মানুষ তার মস্তিস্ক কাজে লাগিয়ে শক্ত ও কঠিন ভাষা আয়ত্ব এবং প্রয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণীজগতের মধ্যে স্বকীয় অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। মোটাদাগে এই মানুষের অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁরা দলগতভাবে সামাজিক জীবনযাপন করেন। পৃথিবীতের মানুষের অপার কৃতিত্ব রয়েছে, রয়েছে নানা সৃষ্টিও। নানান সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এই মানুষই সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন। মানুষের কল্যাণে অন্ধকারযুগের অবসান ঘটেছে সেই অনেক আগেই। অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসা মানুষ কতখানি আলোকিত হয়েছে? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি সেই মানুষ আজ দ্বিধাগ্রস্থ, সংস্কারাচ্ছন্ন, আত্মকেন্দ্রিক, বিচ্ছিন্ন, অনুভুতিহীন, বিকারগ্রস্থ, দূর্নীতির বেড়াজালে জড়িয়ে ‘রুগ্ন মানুষে’ পরিণত হয়েছেন। এমন রুগ্ন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এই রুগ্ন মানুষ কি পারে সমাজ তথা রাষ্ট্র নির্মাণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে। অথচ এমনতো হবার কথা ছিল না।
হলি আর্টিজন বা শোলাকিয়া হামলা, তনুসহ অনেক তরুনী এমনকি শিশুকে ধর্ষনের পর হত্যা, প্রকাশ্য বর্বরতা, একদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ জনের মৃত্যু, ফ্যাক্টরীতে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর মিছিল, ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যাসহ এমন সব নানান ঘটনা আমাদের মনে কোন আলোড়ন তুলে না। একেবারেই চলমান ঘটনা ‘রোহিঙ্গা সংকট’। আমাদের এই লেখায় যে আলোকচিত্রটি ব্যবহার করেছি সেটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বার্তা সংস্থা এপি’র আলোকচিত্র সাংবাদিক দার ইয়াসিনের তোলা। ছবিটি আমাদের দেশের জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছে ‘ রোহিঙ্গা মা’ শিরোনামে। ছবির বিষয়টি হচ্ছে, মিয়ানমারে হত্যা নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নৌকা বাংলাদেশের নিরাপদ মাটি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। তীরে এসে নৌকাটি ডুবে গেলে প্রায় কোমরসমান পানিতে পড়ে মারা যায় মাত্র ৪০ দিনের শিশু আব্দুল মাসউদ। সেই সন্তানকে নিয়ে মা হানিদা বেগমের কান্না আর বিলাপ। সাংবাদিক জুলহাস আলম ও দার ইয়াসিনের যৌথ লেখা প্রতিবেদনের এক যায়গায় বলা হয়েছে, ‘ এই রোহিঙ্গা মায়ের কান্নার সময়ও বেশি ছিলনা। কারণ তার আরো কয়েকজন স্বজন ডুবে গেছে’।
সাম্প্রতিক এই রোহিঙ্গা নির্যাতনকে নিয়ে দু’টি শিশুর করুণ অবস্থার ছবি দিয়ে ‘আমরা নিধনের মুখোমুখি’ শিরোনামে প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মানবিকতা থাকলেই প্রকাশিত প্রতিবেদনের ছবির ওই শিশুর মায়াবি চাহনি আর মাত্র ৪০ দিনের ‘বুকের ধন’ হারিয়ে হানিদা বেগমের বিলাপ দেখলে মানুষের ‘সরব’ হওয়ারই কথা। আবার ছবি নিয়ে অপতৎপরতাও দেখছি, মানুষের অনুভূতিকে ‘সরব’ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভৎস ছবি দেয়া হচ্ছে। অবশ্য এই ছবিগুলোর একটা বড় অংশই রয়েছে বিকৃত। একটি গোষ্ঠি অপতৎপরতার অংশ হিসেবে এমন কাজটি করছেন। বিভৎস ছবির চেয়ে হানিদা বেগমের কান্নার মূল্য কি কম? যাক যে কথা বলছিলাম। অবস্থাটা এমনই যে, মানুষের অনুভুতিগুলো যেন দিনে দিনে ‘কোমায়’ চলে যাচ্ছে। সংগ্রাম করে সভ্যতার বিকাশ ঘটানো মানুষ একইভাবে যেন প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়েছেন। মানুষ তাঁর স্বকীয়তা ও দায়িত্ব থেকে দূরে থাকছেন অবচেতনভাবে কিংবা সচেতনভাবে। ফলশ্রুতিতে আমরা আমাদের সন্তানকে চিনতে পারি না। হঠাৎ করে তারা বদলে যায়, বিপথে পা বাড়ায়। এসবের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করা হচ্ছে। কেউ বলছেন পরিবার দায়ী, কেউ বা বলছেন সমাজ বা রাষ্ট্র। কেউবা দায়ী করছেন, আমাদের নানান ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি ও সংস্কৃতিকে। পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে। হ্যাঁ, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহতে আমরাও মনে করি পরিবর্তনটা প্রয়োজন শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে। কারণ প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃাতিবান মানুষ পারে সমাজ তথা ব্যক্তিকে বদলে দিতে। সমাজের প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করার জন্য যেমন তার বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থা বিবেচনায় নিতে হয়, তেমনি সেটিকে একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকেও দেখা খুব জরুরী। কেননা প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ সমাজে প্রতিক্রিয়া তৈরী করে। এটা সাময়িক হতে পারে আবার দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। একইভাবে এই প্রভাবের ফল ইতিবাচক (উদার) হতে পারে, আবার নেতিবাচক (রক্ষনশীল) হতে পারে। পাঠক তাই কয়েকটি প্রত্যয় বোঝা দরকার। যেমন, শিক্ষা, সংস্কৃতি কি? সমাজ বা রাষ্ট্রে এসবের প্রভাব কি? এসব বিষয়ে যাবার আগে ইতিহাসটা জেনে নেয়া যাক।
বাঙালী জাতিকে তার সংগ্রামী চেতনার পথচলায় বিভিন্ন সময় হোঁচট খেতে হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিক্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তানের। দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণেই এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এ বিভক্তিকে মেনে নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে যায়। কিন্তু এ স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি দেরি হয়নি। মোটাদাগে বিদ্রোহের সূত্রপাতটা হয়েছিল পাকিস্তানের গর্ভনর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করা ঘটনাটিকে ঘিরে। এই বিদ্রোহ ক্রমশ আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র ভাষা বাংলার জন্য পাকিস্তান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ কয়েকজন বাঙালী যুবক। ভাষা আন্দোলন একাধারে রাজনৈতিক ও সাস্কৃতিক আন্দোলনও। এই আন্দোলন থেকে একদিকে গুনী ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি অন্যদিকে রাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্রমশ বিকশিত হয়। সংগ্রামী মানুষ ‘স্বপ্ন’ দেখতে শিখে। সেই স্বপ্ন মুক্তির। মুক্তির স্বপ্ন দেখা বাঙালীদের সীমাহীন নিপীড়ন সত্ত্বেও কোনভাবে পাকিস্তানিরা মাথা নোয়াতে পারেনি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে মুক্তির আকাংখা থেকেই লাখো তরুন অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাক হানাদার বাহিনী পরাজিত হয় বাঙালী তরুনদের হাতেই। এই শক্তি সেদিন তরুণরা পেয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বিকশিত সংস্কৃতির ভেতর থেকে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যে বিরাট পরিবর্তন আসে সেটাই ছিল তরুনদের অমিত তেজের উৎস। আহমেদ শরীফ দর্শন চিন্তা বইয়ে লিখেছেন ‘জীবনের চালিকা শক্তি হচ্ছে অভাববোধ, আকাংখা পূর্তির আগ্রহ, জিজ্ঞাসা, জিগীষা, পুরাতনে বিরাগ, নতুন কিছু সৃষ্টি বা প্রাপ্তি বাঞ্চা। এসব চিন্তা-চেতনা যে সব বুদ্ধিমানকে প্রনোদনা দেয় তাদেরই কেউ কেউ উদ্ভাবক, আবিষ্কারক ও নির্মাতারূপে মানব সংস্কৃতির স্রষ্টা’। সেদিন তরুনরা ওই অভাববোধ আর আকাংখা পূর্তির আগ্রহ আর পুরাতনে বিরাগভাজন হয়েই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে অভ’্যথান ঘটান। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয় আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ। তাহলে এখন এমন তরুনরা কই?
