প্রায় মাঝমাঠে বল পেলেন লিওনেল মেসি। বার্সেলোনার এই আর্জেন্টাইন তারকার কাছ থেকে পাস পেলেন লুইস সুয়ারেজ। ডান পায়ের আলতো ছোঁয়ায় প্রতিপক্ষ অ্যাপোয়েলের ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে লেফট উইং দিয়ে ঢুকে পড়লেন ডি-বক্সে। তিনজন ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে করলেন লক্ষ্যভেদ। এভাবেই বার্সেলোনার হয়ে প্রথম গোলটা করেন সুয়ারেজ। মেসির সঙ্গেও এরপর থেকে গড়ে ওঠে সখ্য, বন্ধুত্ব। যা এখনও রয়েছে অটুট। উরুগুইয়ান এই স্ট্রাইকারের বাৎসরিক আয় এখন ২৫ মিলিয়ন ইউরো। অথচ এই সুয়ারেজই সুইপারের কাজ করে বেড়াতেন। উরুগুয়ের সাল্টোর রাস্তায় খালি পায়ে ঘুরে বেড়ানো সুয়ারেজের জীবন থেকে নেওয়া যায় অনুপ্রেরণার নেওয়ার গল্প। যার কাছে সেলুলয়েডের রুপালি গল্পগুলোও হার মানতে বাধ্য। সেলুলয়েডের রিলের ফিতায় তার গল্পগুলো গাঁথলে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো এক পর্যায়ে রিল শেষ হয়ে যাবে। কারণ রুপালি পর্দার গল্পের শেষ আছে, মধ্যবিরতি আছে। কিন্তু ফুটবলারদের ক্যারিয়ারটাই এমন, শেষ হইয়াও হইল না শেষ। ১৯৮৭ সালের ২৪ জানুয়ারি। রোডলফো সুয়ারেজ ও সান্দ্রা সুয়ারেজের কোলজূড়ে আসে তাদের চতুর্থ সন্তান। নাম রাখা হয় লুইস আলবার্তো সুয়ারেজ ডিয়াজ। সেখান থেকে কাটছাঁট করে লুইস সুয়ারেজ। সাত সন্তান নিয়ে রোডলফো-সান্দ্রার টানাটানির সংসার। কুলির কাজ করে সংসার চালানো দায় হয়ে যায় সুয়ারেজের বাবার জন্য। বাকি ছয় ভাইবোনের সাথে অভাবকে সঙ্গী করে বড় হয়েছেন। মা সান্দ্রো লোকের বাড়িতে মেঝে ধুয়ে মুছে দিয়ে কিছু রোজগার করতেন। এভাবেই চলছিল সুয়ারেজের পরিবার। কঠিন এই জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে তার বাবা পরিবারকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর। সাত সন্তান ও স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন রোডলফো। সুয়ারেজ সেই ছোট বয়সেই মুখোমুখি হয়েছেন কঠিন বাস্তবতার। হারিয়ে যেতে পারতেন অন্ধকারের চোরাবালিতে। বাড়ির বাইরে রাত কাটানো থেকে শুরু করে মদ্যপান সবই করেছেন কৈশোরে। তবে তাকে সেই অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে এনেছে ফুটবল। সেই সময়টাকে এভাবে ফিরিয়ে এনেছেন সুয়ারেজ, আমরা ছিলাম সমাজের নিম্ন শ্রেণির। পরার মতো জুতা ছিল না আমার। আমার পরিবার বড় হওয়ায় এমনটা হয়েছিল। বা-বাবা আমাদের জন্য যতোটা পেরেছেন করেছেন। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী কখনও কিছু পেতাম না। তবুও আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। উরুগুয়েতে একটা কথা প্রচলিত আছে, অন্যান্য দেশের আছে ইতিহাস, আমাদের আছে ফুটবল। এমন একটা দেশে জন্মগ্রহণ করা কেউ ফুটবলের প্রেমে পড়বে না তা কী করে হয়! ফুটবলে সুয়ারজের হাতেখড়ি সাল্টোর স্পোর্তিভো আর্টিগাস ক্লাবের হয়ে। পরিবারের সঙ্গে রাজধানী মন্টেভিডিওতে চলে যাওয়ার পর ক্লাবও বদলে যায়। মায়ের পরামর্শে উরেতা এফসির হয়ে চালিয়ে যান ফুটবল। ১৪ বছর বয়সে পাড়ি জমান ন্যাসিওনালে। উরুগুইয়ান সেই ক্লাবের যুবদলে খেলেন টানা চার বছর। এক রাতে মদ্যপ অবস্থায় ধরা পড়েন ক্লাবের কোচের কাছে। কোচ রীতিমতো হুমকি দেন তাকে, এমনটা হলে আর কখনও ফুটবল খেলতে পারবে না তুমি। সেদিন কোচের কথা না শুনলে হয়তো সুয়ারেজের গল্পটা অন্যরকম হতো। ২০০৫ সালে ১৮ বছরের তরুণ সুয়ারেজের অভিষেক হয় পেশাদার ফুটবলে। কোপা লিবার্তাদোরেসে জুনিয়র ডি বার্নাকুইলার বিপক্ষে খেলা সেই ম্যাচের পর আরও ২৬ ম্যাচ খেলেন সুয়ারেজ। করেন ১০ গোল। সেই মৌসুমে ডিফেন্সরের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক গোল করেন সুয়ারেজ। সেই ম্যাচে উপস্থিত ছিলেন ডাচ ফুটবল ক্লাব গ্রনেঙ্গনের এক স্কাউট। সেই গোল থেকেই তিনি মন স্থির করেন এই ছেলেকে চাই-ই চাই। যেই ভাবা সেই কাজ! গ্রনেঙ্গন যোগাযোগ করে ন্যাসিওনালের সঙ্গে। দলে ভেড়ায় তরুণ তুর্কি সুয়ারেজকে। সুয়ারেজও ইউরোপে যেতে আগ্রহী ছিলেন। এর আগে ১৫ বছর বয়সে সুয়ারেজের জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। তার থেকে দুই বছরের ছোট এক ব্লন্ডচুলো মেয়ের আগমনে। হ্যাঁ! সোফিয়া বালবি। সুয়ারেজের প্রেমিকা ও বর্তমান স্ত্রী সোফিয়া বালবি। সোফিয়ার প্রেমে পড়েই সুয়ারেজ অনুভব করেন ফুটবলটা তাকে গুরুত্ব সহকারেই নিতে হবে! স্ত্রী সোফিয়া বালবির সঙ্গে সুয়ারেজ। গ্রনেঙ্গনে যাওয়ার আগে ফুটবল খেলে বেশি পয়সাকড়ি পেতেন না সুয়ারেজ। সংসারের খরচ চালানোর জন্য সুইপার হিসেবেও কাজ করতেন ফুটবল খেলার পাশাপাশি। এভাবেই চলছিল বেশ। ২০০৩ সালে সুয়ারেজের জীবন খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায় অন্য এক ঝড়ে। প্রেমিকা সোফিয়া পরিবারের সঙ্গে চলে যান বার্সেলোনায়। মুষড়ে পড়েন ছোট্ট সুয়ারেজ। প্রেমিকার প্রস্থান মেনে নিতে না পেরে ফুটবল থেকেও দূরে যান। তবে দ্রুতই বুঝতে পারেন এই ফুটবলই পারে তাকে সোফিয়ার কাছে নিয়ে যেতে। ন্যাসিওনাল ছেড়ে গ্রনেঙ্গনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন সোফিয়া। ১৯ বছর বয়সী সুয়ারেজের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছিল নেদারল্যান্ডসে। নতুন ক্লাবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে ইংলিশ বা ডাচ ভাষায় কথা বলতে বা বুঝতে না পারায়। ক্লাবের খেলার ধরণের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার জন্য তাকে খেলানো হয় গ্রনেঙ্গনের দ্বিতীয় সারির দলে। সেই কঠিন যাত্রায় তাকে সাহায্য করেন উরুগুইয়ান সতীর্থ ব্রুনো সিলভা। সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠে নিজের জাত চেনান ২৯ ম্যাচে ১০ গোল করে। সুয়ারেজের সেই পারফরম্যান্স নজর কাড়ে বিখ্যাত ডাচ ক্লাব আয়াক্সের। হ্যাঁ! টোটাল ফুটবলের জনক ইয়োহান ক্রুইফের ক্লাব আয়াক্স। যে ক্লাবে খেলেছেন ভ্যান বাস্তেন, ডেনিস বার্গক্যাম্পের মতো কিংবদন্তিরা। সুয়ারেজের জন্য প্রথমে সাড়ে তিন মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব দেয় আয়াক্স। এরপর সাড়ে সাত মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে সুয়ারেজকে দলে টানে ডাচ ক্লাবটি। এরপর কেবল এগিয়ে যাওয়ার গল্প। আয়াক্সের হয়ে পাঁচ মৌসুমে ১১০ ম্যাচ খেলে গোল করেন ৮১টি। ২০০৮-০৯ মৌসুমে তার হাতে ওঠে আয়াক্সের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার। পেয়ে যান অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটাও। আয়াক্সের সেই বিধ্বংসী ফর্ম নিয়ে নজরে আসেন ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলের। সহজাত গোল স্কোরিংয়ের ক্ষমতা দিয়ে জায়গা করে নেন ইংলিশ ফুটবলের অন্যতম সফল ক্লাবে। ২৬.৫ মিলিয়নে আয়াক্স থেকে পাড়ি জমান অলরেডদের শিবিরে। লিভারপুলের হয়ে চার মৌসুমে খেলেছেন ১১০ ম্যাচ। লাল জার্সি গায়ে চাপিয়ে লক্ষ্যভেদ করেছেন ৬৯ বার। জিতেছেন লিগ কাপ। এরপর কেবল একটার পর একটা ধাপ অতিক্রম করা। ২০১৩-১৪ মৌসুমে হয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়। অ্যানফিল্ড মাতানো সেই সুয়ারেজ ২০১৪ সালে যোগ দেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব বার্সেলোনায়। সেখানে গিয়ে মেসি ও নেইমারের সঙ্গে গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর আক্রমণত্রয়ী এমএসএন। সাবেক বার্সেলোনা কোচ লুইস এনরিকের অধীনে খেলে এই তিনজন অসংখ্যবার ভেদ করেছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণ দেওয়াল। গেল আগস্টে বার্সেলোনা ছেড়ে প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ে (পিএসজি) যোগ দিয়েছেন নেইমার। ভেঙ্গে যায় এমএসএন। নেইমার চলে গেলেও এখনও বার্সেলোনার আক্রমণভাগে আছেন মেসি ও সুয়ারেজ। খেলেন বিশ্বসেরা ফুটবলারদের একজন মেসির সঙ্গে। তবুও আটকে নেই সুয়ারেজ। কাতালান ক্লাবটির হয়ে ১০০ ম্যাচ খেলে করেছেন ৮৭ গোল। স্ট্রাইকার হয়েও সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ৫৭টি গোল। ক্লাবের হয়ে জিতেছেন লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা দেলরে মতো আরও অনেক শিরোপা। জাতীয় দলের জার্সিতেও উজ্জ্বল সুয়ারেজ। ৯৩ ম্যাচ খেলে ৪৭ গোল করে হয়েছেন দেশের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ২০১১ সালে দলকে জেতান কোপা আমেরিকার শিরোপা। ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিটাও বেশ ভারী ৩০ বছর বয়সী সুয়ারেজের। ২০১৫-১৬ মৌসুমে লা লিগায় ৪০ গোল করে সময়ের সেরা দুই ফুটবলার মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে পেছনে ফেলে জিতেছেন পিচিচি ট্রফি। ২০০৯ সালের পর সুয়ারেজই একমাত্র ফুটবলার যিনি মেসি-রোনালদোকে পেছনে ফেলে পিচিচি ট্রফি ও ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু জিতেছেন। ২০১১ সালে জিতেছেন কোপা আমেরিকার শিরোপা। ২০১০ বিশ্বকাপে হাত দিয়ে প্রতিপক্ষের গোল ঠেকানো। ২০১৪ বিশ্বকাপের ম্যাচে ইতালির ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনিকে কামড়ে দেয়া, লিভারপুলে খেলার সময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্যাট্রিস এভরার সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ। এসব মিলিয়ে অর্জনের সঙ্গে সমালোচনার পাল্লাটাও বেশ ভারী সুয়ারেজের। স্মৃতির টাইম মেশিনে চড়ে একটু পেছনে তাকালে সুয়ারেজ হয়তো এখন মুচকি হাসেন। কৈশোরে দারিদ্র্যর কাছে হার মেনে খোয়াতে হয়েছিল অনেক কিছু। আর দশটা ল্যাটিন ছেলের মতো ছিল না তার শৈশব। বড় হয়েছেন কঠিন বাস্তবতাকে নিত্যসঙ্গী করে। সেই দুঃখ-দৈন্যকে পেছনে ফেলে সুয়ারেজ আজ বিশ্বসেরা স্ট্রাইকারদের একজন। শুধু ফুটবলই না! জয়ী হয়েছেন ভালবাসার লড়াইয়েও। ২০০৯ সালে প্রেমিকা সোফিয়াকে বিয়ে করেছেন। সুয়ারেজ-সোফিয়া দম্পতির কোল আলো করে এসেছে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান। গোল্ডেন শু হাতে নিয়ে লুইস সুয়ারেজ। ফুটবলকে কতটা ভালবাসেন সুয়ারেজ? তার ভাষায়, একটা সময় আমি দুই বেলা খেতে পেতাম না। তখন হাল ছাড়িনি, এখনও হাল ছাড়ি না। এখনও ভালবেসে ফুটবল খেলে যাই। সুয়ারেজকে লিভারপুল ইকো মূল্যায়ন করেছে এভাবে, উরুগুয়ের সেই ছেলেটি যে কিনা খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতো, এখন সে জাতীয় আইকন। ডেইলি মেইল এক বিশেষ প্রতিবেদনে লেখে, সুয়ারেজ; ভিন্ন এক ফুটবলার! অগণিত মানুষের এক নায়ক। জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে কতশত রহস্য, অজানা চ্যালেঞ্জ। সেই রহস্য হার মানায় চিত্রনাট্যকারের লেখা পাণ্ডুলিপিকেও। এই রহস্যের মায়াজাল সুয়ারেজ ভেদ করেছেন ফুটবলকে ভালবেসে। একের পর এক চ্যালেঞ্জকে জয় করেছেন গতিময় শটে করা কোনও এক গোলের মতোই। লুইস সুয়ারেজ; দারিদ্র্যকে জয় করা এক যোদ্ধা। আর/১০:১৪/২৫ সেপ্টেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2wh5Lyi
September 26, 2017 at 05:52AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন