্থ হয়। স্কুলে সহশিক্ষা প্রচলিত। স্কুলটি বাংলাদেশ শিক্ষা অধিদপ্তরে এমপিওভূক্ত হয় ১৯৮৪ সালে। ২০১৫ সালে ভারতের দিল্লি হতে স্বর্গীয় হরেন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর মেয়ে এবং স্বর্গীয় রসময় বাবুর নাতনি নাড়ীর টানে সিলেটে এসেছিলেন এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। তথ্যসূত্রঃ রসময় মেমোরিয়েল উচ্চ বিদ্যালয়, বিদ্যালয়ের বাৎসরিক ম্যাগাজিন, শ্রী বীরেন্দ্র চন্দ্রসোম এর লেখা বর্ণালী ম্যাগাজিন, ডা. বনদ্বিপ দাশ, নাট্যকার গৌতম চক্রবর্তী।



from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2vK8Q93

August 30, 2017 at 10:53PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top