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় সাড়ে তিন বছরের মাথায়। থমকে যায় রাষ্ট্র। গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। শুরু হয় পশ্চাৎগামীতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জনগুলো পথ হারায় এবং যে পশ্চাৎপদ চিন্তা মুক্তি সংগ্রামে পরাজিত হয়েছিল তা পুর্নবাসিত হতে শুরু করে। নানান লেবাসে যা এখনো অব্যাহত। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন কায়দায় হত্যা, বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ড, বিপরীতহীনতার সংস্কৃতি। উথান ঘটেছে মৌলবাদের, জঙ্গিবাদের। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? হ্যাঁ, উপায় অব্যশই আছে। সত্যিকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ পারে একটা নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এক্ষেত্রে সংস্কৃতিকর্মীদের দায়িত্ব সবার আগে। তাদেরকে বলিষ্ঠতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। যেমনটা ঘটেছিল ইতালিতে রেঁনেসাঁয়। যার ঢেউ লেগেছিল গোটা ইউরোপ জুড়ে। ত্রিশের দশকে কল্লোলযুগ বা প্রগতি আমাদের সমাজ বিকাশে তথা মানস কাঠোমো গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আমরা যে শিক্ষার কথা বললাম, সেই শিক্ষার অর্থ কি? মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘সভ্যতা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শিক্ষা মানে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়, আর পরিচয় মানে আনন্দ। শিক্ষা মনের দ্বার খুলে দিয়ে অপরিচিতকে পরিচিত করে, অজানাকে জানার রাজ্যে নিয়ে আসে’। তিনি আরো লিখেছেন, ‘অশিক্ষিত লোক অভিজ্ঞতার আলোয় দাঁড়িয়ে থাকে, ঘরে ঢুকতে পারে না...’।
এখন দেখা যাক আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। সত্যিকার অর্থে কি প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ তৈরী হচ্ছে। সম্প্রতি প্রথম আলোয় কবি প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন লিখেছেন, ‘জীবনের চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধক অতিক্রম করার জন্য শিক্ষা তেমন পুঁজি দিতে পারে না। কারণ, জীবন তো আসলে পাঠ্য বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না, মানুষের কাছে জীবনের দাবি হলো বিচক্ষণতা, ন্যায়বোধ, সেবা পরায়ণতা, সংবেদনশীলতা, কৌতুহল জিজ্ঞাসু মানুষ, শুভবোধ, মহত্ব, সহিঞ্চুতা, ধৈর্য্য, উদ্যম, অভিনিবেশ ইত্যাদি নানান মানবিক গুণ এবং অব্যশই দক্ষতা। আগেও লিখেছি, আবার বলি: আমাদের ব্যবস্থার গুণে স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ শিক্ষার্থী নেই, শিশু থেকে তরুণ সবাই মূলত আজ পরীক্ষার্থী। জীবন কি, তার আকাংখা কি। তার স্বার্থকতার পথে অন্তরায় কিÑ এসব নিয়ে ভাববার অবকাশ আমাদের শিক্ষার্থীদের যেমন নেই, তেমনি নেই তথাকথিত শিক্ষিতদের। নিজের অন্তর্নিহিত সত্তাকে জানার স্পৃহা বহুপ্রাচীন। উপনিষৎকারীদের বিশেষ সাধনা ছিলো আত্মনং বিদ্ধি, সক্রেটিসেরও তাই নো দাই সেলফ’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবি নোয়াম চমস্কি তার ‘ফেইলড স্টেট’ বইয়ে লিখেছেন, ‘যে কারো জন্য অন্যতম কঠিন ও গুরুত্বপুর্ণ কাজ হল নিজের চেহারা আয়নায় দেখা। যদি আমরা তা করি তাহলে আমাদের দেশে ব্যর্থ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো অবলোকন করতে মোটেও কষ্ট হবে না’।
সক্রেটিস বা নোয়াম চমস্কি নিজেকে জানার বিষয়ে বলেছেন ঠিকই। কিন্তু ব্যক্তিতো সমাজের বাইরে নয়। সে সমাজেরই অংশ। নিজেকে জানতে হলে সমাজ বা রাষ্ট্রের সংগেও মিলিয়ে দেখতে হয়। আমরা সমাজের বা রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করি। কিন্তু আমাদের নিজেদের চেহারা আয়নায় কি দেখি। সেটিও দেখা জরুরী।
শিক্ষক, সাহিত্যিক জুলফিকার মতিন মানিক বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন..... ‘মানুষকে কেউ শিকল দিয়ে বেধে রাখেনি, কিন্তু সমাজ সংসার সংস্কার ও তার প্রেক্ষিতগত বিবেক ও দায়িত্ববোধের বিভ্রমের অদৃশ্য বেড়িতে সে থাকে আবদ্ধ...’।
একইভাবে সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, ‘ মধ্যবিত্ত বিকাশের সবচেয়ে প্রধান লক্ষণ যে ব্যক্তির উথান তাকে কি কোথাও ঠাহর করা যাচ্ছে? বিচিত্র সব পরস্পর বিরোধী ও অসংগতিপুর্ণ সব বিশ্বাস, ভক্তি, সংস্কার, মূল্যবোধ, উত্তেজনা, প্রেরণা ও সংকল্পের নিরাপদ সহ অবস্থানে অত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা একশোটা শার্লক হোমসের ও সাধ্যের বাইরে’। তিনি বলেছেন, ‘সমাজে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তির আজ বড়ই অভাব। এর কারণ প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার অভাব’।
আজ ক্রমশ শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। শিক্ষা এখন শুধু চাকুরীর প্রয়োজনে সার্টিফিকেট লাভ। শিক্ষা বিতরণ করা হয়না-হয় বিপনন। তাই শিক্ষা নিয়ে চলছে বাণিজ্য। ফলে শিক্ষার্থীরা মৌলিক শিক্ষাই আগ্রহ না দেখিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে শুধুমাত্র সেসব বিষয়ের প্রতি যেগুলোয় সহজে চাকুরী পাওয়া যায়। রাষ্ট্রে অর্থনীতি হলো কাঠামো। আর উপরিকাঠামো হচ্ছে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি সব কিছু। আমাদের অর্থনীতি কালো টাকা নির্ভর। সহজ কথায় অবৈধ পন্থায় উপার্জিত। সেই কারণে শিক্ষা ও সংস্কৃতি আজ কলুষিত। কর্পোরেট পুঁজির দখলে। এখান থেকে বের হতে হবে তা খুবই জরুরী।
সংস্কৃতি। আসলে সংস্কৃতি কি? সমাজে বা রাষ্ট্রে এর প্রভাব কি? তা একটু জানা দরকার বলে আমরা মনে করি। মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা। সংস্কৃতির অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ। এই সুধী বচনের নিহিত তাৎপর্য সংস্কৃতিসেবীদের নিরপেক্ষতা নয়, জীবন-বিমুখতায় সামাজিক দায় অস্বীকার করা নয়। সমাজিক দায় এক অর্থে সাংস্কৃতিক দায়, তথা সংস্কৃতিমনস্কতার দায়। সংস্কৃতি বাস্তব অর্থে বৈপরীত্যময় জীবন চর্চার সম্পন্ন ফসল। উল্লেখিত সুধী বচনের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসংশয়ে বলা যায়, বহু ভঙ্গিম রূপের আত্যন্তিক চর্চা এক পাশে রেখে শুধু ভঙ্গিতে ভোলানোর চেষ্টা বা নিরপেক্ষ বলয়ে তাপ-চাপ থেকে সুরক্ষিত বসবাসের চেষ্টা সংস্কৃতিসেবীর পক্ষে গর্হিত আচরণ। এক কথায় স্বদেশ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ’।
ইতালির রাজনীতিক গ্রামসি লিখলেন, সংস্কৃতি একটা ভিন্ন ধরনের জিনিস। আত্মসচেতনতা ও আত্ম সংস্কারের হাতিয়ার হল সংস্কৃতি।
আমরা জানি, গ্রীকরা তাদের জ্ঞানকে সংস্কৃতি সাধনার উপায়রূপে গ্রহণ করেছিল। শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির উপায়রূপে নয়। ইতিহাস থেকে দেখা যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি শিল্পীদের ঐতিহাসিক ভুমিকা। এ ক্ষেত্রে আমারা চিত্র শিল্পী পিকাসোকে ভেবে দেখতে পারি। স্পেনে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তিনি ছবি একে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন, উৎসাহ যোগিয়েছেন সংগ্রামীদের। শিল্পী পিকাসোর মতো আমাদের দেশের শিল্পী সাহিত্যিক তথা সংস্কৃতি কর্মীরা লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের বিরুদ্ধে। নির্যাতন হুমকি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছেন সেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার ছিলেন শিল্পী সাহিত্যিকরা। লড়াই করেছেন, জেলেও গেছেন। আমাদের সামনে এমন গৌরবময় দৃষ্ট্রান্ত অনেক।
এখন প্রতিক্রিয়াশীলতা, জঙ্গিবাদের ব্যানারে বর্বরতার মুখে খুবই জরুরী সেই ‘গৌরবময় দৃষ্টান্ত’ ফিরে আসা। সকল অন্যায়-অবিচার প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তারা যদি তাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মাধ্যমে বাঙালীর চেতনা শাণিত করতে এগিয়ে না আসে ক্রমশ শক্তি সঞ্চার করবে প্রতিক্রিয়াশীলরা। মৌলবাদী রাজনীতি আর জঙ্গীবাদের উত্থান ঠেকানো কঠিন হবে। তাই মানুষকে উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত করতে হবে তাদেরকেই। কঠিন সময়ে চেতনাপ্রাপ্ত মানুষেরাই পারেন প্রকৃত সমাজে চিত্রের রূপায়ন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়Ñ
