বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট এ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এ সিনেমা পরিচালনা করেন আব্দুল জব্বার খান। ঐতিহাসিকভাবেও বহুল আলোচিত এ সিনেমাটি আজ ৬১ বছর পার করছে। এই মুখ ও মুখোশের পথ ধরেই এগিয়ে যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প। আজও বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে ধ্রুবতারার মতো জলজল করছে মুখ ও মুখোশ। এই চলচ্চিত্রের জন্য সর্ব প্রথম যার অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্রে স্মরণ করতে হবে তিনি আবদুল জব্বার খান, মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের পরিচালক। ১৯৫৩ সালে এই চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তানে নিজস্ব কোন চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠেনি। স্থানীয় সিনেমা হলগুলোতে কলকাতা অথবা লাহোরের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজক এফ. দোসানির পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্যে ক্ষুদ্ধ হয়ে জব্বার খান চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হন। তারপর জব্বার খান দুই বছরে এই সিনেমা নির্মাণের কাজ শেষ করেন। মুখ ও মুখোশ নির্মানের জন্য গল্প হিসেবে আবদুল জব্বার খান ডাকাত নাটকের পান্ডুলিপি এবং কবি জসিমউদদীন, কাজী নজরুল ইসলামের কিছু বই নিয়ে কোলকাতায় যান। সঙ্গে ছিলেন কিউ এম জামান যিনি পরে মুখ ও মুখোশের চিত্রগ্রহন করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কোলকাতায় বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার মণি বোসের সাথে দেখা করে চিত্রনাট্য লিখে দেয়ার অনুরোধ করেন তারা। মণি বোস সব যাচাই করে ডাকাত নাটকের পান্ডুলিপিই পছন্দ করেন। তিনি তিনটা দৃশ্য লিখে বাকিটা লাইন আপ করে দেন। চিত্রনাট্য তৈরির বাকী অংশের কাজ শেষ করেন আবদুল জব্বার খান নিজেই। ১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট হোটেল শাহবাগে মুখ ও মুখোশ সিনেমার মহরত অনুষ্ঠিত হয়। মহরতে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা। এ সিনেমার স্থানীয় অভিনেতারা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই অভিনয় করেন। শুধু তাই নয়, তারা এতে অভিনয় করে কোনো পারিশ্রমিকও নেননি। পূর্ব পাকিস্তানে তখন প্রোডাকশন স্টুডিও না থাকায়, সিনেমার নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য লাহোরে পাঠানো হয়। সব মিলিয়ে ১৯৫৬ সালে সিনেমার কাজ সম্পন্ন হয়। কিন্তু ঢাকায় প্রদর্শনের অনুমতি পায়নি। এত জল্পনা কল্পনা করে যে সিনেমা নির্মাণ করা হলো অথচ ঢাকায় আসার পর সিনেমা প্রদর্শনীর বিষয়ে প্রেক্ষাগৃহের মালিকদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাননি নির্মাতা। তবে এমন প্রতিবন্ধকতা বেশি দিন ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় একযোগে প্রদর্শিত হয়। সিনেমার প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় পুরান ঢাকার রূপমহল প্রেক্ষাগৃহে। মুক্তি দেয়ার পর টানা চার সপ্তাহ হাউজফুল চলেছিল মুখ ও মুখোশ। তবে আরও চলতো কিন্তু সিনেমা হলের বুকিং ছিল চার সপ্তাহের জন্য। সিনেমার প্রধান পুরুষ চরিত্র রূপায়ণ করেন পরিচালক আব্দুল জব্বার খান নিজে, প্রধান নারী চরিত্র রূপায়ণ করেন পূর্ণিমা সেনগুপ্তা। খলনায়ক ছিলেন ইনাম আহমেদ। এছাড়া আরো অভিনয় করেন জহরত আরা, পিয়ারী বেগম, রহিমা খাতুন, বিলকিস বারী, আমিনুল হক ও সাইফুদ্দিন (কৌতুক অভিনেতা)। সিনেমার অন্যান্য কলাকুশলী হলেন চিত্রগ্রাহক মুরারী মোহন। পরে এই দায়িত্ব তুলে নেন সহকারী চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামান। অঙ্গসজ্জায় শ্যাম বাবু (আসল নাম শমসের আলী), গানে কণ্ঠ দেন আবদুল আলীম এবং মাহবুবা হাসনাত, সংগীত পরিচালক সমর দাস, সহকারী সংগীত পরিচালক ধীর আলী, শব্দগ্রহণে ছিলেন মইনুল ইসলাম। সে সময় মুখ ও মুখোশ সিনেমার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮২ হাজার রুপি। এর মধ্যে ৪২ হাজার রুপি দিয়েছেন ৭০ ও ৮০ দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা আলমগীরের বাবা কলিম উদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়া। আর বাকী ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন তার চার বন্ধুমিলে। সে দিন এ সিনেমা নির্মাণে সাহসী উদ্দ্যেগ না নিলে হয়তো ঢাকাই চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য আর গৌরবের মুখ দেখতে পারতো না। এ সিনেমা নির্মাণের পর এদেশের কিছু নির্মাতা ও প্রযোজক সিনেমা নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি, মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড়, এহতেশামের এদেশ তোমার আমার শিরোনামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এরপর জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, শিবলি সাদিক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আমজাদ হোসেন, দিলীপ বিশ্বাস, চাষী নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, মতিন রহমান, শহিদুল ইসলাম খোকন, হুমায়ূন আহমেদ, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, কাজী হায়াৎ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, এফ আই মানিক, সোহানুর রহমান সোহান, বদিউল আলম খোকনসহ জনপ্রিয় চিত্র নির্মাতারা এদেশে অনেক সুপার হিট চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। আর/১০:১৪/০৩ আগষ্ট



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2hrqAnC
August 04, 2017 at 05:38AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top