ঢাকা, ০৭ আগস্ট- ঢাকাই ছবির অমর নায়ক সালমান শাহ। তার স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে অভাবনীয় সাফল্য যেমন গল্প হয়ে আছে ইন্ডাস্ট্রিতে, তেমনি তার অকাল মৃত্যুও রহস্যের মিথ হয়ে আছে। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নিজের বাসভবনের শোবার ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় সালমানের মৃতদেহ। ঘটনাটি আত্মহত্যা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ অপমৃত্যু র মামলা করলে তাতে আপত্তি জানায় পরিবার। এরপর সালমানের স্ত্রী সামিরা হক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যরবসায়ী আজিজ মোহাম্মাদ ভাইসহ ১১ জনকে সালমান শাহের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে হত্যা মামলা দায়ের করে সালমানের পরিবার। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- সামিরার মা লতিফা হক লুসি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম। এই খুন ও মামলা নিয়ে গেল একুশটি বছর ধরেই জিইয়ে আছে রহস্য। এখনো নিশ্চিত হওয়া গেল না সত্যি সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি তাকে খুন করা হয়েছিলো। এরইমধ্যে সম্প্রতি ফেসবুকে এক ভিডিও প্রকাশ করে সালমানের মৃত্যুর রহস্যের নতুন মোড় সৃষ্টি করে দিলেন আমেরিকা প্রবাসী নারী রাবেয়া সুলতানা রুবি। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি। তাকে খুন করা হয়েছিলো। সেই খুনের সঙ্গে জড়িত সালমানের স্ত্রী ও তার বাড়ির লোকজন। খুনের সঙ্গে আরও জড়িত রুবির ছোট ভাই ও তার স্বামী। ভিডিও বার্তায় রুবি অনুরোধ করেন সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরীকে, তিনি যেন সালমান খুনের মামলাটি পুনরায় তদন্তের ব্যবস্থা করেন। রুবি নিজে এই খুনের সাক্ষী দেবেন। এরইমধ্যে এই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে অনলাইনে। সালমান ভক্তরা নিজেদের ওয়ালে ভিডিওটি শেয়ার করে সালমানের মৃৃত্যুর আসল রহস্য উদঘাটন করতে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করছেন। পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে ভিডিও প্রকাশকারী রাবেয়া সুলতানা রুবির নাম। সবাই জানতে চাইছেন কে এই রুবি? কেন এতদিন পর তিনি এভাবে মুখ খুলতে বাধ্য হলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই রুবি সালমান খুনের মামলার ৭ নম্বর আসামী। রাবেয়া সুলতানা ওরফে রুবি থাকতেন সালমানের ফ্ল্যাটের অর্থাৎ ইস্কাটন প্লাজার উত্তর পাশের বিল্ডিংয়ে। তিনি রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রশিদের মেয়ে। প্রয়াত স্বামী ক্যাপ্টেন জামিল ছিলেন তার বর। জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর যে ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয় তার স্বামী ছিলেন তাদের একজন। বর্তমানে এক চাইনিজের সঙ্গে সংসার করছেন। ক্যাপ্টেন জামিলের সংসারে জন্ম নেয়া পুত্র ভিকিকে নিয়ে ৩১ বছর আগে তিনি এই চাইনিজকে বিয়ে করেন। সালমানের মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর পর তিনি আমেরিকায় পাড়ি দেন। সেখানেই স্বামী-সন্তান নিয়ে বাস করছেন তিনি। ঢাকায় তিনি মে-ফেরার নামক বিউটি পার্লারের স্বত্তাধিকারী ছিলেন। রুবিকে নিয়ে বিতর্ক বহু আগে থেকেই। তিনি ছিলেন সালমানের মায়ের কাছের বান্ধবী। তবে সবকিছুতেই নাক গলানো স্বভাবের এই মহীলাকে পছন্দ করতেন না সালমান। একবার স্ত্রী সামিরার সঙ্গে ঝগড়ার সময় সেখানে গিয়েও নাক গলান রুবি। পরে ক্ষুব্দ হয়ে তাকে আর কখনো বাসায় না আসতে নির্দেশ দেন সালমান শাহ। এই অপমান তিনি হজম করতে পারেননি। এই