‘পারিবনা কি যোগ দিতে এই ছন্দেরে,
খসে যাবার, ভেসে যাবার
ভাঙবারই আনন্দরে’।
আবার ফয়েজ আহমেদ তার ‘সত্য বাবু মারা গেছেন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক দর্শন যেখানে কল্যাণমুখী, যেখানে বৈষম্য পলাতক, সেখানে সমঅধিকার ও মূল্যবোধ সমুন্নত, সেখানে পতিত মানবের জন্ম হয়না’। উপমহাদেশের বিখ্যাত শায়ের (কবি) মীর্জা গালিব লিখেছেন, ‘সহজতো নয় সকল কাজই সহজ হওয়া, জন্মসূত্রে মানুষ থেকে মানুষ হওয়া’।
তাই মানুষ আমাদের হতেই হবে। দেশের স্বার্থে, প্রজন্মের স্বার্থে। এই জন্য প্রয়োজন যথার্থ শিক্ষা ও সংস্কৃতির জাগরণ।
# লেখক দু’জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গণমাধ্যম কর্মী
হলি আর্টিজন বা শোলাকিয়া হামলা, তনুসহ অনেক তরুনী এমনকি শিশুকে ধর্ষনের পর হত্যা, প্রকাশ্য বর্বরতা, একদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ জনের মৃত্যু, ফ্যাক্টরীতে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর মিছিল, ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যাসহ এমন সব নানান ঘটনা আমাদের মনে কোন আলোড়ন তুলে না। একেবারেই চলমান ঘটনা ‘রোহিঙ্গা সংকট’। আমাদের এই লেখায় যে আলোকচিত্রটি ব্যবহার করেছি সেটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বার্তা সংস্থা এপি’র আলোকচিত্র সাংবাদিক দার ইয়াসিনের তোলা। ছবিটি আমাদের দেশের জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছে ‘ রোহিঙ্গা মা’ শিরোনামে। ছবির বিষয়টি হচ্ছে, মিয়ানমারে হত্যা নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নৌকা বাংলাদেশের নিরাপদ মাটি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। তীরে এসে নৌকাটি ডুবে গেলে প্রায় কোমরসমান পানিতে পড়ে মারা যায় মাত্র ৪০ দিনের শিশু আব্দুল মাসউদ। সেই সন্তানকে নিয়ে মা হানিদা বেগমের কান্না আর বিলাপ। সাংবাদিক জুলহাস আলম ও দার ইয়াসিনের যৌথ লেখা প্রতিবেদনের এক যায়গায় বলা হয়েছে, ‘ এই রোহিঙ্গা মায়ের কান্নার সময়ও বেশি ছিলনা। কারণ তার আরো কয়েকজন স্বজন ডুবে গেছে’।
সাম্প্রতিক এই রোহিঙ্গা নির্যাতনকে নিয়ে দু’টি শিশুর করুণ অবস্থার ছবি দিয়ে ‘আমরা নিধনের মুখোমুখি’ শিরোনামে প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মানবিকতা থাকলেই প্রকাশিত প্রতিবেদনের ছবির ওই শিশুর মায়াবি চাহনি আর মাত্র ৪০ দিনের ‘বুকের ধন’ হারিয়ে হানিদা বেগমের বিলাপ দেখলে মানুষের ‘সরব’ হওয়ারই কথা। আবার ছবি নিয়ে অপতৎপরতাও দেখছি, মানুষের অনুভূতিকে ‘সরব’ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভৎস ছবি দেয়া হচ্ছে। অবশ্য এই ছবিগুলোর একটা বড় অংশই রয়েছে বিকৃত। একটি গোষ্ঠি অপতৎপরতার অংশ হিসেবে এমন কাজটি করছেন। বিভৎস ছবির চেয়ে হানিদা বেগমের কান্নার মূল্য কি কম? যাক যে কথা বলছিলাম। অবস্থাটা এমনই যে, মানুষের অনুভুতিগুলো যেন দিনে দিনে ‘কোমায়’ চলে যাচ্ছে। সংগ্রাম করে সভ্যতার বিকাশ ঘটানো মানুষ একইভাবে যেন প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়েছেন। মানুষ তাঁর স্বকীয়তা ও দায়িত্ব থেকে দূরে থাকছেন অবচেতনভাবে কিংবা সচেতনভাবে। ফলশ্রুতিতে আমরা আমাদের সন্তানকে চিনতে পারি না। হঠাৎ করে তারা বদলে যায়, বিপথে পা বাড়ায়। এসবের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করা হচ্ছে। কেউ বলছেন পরিবার দায়ী, কেউ বা বলছেন সমাজ বা রাষ্ট্র। কেউবা দায়ী করছেন, আমাদের নানান ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি ও সংস্কৃতিকে। পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে। হ্যাঁ, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহতে আমরাও মনে করি পরিবর্তনটা প্রয়োজন শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে। কারণ প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃাতিবান মানুষ পারে সমাজ তথা ব্যক্তিকে বদলে দিতে। সমাজের প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করার জন্য যেমন তার বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থা বিবেচনায় নিতে হয়, তেমনি সেটিকে একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকেও দেখা খুব জরুরী। কেননা প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ সমাজে প্রতিক্রিয়া তৈরী করে। এটা সাময়িক হতে পারে আবার দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। একইভাবে এই প্রভাবের ফল ইতিবাচক (উদার) হতে পারে, আবার নেতিবাচক (রক্ষনশীল) হতে পারে। পাঠক তাই কয়েকটি প্রত্যয় বোঝা দরকার। যেমন, শিক্ষা, সংস্কৃতি কি? সমাজ বা রাষ্ট্রে এসবের প্রভাব কি? এসব বিষয়ে যাবার আগে ইতিহাসটা জেনে নেয়া যাক।
বাঙালী জাতিকে তার সংগ্রামী চেতনার পথচলায় বিভিন্ন সময় হোঁচট খেতে হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিক্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তানের। দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণেই এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এ বিভক্তিকে মেনে নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে যায়। কিন্তু এ স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি দেরি হয়নি। মোটাদাগে বিদ্রোহের সূত্রপাতটা হয়েছিল পাকিস্তানের গর্ভনর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করা ঘটনাটিকে ঘিরে। এই বিদ্রোহ ক্রমশ আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র ভাষা বাংলার জন্য পাকিস্তান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ কয়েকজন বাঙালী যুবক। ভাষা আন্দোলন একাধারে রাজনৈতিক ও সাস্কৃতিক আন্দোলনও। এই আন্দোলন থেকে একদিকে গুনী ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি অন্যদিকে রাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্রমশ বিকশিত হয়। সংগ্রামী মানুষ ‘স্বপ্ন’ দেখতে শিখে। সেই স্বপ্ন মুক্তির। মুক্তির স্বপ্ন দেখা বাঙালীদের সীমাহীন নিপীড়ন সত্ত্বেও কোনভাবে পাকিস্তানিরা মাথা নোয়াতে পারেনি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে মুক্তির আকাংখা থেকেই লাখো তরুন অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাক হানাদার বাহিনী পরাজিত হয় বাঙালী তরুনদের হাতেই। এই শক্তি সেদিন তরুণরা পেয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বিকশিত সংস্কৃতির ভেতর থেকে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যে বিরাট পরিবর্তন আসে সেটাই ছিল তরুনদের অমিত তেজের উৎস। আহমেদ শরীফ দর্শন চিন্তা বইয়ে লিখেছেন ‘জীবনের চালিকা শক্তি হচ্ছে অভাববোধ, আকাংখা পূর্তির আগ্রহ, জিজ্ঞাসা, জিগীষা, পুরাতনে বিরাগ, নতুন কিছু সৃষ্টি বা প্রাপ্তি বাঞ্চা। এসব চিন্তা-চেতনা যে সব বুদ্ধিমানকে প্রনোদনা দেয় তাদেরই কেউ কেউ উদ্ভাবক, আবিষ্কারক ও নির্মাতারূপে মানব সংস্কৃতির স্রষ্টা’। সেদিন তরুনরা ওই অভাববোধ আর আকাংখা পূর্তির আগ্রহ আর পুরাতনে বিরাগভাজন হয়েই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে অভ’্যথান ঘটান। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয় আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ। তাহলে এখন এমন তরুনরা কই?
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় সাড়ে তিন বছরের মাথায়। থমকে যায় রাষ্ট্র। গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। শুরু হয় পশ্চাৎগামীতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জনগুলো পথ হারায় এবং যে পশ্চাৎপদ চিন্তা মুক্তি সংগ্রামে পরাজিত হয়েছিল তা পুর্নবাসিত হতে শুরু করে। নানান লেবাসে যা এখনো অব্যাহত। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন কায়দায় হত্যা, বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ড, বিপরীতহীনতার সংস্কৃতি। উথান ঘটেছে মৌলবাদের, জঙ্গিবাদের। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? হ্যাঁ, উপায় অব্যশই আছে। সত্যিকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ পারে একটা নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এক্ষেত্রে সংস্কৃতিকর্মীদের দায়িত্ব সবার আগে। তাদেরকে বলিষ্ঠতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। যেমনটা ঘটেছিল ইতালিতে রেঁনেসাঁয়। যার ঢেউ লেগেছিল গোটা ইউরোপ জুড়ে। ত্রিশের দশকে কল্লোলযুগ বা প্রগতি আমাদের সমাজ বিকাশে তথা মানস কাঠোমো গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আমরা যে শিক্ষার কথা বললাম, সেই শিক্ষার অর্থ কি? মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘সভ্যতা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শিক্ষা মানে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়, আর পরিচয় মানে আনন্দ। শিক্ষা মনের দ্বার খুলে দিয়ে অপরিচিতকে পরিচিত করে, অজানাকে জানার রাজ্যে নিয়ে আসে’। তিনি আরো লিখেছেন, ‘অশিক্ষিত লোক অভিজ্ঞতার আলোয় দাঁড়িয়ে থাকে, ঘরে ঢুকতে পারে না...’।
এখন দেখা যাক আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। সত্যিকার অর্থে কি প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ তৈরী হচ্ছে। সম্প্রতি প্রথম আলোয় কবি প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন লিখেছেন, ‘জীবনের চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধক অতিক্রম করার জন্য শিক্ষা তেমন পুঁজি দিতে পারে না। কারণ, জীবন তো আসলে পাঠ্য বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না, মানুষের কাছে জীবনের দাবি হলো বিচক্ষণতা, ন্যায়বোধ, সেবা পরায়ণতা, সংবেদনশীলতা, কৌতুহল জিজ্ঞাসু মানুষ, শুভবোধ, মহত্ব, সহিঞ্চুতা, ধৈর্য্য, উদ্যম, অভিনিবেশ ইত্যাদি নানান মানবিক গুণ এবং অব্যশই দক্ষতা। আগেও লিখেছি, আবার বলি: আমাদের ব্যবস্থার গুণে স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ শিক্ষার্থী নেই, শিশু থেকে তরুণ সবাই মূলত আজ পরীক্ষার্থী। জীবন কি, তার আকাংখা কি। তার স্বার্থকতার পথে অন্তরায় কিÑ এসব নিয়ে ভাববার অবকাশ আমাদের শিক্ষার্থীদের যেমন নেই, তেমনি নেই তথাকথিত শিক্ষিতদের। নিজের অন্তর্নিহিত সত্তাকে জানার স্পৃহা বহুপ্রাচীন। উপনিষৎকারীদের বিশেষ সাধনা ছিলো আত্মনং বিদ্ধি, সক্রেটিসেরও তাই নো দাই সেলফ’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবি নোয়াম চমস্কি তার ‘ফেইলড স্টেট’ বইয়ে লিখেছেন, ‘যে কারো জন্য অন্যতম কঠিন ও গুরুত্বপুর্ণ কাজ হল নিজের চেহারা আয়নায় দেখা। যদি আমরা তা করি তাহলে আমাদের দেশে ব্যর্থ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো অবলোকন করতে মোটেও কষ্ট হবে না’।
সক্রেটিস বা নোয়াম চমস্কি নিজেকে জানার বিষয়ে বলেছেন ঠিকই। কিন্তু ব্যক্তিতো সমাজের বাইরে নয়। সে সমাজেরই অংশ। নিজেকে জানতে হলে সমাজ বা রাষ্ট্রের সংগেও মিলিয়ে দেখতে হয়। আমরা সমাজের বা রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করি। কিন্তু আমাদের নিজেদের চেহারা আয়নায় কি দেখি। সেটিও দেখা জরুরী।
শিক্ষক, সাহিত্যিক জুলফিকার মতিন মানিক বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন..... ‘মানুষকে কেউ শিকল দিয়ে বেধে রাখেনি, কিন্তু সমাজ সংসার সংস্কার ও তার প্রেক্ষিতগত বিবেক ও দায়িত্ববোধের বিভ্রমের অদৃশ্য বেড়িতে সে থাকে আবদ্ধ...’।
একইভাবে সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, ‘ মধ্যবিত্ত বিকাশের সবচেয়ে প্রধান লক্ষণ যে ব্যক্তির উথান তাকে কি কোথাও ঠাহর করা যাচ্ছে? বিচিত্র সব পরস্পর বিরোধী ও অসংগতিপুর্ণ সব বিশ্বাস, ভক্তি, সংস্কার, মূল্যবোধ, উত্তেজনা, প্রেরণা ও সংকল্পের নিরাপদ সহ অবস্থানে অত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা একশোটা শার্লক হোমসের ও সাধ্যের বাইরে’। তিনি বলেছেন, ‘সমাজে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তির আজ বড়ই অভাব। এর কারণ প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার অভাব’।