সূত্র ধরে সালমানের মা নীলা চৌধুরীর সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ে রুবির। চলতে থাকে মন কষাকষি। সালমানের মায়ের অভিযোগ, এর কথা ওর কানে, ওর কথা এর কানে লাগিয়েছন রুবি। উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে মানুষজনকে বিভ্রান্ত করাতে তার খ্যাতি আছে। এ কাজে তিনি বরাবরই সিদ্ধহস্ত। তার ইচ্ছে ছিল আমেরিকা পড়ুয়া ছোট ভাইর জন্যে সামিরাকে স্ত্রী করে ঘরে তুলবেন। সেই স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে হয়ে গেলো সালমান-সামিরার বিয়েতে। সুপন রায়ের সাংবাদিক ও সালমান শাহর অজানা কথা বইতে উল্লেখ আছে- সুষ্পষ্ট অভিযোগ আছে, সালমান-সামিরার দাস্পত্য কলহের পশ্চাতে রাবেয়া সুলতানা রুবির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। সালমানকে তিনি দেখে নেবেন, এরকম কথাওবলেছেন অনেকের কাছে। যাদুশিল্পী আজরা জ্যাবিনের কাছে এই রুবি বলেছিলেন, সালমানের সব টাকা তার মা নিয়ে যাচ্ছে সামিরার কি হবে? এবং এ অভিযোগটি করেছেন সালমানের মা নীলা চৌধুরী। তার ভাষ্য, আমার ছেলের টাকা আমি নিলাম না তার বাবা নিল- এসব নিয়ে রুবির মাথা ব্যথা কেন? রুবি কে, যে আমার সংসার জীবনে হস্তক্ষেপ করবে? সালমানের মৃত্যু দিন ছিল প্রশ্ন সাপেক্ষ। তার ভূমিকা নিয়েও পত্রপত্রিকাসহ নীলা চৌধুরী অভিযোগ করেছেন। সালমানের মৃতদেহ একপাশ রেখে রুবি-সামিরা বসে গল্প করার অভিযোগও সুস্পষ্টভাবে কথিত আছে। এই প্রশ্নগুলো যখন লোকমুখে ঠিক তখনই এ প্রতিবেদকের সাথে সরাসরি দেখা করতে আসেন রুবি। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে একে একে উত্তর দেন সব প্রশ্নের, খন্ডান যুক্তি। অথচ ও আগে বারদুয়েক তার পার্লারে দেখা করতে গেলে বলা হয়, তিনি পার্লারে নেই, বাইরে আছেন। রুবি বলেন, ইমনের (সালমান শাহ) আত্মহত্যার খবর শুনে সাথে আমার ছেলে ভিকি, পার্লারের মেয়েরা। ফ্ল্যাটে ঢোকার মুহুতেই দেখলাম- ধরাধরি করে ইমনকে বের করে আনা হচ্ছে। আমি ভাবলাম, স্লিপিং পিল খেয়েছে, ষ্টমাক ওয়াশের জন্যে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। ভিতরে ঢুকে দেখি ডাইনিং টেবিল-কিচেনের মাঝামাঝি মেঝেতে সামিরা বসা। কাঁদছে। আমাকে দেখেই ও দৌড়ে এলো। ওকে সান্ত্বনা দেয়ার সময় ৮১ সালের ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর ভেতরে তোলপাড় করা অবস্থা। টের পেলাম সুইটি ভাবী, ইয়াসমিন তখনো দাঁড়িয়ে। একটু পরেই ইমনের মা (নীলা চৌধুরী) এসে বললো, দরজা বন্ধ কর, কাউকে ঢুকতে দেবে না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি সামিরাকে বলে উঠবেন, সামিরা কাইন্দো না, তুমিই ইমনকে মেরেছ। তখন সামিরা হিষ্টিরিয়া রোগীর মতো বলে উঠলো, আমি কেমন করে আপনার ছেলেকে মারলাম। তখনো হীরা ভাইকে (সামিরার বাবা) জানানো হয়নি ইমনের খবর। সুইটি ভাবীর বাসায় গিয়ে ফোনে চট্টগ্রামে হীরা ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। কিছুক্ষণ পরে ফ্ল্যাটের ম্যানেজার ডাক্তার নিয়ে এসেন। ডাক্তার কিছু না বলেই চলে গেলেন। আমি স্লাভো ক্লিনিক গিয়ে জিজ্জেস করাতে তিনি বললেন, সালমান মৃত। আমি উল্লেটা প্রশ্ন করলাম, আপনি নিশ্চিত? ডাক্তার সম্মতি জানাতেই, ভালো হলো না, বলে চলে এলাম। সাথে আমার ছেলে ভিকি। এসেই সামিরা, সালমান মহসীন (সুইটি ভাবির বর) ভাইকে জানালাম ইমন মারা গেছে। কিছুক্ষণ পর ফ্ল্যাট থেকে ফোন করলাম এক উর্ধবতন পুলিশ কর্মকর্তাকে। বললাম পুরো ঘটনা। ও অবস্থায় সামিরাকে নেবো প্রশ্ন করাতেই তিনি বললেন, আপনি ভুলেও এ কাজ করবেন না। জড়িত হয়ে পড়বেন। সামিরা তখন আমাকে বললো, ইমন একটা চিঠি লিখে গেছে। আমি বললাম, কোথায় সেটা? সামিরা বললো, আবুলের হাতে। আমি তখন তাকে বললাম, তুমি কি একটা বুদ্ধু মেয়ে? তুমি জানো এ চিঠির মূল্য কতো? এরপর ১/বি-র রুমির আব্বা এসে সামিরাকে ওনার ফ্ল্যাটের নিয়ে যান। আমি আমার বাসায় চলে যাই। আমি বুঝতে পারছি না আমাকে কেন ইমনের আত্মহত্যার সাথে জড়ানো হচ্ছে। গত অক্টোবর ৯৫ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সামিরার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ফ্ল্যাটের দারোয়ানই তার প্রমাণ। সুপন রায় তার বইতে উল্লেখ করেছেন, রুবির দেয়া ব্যাখ্যাই যে সর্বাংশে সত্যি তারও যথাযথ প্রমাণ নেই। তথাকথিত আত্মহত্যার পর রশি কেটে নামানোর পর সালমানের গায়ে তেল মালিশ করার সময় রুবি যে উপস্থিত ছিলেন সেটা সামিরা নিজেই বলেছেন। পত্রিকার পাতা ওল্টালেই তার প্রমাণ মিলবে। রুবি বলেছেন, সালমানকে ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পরেই তিনি ফ্ল্যাট ঢোকেন। অথচ নীলা চৌধুরী তাকে ফ্ল্যাটে ঢুকেই দেখতে পান। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা, কাজটা ভালো হলো না বলা, উর্ধবতন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে অতি উৎসাহী আলাপনে রুবির স্ববিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে, বুদ্ধিমতি হলেও তিনি তা বুঝে উঠতে পারেননি। সালমানের লিখে যাওয়া চিঠি আবিস্কারের সাথে তার নাটকীয় সম্পর্ক তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ফ্ল্যাটে তিনি এক বছর ধরে যান না এবং ফ্ল্যাটের রেজিষ্ট্রার বই তার প্রমাণ বলে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতেও অসত্য লুকিয়ে আছে। ইস্কাটন প্লাজায় ঢুকতে যে তার সই করতে হয় না কিংবা রিসেপশন থেকে ইন্টারকমের মাধ্যমে সম্মতি নিতে হয় না এ কথা ফ্ল্যাটের সবাই জানে। ফ্ল্যাটের কর্মচারীদের কাছে তথাকথিত আন্টি নামে পরিচিত ছিলেন এই রুবি। রাবেয়া সুলতানা রুবি ওসামা বিন লাদেনের মতো গর্তে থেকে সালমান শাহ ও তার পরিবারকে নিয়ে নানা ধরনের মিথ্যা কথা বলে বিভিন্ন সময় নানা ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফেসবুকে সালমান শাহর মৃত্যু নিয়ে নানা মিথ্যা কথাও প্রচার করছেন। সালমানের মা নীলা চৌধুরীকে কটাক্ষ করে অনেক কথা বলেছেন। সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন এমন কথা খুব জোর দিয়েই তিনি বলে যাচ্ছেন। অথচ সালমান শাহ হত্যা মামলা এখনো পিবিআই পুনঃতদন্ত করছেন! সালমানের স্ত্রী সামিরার সঙ্গেও রুবির নিয়মিত যোগাযোগ আছে বলে দাবি সালমানের মা নীলা চৌধুরীর। কিন্তু নানা ভিডিও বার্তায় এই দাবিকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন রুবি। তবে নতুন ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন রাবেয়া সুলতানা রুবি। তার ভিডিও থেকে প্রাপ্ত তথ্য সালমান খুনে নতুন মোড় আনবে বলে প্রত্যাশা চলচ্চিত্রের মানুষ ও সালমান ভক্তেদের। তাছাড়া সবসময় সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে দাবি করা এই নারী কেন হঠাৎ করেই এটিকে খুন বলে দাবি করলেন সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। রুবিকে বাংলাদেশে এনে তার সাক্ষ গ্রহণ করে সঠিক ব্যবস্থা নিতে সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছে সবাই। সেইসঙ্গে ভিডিও বার্তায় রুবি নিজের ও তার পুত্র ভিকির জীবন হানির আশংকার কথাও বলেছেন। সেদিক বিবেচনা করে রুবিকে নিরাপদে দেশে নিয়ে আসতে বাংলাদেশ সরকারকে মনযোগী হওয়ারও অনুরোধ করছেন সবাই।



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2vwLFDa
August 08, 2017 at 12:47AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top