আজ ক্রমশ শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। শিক্ষা এখন শুধু চাকুরীর প্রয়োজনে সার্টিফিকেট লাভ। শিক্ষা বিতরণ করা হয়না-হয় বিপনন। তাই শিক্ষা নিয়ে চলছে বাণিজ্য। ফলে শিক্ষার্থীরা মৌলিক শিক্ষাই আগ্রহ না দেখিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে শুধুমাত্র সেসব বিষয়ের প্রতি যেগুলোয় সহজে চাকুরী পাওয়া যায়। রাষ্ট্রে অর্থনীতি হলো কাঠামো। আর উপরিকাঠামো হচ্ছে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি সব কিছু। আমাদের অর্থনীতি কালো টাকা নির্ভর। সহজ কথায় অবৈধ পন্থায় উপার্জিত। সেই কারণে শিক্ষা ও সংস্কৃতি আজ কলুষিত। কর্পোরেট পুঁজির দখলে। এখান থেকে বের হতে হবে তা খুবই জরুরী।
সংস্কৃতি। আসলে সংস্কৃতি কি? সমাজে বা রাষ্ট্রে এর প্রভাব কি? তা একটু জানা দরকার বলে আমরা মনে করি। মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা। সংস্কৃতির অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ। এই সুধী বচনের নিহিত তাৎপর্য সংস্কৃতিসেবীদের নিরপেক্ষতা নয়, জীবন-বিমুখতায় সামাজিক দায় অস্বীকার করা নয়। সমাজিক দায় এক অর্থে সাংস্কৃতিক দায়, তথা সংস্কৃতিমনস্কতার দায়। সংস্কৃতি বাস্তব অর্থে বৈপরীত্যময় জীবন চর্চার সম্পন্ন ফসল। উল্লেখিত সুধী বচনের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসংশয়ে বলা যায়, বহু ভঙ্গিম রূপের আত্যন্তিক চর্চা এক পাশে রেখে শুধু ভঙ্গিতে ভোলানোর চেষ্টা বা নিরপেক্ষ বলয়ে তাপ-চাপ থেকে সুরক্ষিত বসবাসের চেষ্টা সংস্কৃতিসেবীর পক্ষে গর্হিত আচরণ। এক কথায় স্বদেশ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ’।
ইতালির রাজনীতিক গ্রামসি লিখলেন, সংস্কৃতি একটা ভিন্ন ধরনের জিনিস। আত্মসচেতনতা ও আত্ম সংস্কারের হাতিয়ার হল সংস্কৃতি।
আমরা জানি, গ্রীকরা তাদের জ্ঞানকে সংস্কৃতি সাধনার উপায়রূপে গ্রহণ করেছিল। শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির উপায়রূপে নয়। ইতিহাস থেকে দেখা যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি শিল্পীদের ঐতিহাসিক ভুমিকা। এ ক্ষেত্রে আমারা চিত্র শিল্পী পিকাসোকে ভেবে দেখতে পারি। স্পেনে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তিনি ছবি একে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন, উৎসাহ যোগিয়েছেন সংগ্রামীদের। শিল্পী পিকাসোর মতো আমাদের দেশের শিল্পী সাহিত্যিক তথা সংস্কৃতি কর্মীরা লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের বিরুদ্ধে। নির্যাতন হুমকি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছেন সেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার ছিলেন শিল্পী সাহিত্যিকরা। লড়াই করেছেন, জেলেও গেছেন। আমাদের সামনে এমন গৌরবময় দৃষ্ট্রান্ত অনেক।
এখন প্রতিক্রিয়াশীলতা, জঙ্গিবাদের ব্যানারে বর্বরতার মুখে খুবই জরুরী সেই ‘গৌরবময় দৃষ্টান্ত’ ফিরে আসা। সকল অন্যায়-অবিচার প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তারা যদি তাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মাধ্যমে বাঙালীর চেতনা শাণিত করতে এগিয়ে না আসে ক্রমশ শক্তি সঞ্চার করবে প্রতিক্রিয়াশীলরা। মৌলবাদী রাজনীতি আর জঙ্গীবাদের উত্থান ঠেকানো কঠিন হবে। তাই মানুষকে উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত করতে হবে তাদেরকেই। কঠিন সময়ে চেতনাপ্রাপ্ত মানুষেরাই পারেন প্রকৃত সমাজে চিত্রের রূপায়ন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়Ñ
‘পারিবনা কি যোগ দিতে এই ছন্দেরে,
খসে যাবার, ভেসে যাবার
ভাঙবারই আনন্দরে’।
আবার ফয়েজ আহমেদ তার ‘সত্য বাবু মারা গেছেন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক দর্শন যেখানে কল্যাণমুখী, যেখানে বৈষম্য পলাতক, সেখানে সমঅধিকার ও মূল্যবোধ সমুন্নত, সেখানে পতিত মানবের জন্ম হয়না’। উপমহাদেশের বিখ্যাত শায়ের (কবি) মীর্জা গালিব লিখেছেন, ‘সহজতো নয় সকল কাজই সহজ হওয়া, জন্মসূত্রে মানুষ থেকে মানুষ হওয়া’।
তাই মানুষ আমাদের হতেই হবে। দেশের স্বার্থে, প্রজন্মের স্বার্থে। এই জন্য প্রয়োজন যথার্থ শিক্ষা ও সংস্কৃতির জাগরণ।
# লেখক দু’জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গণমাধ্যম কর্মী
from Chapainawabganjnews http://ift.tt/2wB8ty0
September 18, 2017 at 02:35PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন